September 20, 2024
কলামফিচার ৩

ব্যাঙ এর বয়ান: কুয়ো থেকে সমুদ্রে

অপর্ণা হাওলাদার ।। অভিবাসী জীবন নিয়ে কত লেখা চোখে পড়ে – মধুসূদনের কবিতা তো মুখস্থই করতে হয়েছিল স্কুলে। বাংলাদেশের মেয়েদের অভিবাসী জীবন নিয়ে যদি আমরা কয়জন লিখতে বসি, তবে বাড়ি ছাড়ার বিষণ্ণতার সাথে সাথে প্রকট হয়ে উঠে আসবে প্রথমবার আকাশের নিচে দাঁড়িয়ে স্বাধীনভাবে শ্বাস নিতে পারার অভিজ্ঞতা! দেশ ছেড়েছি ১১ বছর হয়ে গেল, স্বগতকথনের মত করে কিছু বলতে চাইছি – বিষণ্ণতার গল্প, বিস্ময়ের গল্প!

২০১১ সালের আগস্ট মাস – তখন আমি মাত্র “ফার্মের মুরগী” জীবন ছেড়ে কানাডায় মাস্টার্স করতে এসেছি – ব্রিটিশ কলাম্বিয়ার পাহাড়ের উপর একটা সুন্দর ক্যাম্পাসে – সাইমন ফ্রেজার ইউনিভার্সিটিতে। বাংলাদেশী মধ্যবিত্ত হিন্দু ঘরে কন্যাসন্তান হিসেবে বড় হওয়া মেয়েটি দেশের বাইরে একা পড়তে গেলে প্রথমে কী আবিষ্কার করে? লিখতেও লজ্জাই লাগছে, কিন্তু সত্য কথা হলো যে, পথেঘাটে অফিসে রাস্তায় হাঁটতে গেলে কেউ চোখে গিলতে থাকে না? বা, বাড়িতে কড়া সান্ধ্যআইন নেই, রাতের সৌন্দর্য চেয়ে চেয়ে দেখবার সময় না থাকলেও সামর্থ্য আছে? কিংবা, কোন পথে যাবো, কী করবো, কী সিদ্ধান্ত নেবো, তার প্রতিটা পদক্ষেপে অন্যের নির্দেশ মেনে নিতে হয় না? যেমন, কোথাও গিয়ে ডানে হাঁটবো না বামে হাঁটবো কিংবা আদৌ হাঁটবোই না – এর সবটাই সিদ্ধান্ত নেওয়ার পুরো স্বাধীনতা আমার।

এই যে কটা লাইন লিখলাম – এগুলো একটা পূর্ণবয়স্ক মানুষের সাধারণ অধিকার। বাংলাদেশের যেকোনো ছেলে এগুলো কিশোর বয়স থেকেই উপভোগ করে। আর আমরা বাকি অর্ধেক জনগোষ্ঠী কী পরবো – কিভাবে নিজেকে ঢেকে রাখবো যাতে নিরাপদ থাকি – এই ভাবনায় ঊনমানুষের মত জীবন কাটাই। ছুটির দিনে সন্ধ্যার দিকে ব্রিটিশ কলাম্বিয়ায় বার্নেবি পাহাড়ের নিচেই আমার ডাথির বাসার সামনে ফুটপাতে বসে বসে সূর্য ডোবা দেখতে দেখতে ভাবতাম এসব। রাস্তায় বুড়োবুড়ি অনেকে জগিং করতে করতে যায়, তাদের বেশ ফিট শরীর। তাদের ফিটনেসের দিকে আমি অবাক হয়ে তাকিয়ে থাকি, এতটা দৌড়ে দৌড়ে যাওয়া আমার দ্বারা হবে না। আমি শৈশব থেকে কোনোদিন খেলার মাঠে নামারই অনুমতি পাইনি। মাস্টার্সের ফান্ডিং খুব কম ছিল, আমি থাকতাম একটা ছোটো পাহাড়ের উপর বাড়ির বেইজমেন্টে। একটু টিলার মত জায়গাটা থেকে সূর্যাস্ত সূর্যোদয় খুব সুন্দর লাগতো। বাড়িটার বেসমেন্টের অবস্থা যাই হোক না কেন, যতই আলো-আঁধারি অবস্থা হোক; বাইরে এসে বসতে অদ্ভুত সুন্দর লাগতো।

বাংলাদেশের সব ছেলেদের দোষ দিতে চাওয়ার উদ্দেশ্য নেই আমার; তাদের তরফেও সামাজিক চাপ এবং বিষাক্ততার গল্প হয়তো আছে। কিন্তু বাংলাদেশে এক মুহূর্তের জন্য ক্লাসে, অফিসে, রাস্তায় কোথাও নিরাপদ বোধ করিনি – এমনকি আজো ঢাকায় গেলে ত্রাস ভর করে। আমি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়য়ে প্রথম ঢুকেছিলাম জার্নালিজম বিভাগে, পরে মাইগ্রেট করে ইকোনমিক্সে আসা। অর্থনীতিতে প্রথম যেদিন ক্লাস করতে গেলাম, পেছন থেকে পুরোটা ক্লাস একটি ছেলে বুলিয়িং করে গেল – “জার্নালিজম ছেড়ে এসে টিকবে কেমনে এই মেয়ে কে জানে”। ক্লাস থেকে বের হওয়ার পর বললো, “তোমরা ভিকারুননিসার মেয়েরা তো কঠিন মাল”। এই এক চক্রে আমার – আমাদের সম্পূর্ণ কৈশোর-তারুণ্য চলে গেলো, কিভাবে নিজেকে “ছেলেদের” চোখ-হাত-মুখ থেকে বাঁচিয়ে রাখবো! দেশের বাইরে এসে, একটা পুরো ভিন্ন পরিবেশে, দশটি অন্য দেশের ছেলেদের মধ্যে প্রথম আবিষ্কার করলাম, সারাদিন একত্রে কাজ করতে, পড়াশোনা নিয়ে বা অন্য যে কোনো কিছু নিয়ে আড্ডা দিতে ভাবতে হচ্ছে না। একটা স্বাভাবিক সুন্দর বন্ধুত্ব নিজে থেকে গড়ে উঠছে কেবলমাত্র সম্মান থাকার কারণে। বিপরীত জেন্ডারের সবার দিকে ভয়ার্ত হরিণশিশুর দৃষ্টিতে তাকানোর মত জীবন থেকে আস্তে আস্তে বের হতে শুরু করলাম – করতে করতেই মনে হলো, এত সাধারণ একটা ব্যাপার জানার জন্য সাড়ে আট হাজার মাইল পেরোনো দরকার হলো কেন?

প্রথম দুই সেমিস্টারের রোলারকোস্টারের পর সামার থেকে আমরা দল বেঁধে ঘুরতে শুরু করেছিলাম। মূলত বন্ধুরাই প্ল্যান করতো, আমি নীরব ফলোয়ার। হাইকিং-এ যেতাম, ঝর্ণা দেখা – সমুদ্র সৈকতে পিকনিক করা, ভিক্টোরিয়া ঘুরতে গেলাম। ঘুরে ঘুরে খাওয়া, ছবি তোলা, মজা করা – এই ব্যাপারগুলোই আমার জীবনে বেশ নতুন। হাইকিং আসলে তেমন ভালো পারতাম না কোনোদিনই। আবার আর্ট মিউজিয়াম, আদিবাসী সংস্কৃতির উপর মিউজিয়াম এগুলোও ঘোরা হতো। আমি সাইমন ফ্রেজারে বেশ কয়েকটি গ্রুপে যোগ দিয়েছিলাম – কমপেয়ারেটিভ রিলিজিয়ন, স্যোশাল অ্যাকটিভিটি গ্রুপ, একটি স্যোশালিস্ট গ্রুপ – এরকম অনেক অর্গানাইজেশনে যেতাম। আলোচনা করতাম, দেখতাম ওরা কী করে – বোঝার চেষ্টা করতাম। একটা গ্রুপ ছিল লেটার রাইটিং এর – জেলে আসামীদের সাথে চিঠি চালাচালি করতো, ওরা কিছু জানতে চাইলে উত্তর দিতো। এইসব অর্গানাইজেশন থেকেও অনেকটা শিখেছি আমি। আমার তখন হাভাতের দশা, এতদিন দম বন্ধ করে ঘরের ভেতর বসে থাকা থেকে হঠাৎ খোলা আকাশের নিচে এসে “লুটে খাই” অবস্থা।

শেষ কয়েক মাস আমি পিএইচডি অ্যাডমিশনের কাজ শেষ করার পর একাও ঘুরতাম ক্যামেরা নিয়ে। বিশেষ করে চায়না টাউন, মেইন স্ট্রিট, ঘুরে ঘুরে ম্যুরাল খুঁজে বের করা, স্যামন হ্যাচারি দেখা – এইসব করতাম। প্রতিদিন সকালে ব্যাকপ্যাকে কিছু খাবার প্যাক করে বের হয়ে যেতাম ক্যামেরা নিয়ে। বাসে চড়ে একেকদিন একেক দিকে চলে যাওয়া, সারাদিন হাঁটাহাঁটি করে রাতে ফেরা। ভ্যাংকুভার শহরটা বেশ পুরনো, আর চাইনিজ জাপানিজ অভিবাসীরা বেশ আগে থেকে এসেছে। তাই ঐতিহাসিক গুরুত্বপূর্ণ জায়গা অনেক।

এলোমেলো পথ চলতে গিয়েই, এই মাস্টার্সের কোনোদিনই হঠাৎ আবিষ্কার করলাম আমার কিছু বলার আছে, একটা নিজস্ব গল্প। ঢাকার রাস্তা, বরিশালের পুকুর কিংবা কানাডার পাহাড় – এইসব নিয়ে। আমার কিছু বলার আছে স্কুল, কলেজ, বিশ্ববিদ্যালয় নিয়ে। “মেয়েমানুষ” থেকে “মানুষ” হয়ে উঠতে চাওয়া নিয়ে। আমার শরীরের চেয়ে অনেক বড় এক আমি হয়ে উঠতে চাওয়া নিয়ে। আমার এইসব গল্পে কোনো মহৎ আত্মজীবনী নেই, এ আমাদের দেশের একটা যেকোনো মেয়ের নিজের পরিচয় তৈরি করতে চাওয়ার ইচ্ছার গল্প। সন্তর্পণে নিজের জন্য একটু পথ তৈরি করতে চাওয়ার গল্প।

এই গল্পটার পেছনে একটা কথা গুরুত্বপূর্ণ। আমি আমার প্রিভিলেজগুলো জানি ভালোভাবেই। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকের সন্তান হিসেবে বড় হওয়ার কারণে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় আমার পাঁচ বছরকে বিষাক্ত করে ফেললেও এই পরিচয়ের কিছু সুবিধাও আছে। আমি বড় হয়েছি আনিসুজ্জামান স্যারের বাসার উল্টাদিকে, আমার জানালা থেকে ওনার লাইব্রেরির জানালা দেখা যেতো। ক্যাম্পাসের এখনো কিছুটা টিকে থাকা সাংস্কৃতিক আবহাওয়ার কিছু ছাপ আমার পরিচয়েও পড়েছিল নিশ্চয়ই। এই আমিই যদি বরিশালে বড় হতাম, হয়তো মফস্বল শহরের পারিপার্শ্বিকতায় আমার পথ অনেক বেশি দুরূহ হতো। বরিশালে আমার পরিচিতদের মধ্যেই কেবল ছেলেকেই বরিশালের বাইরে পড়তে যেতে দেওয়া হয়, মেয়েদের বাধ্য করা হয় বরিশালে পড়তে যাতে বাড়িতেই থাকে আর অনার্স পড়তে পড়তেই বিয়ে দিয়ে দেওয়া যায়। “জেন্ডার” একা পার্থক্যগুলো তৈরি করে না, ইন্টারসেকশনগুলো বোঝা তাই জরুরি। জানি, আজও আমাদের বহু পথ চলা বাকি।

তবু এই পথ চলা শুরু হোক। আমার এই গল্পটা খুব সাধারণ, আমাদের অনেকের গল্প – তবে, “সাধারণ মেয়ে”র গল্প লিখতে রবীন্দ্রনাথের কবিতার মত আজকাল শরতচন্দ্রের পায়ে পড়তে হচ্ছে না। ব্যাঙ এর বয়ানেই হোক, তবু কুয়ো থেকে সমুদ্রে সাঁতরে টিকে থাকতে চাওয়ার গল্পটা আমাদের নিজেদের। “সাধারণ মেয়ে” গল্পের লেখক সাধারণ মেয়েরাই হোক!

[ফেমিনিস্ট ফ্যাক্টরে প্রকাশিত কলাম লেখকের নিজস্ব বক্তব্য]

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *