May 16, 2024
সাহিত্যফিচার ৩প্রবন্ধ

‘অপরিচিতা’য় রবীন্দ্রনাথের নারীপ্রতিমা

মেহেদী হাসান ।।

এক

রবীন্দ্রনাথ ব্রিটিশ-রাজের অধীন বেঁচেছিলেন বিগত ২ শতকের অর্ধ অর্ধ সময় নিয়ে। সময়টা এমন : উনিশ-শতকের শেষ চল্লিশ বছর আর বিশ শতকের প্রথম চল্লিশ বছর। তিনি আগাগোড়া ঔপনিবেশিক সময়ের সন্তান। এ দীর্ঘ সময়ে তিনি বিজ্ঞানের প্রভুত উন্নতি দেখেছেন। তার সুবিধাও ব্যবহার করেছেন। পাশ্চাত্য দুনিয়ার সাম্রাজ্য দেখেছেন।

এডওয়ার্ড সাইদ এক হিসেবে দেখিয়েছেন, ১৮০০ সালে ভূপৃষ্ঠের ৩৫ শতাংশ পাশ্চাত্যের দখলে ছিল, ১৮৭৮ সালে এটা বেড়ে দাঁড়ায় ৬৭ শতাংশে আর ১৯১৪ সালে ৮৫ শতাংশ ভূমি পাশ্চাত্য শক্তিগুলো দখল করে নেয়। রবীন্দ্রনাথ পাশ্চাত্য শক্তির তিনি নিরঙ্কুশ প্রশংসাকারী ছিলেন না, সমালোচনাও করেছেন নানা সময়ে। এ কথা বলা যায়, শেষ জীবনে পাশ্চাত্য সাম্রাজ্যবাদের কঠোর সমালোচক হয়ে উঠেছিলেন। তিনি ঘুরে বেড়িয়েছেন তাবৎ দুনিয়ার এদেশ-ওদেশ। সতেরো বছর থেকে শুরু করে এ ভ্রমণ সারাজীবনই করে গেছেন। বিপুল তাঁর অভিজ্ঞতা, বৈচিত্র্যে তিনি পূর্ণ। এরপরও আক্ষেপ তাঁর কম নয়। তাঁর নিজের রচনায় পরস্পরবিরোধী মনোভাবের প্রকাশও লক্ষ্য করা যায়। একবার রবীন্দ্রনাথকে ব্রিটেনের স্কুল ছাত্র-ছাত্রীরা দুটি প্রশ্ন করেছিল। সে দুটি প্রশ্ন ছিলো এমন : তাঁর কবিতার প্রধান গুণ কী? তাঁর কবিতার প্রধান দোষ কী? দুটোরই তিনি জবাব দিয়েছিলেন, INCONSISTENCY বা অসংগতি বলে (আনিসুজ্জামান, ২০০০: ২৬)। তিনি নিজেও তার রচনার আপাত বৈপরীত্য সম্পর্কে সচেতন ছিলেন হয়তো। ‘অপরিচিতা’ [(ঠাকুর, ২০১৬: ২১-৩৪)। এরপর থেকে এ গল্পের যত উদ্ধৃতি উল্লেখিত হবে সবগুলো এ সূত্রটি নির্দেশ করবে]। এ-গল্পে আমরা রবীন্দ্রনাথের নারী-প্রতিমার যে রূপটা পাবো অন্য কোনো আলোচক তাঁর অন্য কোনো রচনার উদাহরণ টেনে ভিন্নতর মতও প্রকাশ করতে পারবেন। হুমায়ুন আজাদ তাঁর নারী (আজাদ, ২৯৯৩: ১০৭-৮) গ্রন্থে এ কাজটি করেছেন। সে গ্রন্থে রবীন্দ্রনাথের নারীপ্রতিমার যে প্রকাশ ঘটেছে এ আলোচনায় তার ভিন্নতর রূপ পাওয়া সম্ভব। অর্থাৎ আজাদের গ্রন্থে ভিক্টোরিয়ান যুগের নারী প্রতিমার যে রূপটা তিনি তুলে ধরেছেন রবীন্দ্র সাহিত্য আলোচনা করে আমরা তার বিপরীত একটা রূপেরই সন্ধান পাবো এ গল্পে।

মনে রাখা দরকার নারী প্রশ্নে রবীন্দ্রনাথ প্রথাগত কিন্তু সচেতন ছিলেন। যেমন রবীন্দ্রনাথ বলছেন, “মেয়েদের শরীরের এবং মনের প্রকৃতি পুরুষের হইতে স্বতন্ত্র বলিয়াই তাহাদের ব্যবহারের ক্ষেত্র স্বভাবতই স্বতন্ত্র হইয়াছে। আজকাল বিদ্রোহের ঝোঁকে একদল মেয়ে এই গোঁড়াকার কথাটাকেই অস্বীকার করিতেছেন। তাঁরা বলেন, মেয়েদের ব্যবহারের ক্ষেত্র পুরুষের সঙ্গে একবারে সমান ( ঠাকুর, ২০১২ : ২৮৭)। তিনি মনে করতেন, “আসল কথা এই, স্ত্রী হওয়া, মা হওয়া, মেয়েদেও স্বভাব; দাসী হওয়া নয়। ভালোবাসার অংশ মেয়েদের স্বভাবে বেশি আছে – এ-নহিলে সন্তান মানুষ হইত না, সংসার টিকিত না” ( ঠাকুর, ২০১২ : ২৮৭)।

দুই

‘অপরিচিতা’ গল্পে প্রথম নারী হিসেবে পাচ্ছি গল্প-কথক অনুপমের মাকে। অনুপম বলছে: ‘মা গরিবের ঘরের মেয়ে; তাই, আমরা যে ধনী এ কথা তিনিও ভোলেন না, আমাকেও ভুলিতে দেন না।’ অনুপম আরও বলছে, ‘শিশুকালে আমি কোলে কোলেই মানুষ — বোধ করি, সেই জন্য শেষ পর্যন্ত আমার পুরাপুরি বয়সই হইলো না।’ বলাবাহুল্য নয়, এ গল্পে অনুপম আত্মসমালোচনামুখর ভাষায় তার বয়ান উপস্থাপন করেছে। সে মাকে যেভাবে দেখেছে সেভাবেই তুলে ধরেছে। এটা মায়ের বয়ান নয়। এটা একান্তই সন্তানের চোখে দেখা মা। বলা বাহুল্য সন্তানটা পুরষ। মায়ের স্নেহ-আদরে সে বড় হয়েছে এমনভাবে যে তার ‘বয়সই হইলো না ’ এটাই সে বলছে। অর্থাৎ মা তাকে আঁচলের নিচে রেখেছে। বিকশিত হতে দেয় নি। নিজের অবস্থা বলতে গিয়ে সে বলে, ‘আমি অন্নপূর্ণার কোলে গজাননের ছোটো ভাইটি।’ অর্থাৎ, সে কার্তিকেয়, দেখতে সুন্দর কিন্তু কোনো কাজের নয় এ রকম অর্থ আর কি! সংসারে তার বক্তব্য খুবই কম। যে জীবনটা সে যাপন করে সে জীবন তার কাক্সিক্ষত নয়, সে আর মানবিক জীবনের প্রত্যাশা করে। নিজেকে সে ভালোমানুষ ঘোষণা করে। এর কারণ হিসেবে সে বলে, ‘ভালো মানুষ হওয়ার কোনো ঝঞ্ঝাট নাই, তাই আমি নিতান্ত ভালোমানুষ। মাতার আদেশ মানিয়া চলিবার ক্ষমতা আমার আছে – বস্তুত, না মানিবার ক্ষমতা আমার নাই।’ গল্পের ট্র্যাজিক পরিণতির এটা একটা কারণ। সে পছন্দ না করলেও ন্যায্যতার প্রশ্নে সে যৌক্তিক আচরণরে পক্ষে দাঁড়াতে পারে না।
এখানে নারীর মাতৃরূপ প্রতিমাটা পাচ্ছি। তবে এ নারী প্রতিমা পিতার অবর্তমানেও স্বয়ম্ভু কোনো সত্তা নয়। এ মা সন্তান লালনে যতটা ক্ষমতা ভোগ করে সেখানেই এর সমাপ্তি, পুরুষ কর্তার অনুপস্থিতিতে বাড়ির সর্বময় কর্ত্রী তিনি হতে পারেন না। এখানে পুরুষতান্ত্রিক সমাজের প্রথাগত গড়ন প্রধান বাধা হয়ে দাঁড়ায়। তাই আমরা দেখি, মায়ের চেয়েও মামা এ পরিবারে শক্তিমান হয়ে ওঠে। অনুপম নিজেই বলতে বাধ্য হয়, ‘মামা, যিনি পৃথিবীতে আমার ভাগ্যদেবতার প্রধান এজেন্ট, বিবাহ সম্বন্ধে তাঁর একটা বিশেষ মত ছিল। ধনীর কন্যা তাঁর পছন্দ নয়। আমাদের ঘরে যে মেয়ে আসিবে সে মাথা হেঁট করিয়া আসিবে, এই তিনি চান। অথচ টাকার প্রতি আসক্তি তাঁর অস্থিমজ্জায় জড়িত। তিনি এমন বেহাই চান যাহার টাকা নাই, অথচ যে টাকা দিতে কসুর করিবে না।’ অনুপমের এ উক্তি অনেকটা উপসংহার টেনে দিয়েছে পরিবারের প্রধান শক্তিটা কার কাছে, সে বিষয়ে। ‘ভাগ্যদেবতার প্রধান এজেন্ট’ বললে আসলে অন্য কারো অস্তিত্ব যে ক্ষীণ হয়ে যায় সে কথা বলার অপেক্ষা রাখে না।

অনুপমের যে বন্ধু হরিশ কনের সন্ধান দেয়, তার বাক্যটাও আমরা লক্ষ্য করি। এ ক্ষেত্রে অনুপম সমালোচনাপ্রবণ নয়, ব্যঙ্গপ্রবণও নয়, বরং অনেকটা প্রশংসামূলক। তবুও তার উক্তিটা একটু দেখি, ‘ওহে, মেয়ে যদি বল একটি খাসা মেয়ে আছে।’ এখানে কনের যোগ্যতা উপস্থাপনে এমনতরো বাক্য ও শব্দের প্রয়োগ নারীর প্রতি পুরুষতান্ত্রিকতার সামাজিক দৃষ্টিভঙ্গির একটা দিক উন্মোচন করে দেয়। বিয়ের বাজারে নারীর উপস্থাপনে ‘খাসা’ শব্দের ব্যবহার সাধারণ বাজারে পণ্য উপস্থাপনের সঙ্গে কেবল তুল্য।

তিন

হরিশ বর্ণিত ‘খাসা মেয়ে’টা আমাদের গল্পের অপরিচিতা। বিনুদা কনে এসে বলছে, “মন্দ নয় হে! খাঁটি সোনা বটে”। অনুপমের ভাষ্য নির্ভর করলে এ মন্তব্যে কোনো অতিরঞ্জন নেই। বরং কমই আছে। কারণ অনুপম বিনুদা সম্পর্কে বলছে, ‘যেখানে আমরা বলি ‘চমৎকার’ সেখানে তিনি বলেন, ‘চলনসই’।’ অবশ্য গল্পটি অনুপমের ভাষ্যে রচিত তার বাইরে অন্যতর উৎস থেকে এর ভিন্ন তথ্য পাওয়ার জো নেই।
অনুপমের বিয়ের অনুষ্ঠানে পণের ‘গহনার’ শুদ্ধতা যাচাই নিয়ে যে ঘটনায় বিয়েটা শম্ভুনাথ বাবু ভেঙে দেন তাতে অপরিচিতার কোনো ভূমিকা নেই। বলা যায়, তার অংশগ্রহণই নেই। এখানে কর্তা শুম্ভুনাথ বাবু নিজেই। শম্ভুনাথ বাবু বলেন, “আমার কন্যার গহনা আমি চুরি করিব এ কথা যারা মনে করে তাদের হাতে আমি কন্যা দিতে পারি না।” এখানে অপরিচিতার উল্লেখ আছে মাত্র। তবে এর ভুক্তভোগী অনুপম, আর তার মামা। এ ঘটনায় ভারতীয় সমাজের নারীর অবস্থাটা বোঝা যায়। অনুপম বলছে, ‘বিয়ের আয়োজন করতে ‘কন্যাপক্ষকেই কলকাতায় আসিতে হইলো।’ দারিদ্র্য সত্ত্বেও শম্ভুনাথ বাবু পণের অর্থ ও গহনা দিতে স্বীকৃত ছিলেন। কিন্তু তিনি আপস করেন নি বিশ্বাসের সঙ্গে। শম্ভুনাথবাবুর উক্তি যদি রবীন্দ্রনাথের ব্যক্তিগত অনুভবের প্রকাশ হয়ে থাকে তাহলে এ কথাও বলতে হয় পণ দিতে রবীন্দ্রনাথও অস্বীকৃত নন। এটাকে আর দশটা সামাজিক প্রথার মতোই মেনে নিতেই হয় হয়তো। তবে আত্মমর্যাদা তো বিকিয়ে দিয়ে নয় এমনটাই টেক্সট আমাদের বলে।

অপরিচিতার আবির্ভাব গল্পে আরও অনেক পরে। অন্যদের বর্ণনায় আমাদের অপরিচিতাকে খুঁজে নিতে হয়। তৃতীয় পরিচ্ছেদে আমরা অপরিচিতার একটা যে আর্কিটাইপ (আদর্শরূপ) পাই অনুপমের কল্পনা শক্তিতে, তাতে কবিত্ব আছে তবে ভারতীয় নারীর আদর্শ গৃহবধূ হয়ে ওঠার স্বপ্নটা তাতে বাদ যায় না: ‘কপালে চন্দন আঁকা, গায়ে তার লাল শাড়ি, মুখে তার লজ্জার রক্তিমা…’। অনুপম অপরিচিতাকে না দেখেও কেবল বর্ণনা শুনে পরিতৃপ্তির সঙ্গে আরও বলছে, ‘মেয়েটির রূপ বড় আশ্চর্য…’। মনে মনে সে আশা করছে অনুপমকে না পেয়ে অপরিচিতার মনে যে প্রবল বেদনা উপস্থিত হবে: ‘ সে ভালো করিয়া খায় না; সন্ধ্যা হইয়া আসে চুল বাঁধিতে ভুলিয়া যায়। এমন দৃশ্য সহ্য করতে না পেরে ‘যে-বড়ো আদরের মেয়ের’ জন্যে শম্ভনাথ বাবু ‘অভিমান ভাসাইয়া দিয়া তিনি ছুটিয়া আসিলেন আমাদের দ্বারে।’ এতেও পতিগতপ্রাণা আদর্শ স্ত্রীর আর্কিটাইপটইা যেন ফুটে ওঠে।

চার

গল্পে অপরিচিতাকে প্রথম পাচ্ছি ট্রেনে। অনুপমের সঙ্গে সাক্ষাতে। এখন সে পরিচিতা হয়ে উঠেছে। একটা নামও পাচ্ছি, কল্যাণী। যে নারী কল্যাণ কামনা করে এমনতরো কোনো অর্থে নামটি গ্রহণ করা যায়। কার কল্যাণ সে বিষয়টা এবার দেখা যেতে পারে। কল্যাণের মধ্য দিয়েই তার আবির্ভাব ঘটছে। অনুপম আর অনুপমের মা ট্রেনে জায়গা পাচ্ছে না। তাদের ট্রেনে জায়গার ব্যবস্থা করছে কল্যাণী। সে সঙ্গে তাদেও মালামাল তোলার জন্যে কুলির ব্যবস্থাও। বয়সটাও পেয়ে যাচ্ছি ষোলো কি সতেরো। রবীন্দ্রনাথের আরেক গল্প ‘হৈমন্তী’র বয়সও ষোলোই ছিলো। দুজনেই মাতৃহারা, শিক্ষিত ও উদার পিতৃস্নেহে লালিত। সে জন্যে বয়সটা একটু বেশি তাদের বিয়ে দেবার জন্যে – রবীন্দ্রনাথ বলছেন। ভারতীয় সমাজে তখন ষোলো বছর বয়সী মেয়ের বিয়ে না হওয়াটা অনেকটা অপরাধ তুল্য বটে। এদের ক্ষেত্রেও তা-ই হয়েছে।

কল্যাণী সে ট্রেন যাত্রায় অনুপমকে আর একবার উদ্ধার করে। অনুপম ও তার মাকে ইংরেজ সাহেবের জন্যে সিট ছেড়ে দেবার নির্দেশ এলে কল্যাণী রুখে দাঁড়ায়। অনুপম যখন আমতা আমতা করতে থাকে তখন কল্যাণী ‘এ গাড়ি আগে হইতে রিজার্ভ করা, এ কথা মিথ্যা কথা ” – বলে নাম লেখা নিজের টিকেটটি ছুঁড়ে ফেলে দেয়। ঔপনিবেশিক বাস্তবতায় ইংরেজ স্টেশন মাস্টারের সামনে এমন প্রদর্শন দৃষ্টতা বটে কিন্তু আমরা গল্প পড়ছি। আমরা এও জানি, গল্প জীবনের চেয়ে রোমাঞ্চকর। রবীন্দ্রনাথ কল্যাণীকে এভাবেই দেখাতে চেয়েছেন। সাহস, সততা আর দৃঢ়তার প্রতিমূর্তি হিসেবে। এরপরই আমরা কল্যাণীর পরিচয় পাচ্ছি। অতিশয় কৃতজ্ঞ মা মেয়েটির নাম জানতে চাইলে সে বলে,“আমার নাম কল্যাণী। আর বাবার কথা সে বলে, “তাঁহার নাম শম্ভুনাথ সেন।” নাটকীয়ভাবে যাত্রার শেষ ভাগে আমরা কল্যাণীর সঙ্গে অনুপমের সাক্ষাৎপর্ব দেখতে পাই।

এ পরিচয় ও সাক্ষাৎ যতই নাটকীয় ও কল্যাণীর দৃঢ় ব্যক্তিত্ব প্রকাশের স্মারক চিহ্ন হয়ে থাকুক না কেন এটার মধ্য দিয়ে অনুপমের জন্য নতুন সম্ভাবনা খুঁজে পাই। অনুপম বলছে, ‘‘মামার নিষেধ অমান্য করিয়া, মাতৃ-আজ্ঞা ঠেলিয়া, তার পরে আমি কানপুরে আসিয়াছি। কল্যাণীর বাপ ও কল্যাণীর সহিত দেখা হইয়াছে। হাত জোড় করিয়াছি, মাথা হেঁট করিয়াছি; শম্ভুনাথবাবুর হৃদয় গলিয়াছে।’’ কল্যাণী বলে, “আমি বিবাহ করিব না।” কল্যাণীর এ দৃঢ়তা আমাদের বিস্মিত করে না। আত্মমর্যাদাবোধ সম্পন্ন নারী এ কাজটিই করবে। কিন্তু যে যুগে সে এ কাজ করে সে যুগটার জন্যে এটা বিস্ময়ের। তবুও এ প্রাণশক্তিটা কল্যাণী অর্জন করে দুটো জায়গা থেকে – এক. শিক্ষা থেকে। দেশব্রতের যে প্রতিজ্ঞা সে করে শিক্ষা তারই উপায় তাই সে নারীশিক্ষায় ব্রতি হয়। দুই. তার পিতা শম্ভুনাথবাবুর সাহচর্য। উদারনৈতিক ও আত্মমর্যাদাবোধ সম্পন্ন এ ডাক্তারের থেকেই সে দাঁড়াবার শক্তিটা পেয়েছে।

গল্পের শুরুতে যে মেয়েটির বিয়ের তোড়জোড় চলে সে মেয়েটি গল্পের শেষে নিজেই বিয়ের বিষয়ে আগ্রহ হারিয়ে ফেলে। এমন করে বিয়ে আর সংসারে আগ্রহ হারিয়ে ফেলেছিলো রোকেয়া সাখাওয়াত হোসেনের পদ্মরাগও। তার উক্তিটিও আমরা এখানে উদ্ধার করতে পারি। জীবন-অভিজ্ঞতা থেকে পদ্মরাগ বুঝেছিল (হোসেন, ১৯৯৩: ৪১৪) : “সংসারধর্ম আমার জন্য নহে। সেই যে সম্পত্তি না পাওয়ার জন্য পদাঘাতে বিতাড়িত হইয়াছিলাম, সে অবমাননা কি করিয়া ভুলিব? তাঁহারা আমার সম্পত্তি চাহিয়াছিলেন, – আমাকে চাহেন নাই। আমরা কী মাটির পুতুল যে, পুরুষ যখন ইচ্ছা প্রত্যাখ্যান করিবেন, আবার যখন ইচ্ছা গ্রহণ করিবেন?”

কল্যাণী অবশ্য পদ্মরাগের মতো তীব্রভাবে প্রতিবাদ করে নি। তার প্রতিবাদের ভাষাটাও রাবীন্দ্রিক, শান্ত, কোমল কিন্তু দৃঢ়তার সঙ্গে উচ্চারিত। বিয়ে সে কেন করতে অনাগ্রহী এ দিকটা দেখা যেতে পারে। কল্যাণীর ভাষায় ‘মাতৃ-আজ্ঞা” পালন করতে সে বিয়ে করতে অনাগ্রহী। সে আজ্ঞা আর কিছু নয়। দেশ-মাতৃকার সেবায় নিয়োজিত হওয়া। কিন্তু দেশকে মাতৃরূপে কল্পনা করে সে। পিতৃরূপে কল্পনা করা যেতো কি? আনন্দমঠ উপন্যাসে আমরা ‘বন্দেমাতরম’ গানের ব্যবহারে দেখি দেশকে মাতৃরূপে কল্পনা করা হয়েছিল। সে গানে বলা হয়েছে (চট্টোপাধ্যায়, ১৩৭৬ : ৭২৬) : “বন্দে মাতরম।/ সুজলাং সুফলাং মলয়জশীতলাং/ শস্যশ্যামলাং মাতরম।” রবীন্দ্রনাথ এ গানটি সুর করে প্রথম গেয়েছিলেন কংগ্রেসের অধিবেশনে ১৮৯৬ সালে। দেশকে মা হিসেবে কল্পনা করে সাহিত্যচর্চা প্রথাগত। সেটা কি এজন্যে যে মা সর্বংসহা! দেশও তাই। শত অপরাধ সত্ত্বেও মা সন্তানকে কোলে টেনে নেয়, দেশও তাই করে? তবু প্রথাগত ভাবনায় একটা কথা থেকেই যায়। দেশকে মা হিসেবে কল্পনা করে আসলে পুরুষতন্ত্র তার উপর মায়ের গুণারোপ করে তার যথেচ্ছ অপকর্মকেও জায়েয করে দেয়। অপ্রথাগতভাবে ভাবলে রবীন্দ্রনাথ এ ফাঁকটা ধরতে পারেন নি। যেমন করে আজও সে ফাঁকিটা চলছে। রবীন্দ্রনাথের আরেক নারী শেষের কবিতার লাবণ্যও অমিতকে বলেছিল, “মোর লাগি করিও না শোক/ আমার রয়েছে কর্ম, আমার রয়েছে বিশ্বলোক।” এসব মেয়ে কি শেষ পর্যন্ত বিয়ে নামক প্রতিষ্ঠানটাকে এড়াতে পেরেছে? না কি রবীন্দ্রনাথ নিজের জীবনেও এড়াতে পেরেছেন?

সংক্ষিপ্ত গ্রন্থপঞ্জি :

আনিসুজ্জামান, ‘“রবীন্দ্রনাথ”, পূর্বগামী। ঢাকা: শিখা প্রকাশনী, ২০০০।
বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়,। “আনন্দমঠ”, । বঙ্কিম রচনাবলি ১ম খ। ৫ম প্র.; কলিকাতা: সাহিত্য সংসদ, ১৩৭৬।
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর। “অপরিচিতা”, সাহিত্য পাঠ একাদশ-দ্বাদশ শ্রেণি। ড. ভীষ্মদেব চৌধুরী ও অন্যান্য (র. সং.)। পু.মু.; ঢাকা: জাতীয়শিক্ষাক্রম ও পাঠ্যপুস্তক বোর্ড, ২০১৬।
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর। রবীন্দ্রসমগ্র, খ- ১৬ । ঢাকা : পাঠক সমাবেশ, ২০১২।
হোসেন, রোকেয়া সাখাওয়াত। “পদ্মরাগ”। রোকেয়া রচনাবলী, আবদুল কাদিও (সম্পা.)। প্র.. পু.মু.; ঢাকা: বাংলা একাডেমী, ১৯৯৩।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *