পৌনঃপুনিক [পর্ব – ০৫]
ফুলেশ্বরী প্রিয়নন্দিনী ।।
আম্মা কেন সেদিন না জানিয়ে নানুর বাড়ি গিয়েছিল তা জানা হয়নি আর। পরীক্ষাকেন্দ্র থেকে আব্বার সাথে নানু বাড়িতে পৌঁছেছিল ভ্যানে করে। আত্মীয়-স্বজন, পাড়া-প্রতিবেশিদের ভিড় ঠেলে রিমি কীভাবে যেন পৌঁছে গেল আম্মার কাছে। ওই তো উঠোনে, আম্মাকে শুইয়ে রাখা হয়েছে। মুখটা দেখে মনে হলো এতো শান্তির ঘুম আম্মাকে কোনোদিন ঘুমাতে দেখেনি। যে জগৎ সংসার আম্মাকে ছাড়া অন্ধকার বলে সংসার থেকে এক বেলা ছুটি আম্মা পায়নি, সে সংসারের মায়া ছেড়ে চলে গেল আম্মা – কাউকে সুযোগ দিলো না! আম্মার মুখে কী অদ্ভুত প্রশান্তি দেখেছিল রিমি সেদিন! সে প্রশান্তির আড়ালে কি সংসারের সব অবহেলার জবাব ছিল?
আম্মার ঠোঁটের কোণের মৃদু হাসিতে কি চারপাশের কৃতজ্ঞতাবোধহীন মানুষের প্রতি অবজ্ঞা লেগে ছিল? রিমির এগারো বছর বয়সে আম্মার চলে যাওয়াটা নির্দয় হলেও এখন মনে হয়, মরে গিয়ে আম্মা বেঁচে গেছে। বছর জুড়ে শ্বশুরালয়ের আত্মীয়স্বজনের নিত্য মেহমানদারি আর হাঁড়িঠেলা তার জীবনের অংশ হয়ে দাঁড়িয়েছিল। ছেলেমেয়ে মানুষ করা আর পরিবারের তাবৎ প্রাণীকূলের আরামআয়েশ নিশ্চিত করার দায়িত্ব পালনের পর দিনশেষে তার নিজের জীবন বলে কিছু ছিল না। পঞ্চব্যঞ্জনে উদরপূর্তি করা বাড়ির অন্য সদস্যদের কারো খেয়াল থাকতো না যে, সবার শেষে আম্মা হাঁড়ি-কড়াইয়ের তলানিতে পড়ে থাকা তরকারি মুছে, ডাল আর মরিচ ডলে নিজের ভাতটুকু খেতো। আম্মার পাতে ভালোবেসে কেউ এক টুকরো বড় মাছ তুলে দিয়েছে, মুরগির রানের পিস তুলে দিয়েছে এমন দৃশ্য মনে পড়ে না। আম্মার কোনো বিশ্রাম ছিল না। আম্মার কোনো অভিযোগ ছিল না, আব্বার বাড়ির লোকেদেরও কোনো বিবেক ছিল না। এসব ভাবলে আব্বার প্রতি প্রচন্ড রাগ হয় রিমির। আব্বা এতোটা নিপাট ভালো মানুষ না হলেও পারতো! তার জীবনসঙ্গীর প্রতি তার বাড়ির লোকেরা অন্যায় করে গেছে দিনের পর দিন অথচ আব্বা কোনোদিন মুখ ফুটে প্রতিবাদ করতে পারেনি। আব্বা আম্মাকে ভালোবাসতো হয়তো কিন্তু অনেকটাই উদাসীন ছিল সংসারের প্রতি। যে ভালোমানুষি পাশের মানুষের প্রতি অন্যায় হওয়াকে দিনের পর দিন মেনে নেয়, সেই ভালোমানুষি আদতে কোনো কাজে আসে না। অশান্তির ভয়ে সব মেনে নেবার মানসিকতা দুর্বলচিত্তের লক্ষণ। আব্বা আসলে তেমন দুর্বলচিত্তেরই মানুষ। আম্মা চলে যাওয়ার কিছুদিন আগে নিজের ভগ্নিপতিকে ব্যবসার জন্য টাকা ধার দিয়ে আব্বা বড় ধরনের আর্থিক ক্ষতিতে পড়েছিলেন। সেই লোক মফস্বলে নিজের জমিতে পাকা দালান উঠিয়ে টাকা ফেরত দেয়া দূরে থাক, আব্বা-আম্মাকে আর চেনেই না! উল্টো আত্মীয়স্বজনের কাছে আব্বা-আম্মার নামে কুকথা রটিয়ে বেড়ায়। এদিকে আব্বা ঋণে পড়ে যায়। তিন মাসের বাড়িভাড়া বাকি পড়ে। বাড়িওয়ালা চাচা সকাল-বিকাল ভাড়ার পাওনা টাকার জন্য তাগাদা দিতে আসে। আব্বা ইচ্ছে করেই অনেক রাত করে বাড়ি ফেরা শুরু করলো। একদিন সন্ধ্যায় আব্বা বাড়িতে ছিল না, বাড়িওয়ালা চাচা দরজায় দাঁড়িয়ে আম্মাকে কী সব যেন বলে চলে গেলেন। আম্মা মাথা নিচু করে সেই অপমান হজম করলেন।
রিমির ধারণা আম্মা সেদিন বাপের বাড়িতে টাকার সন্ধানে গিয়েছিল। সেবারে অভাব চলছিল দীর্ঘ সময় ধরে। আম্মার ক্ষুদ্র সঞ্চয় ফুরিয়ে আসছিল। রিমির পরীক্ষার আগে আম্মা তার জমানো টাকা দিয়ে ভালোমন্দ বাজার করেছিল। বাড়িঘরে অভাব দেখা দিলে আম্মা সংসার খরচ থেকে বাঁচিয়ে নিজের সামান্য সঞ্চয় থেকে টাকা ভাঙতো। সুলেখা জুয়েলার্সে গিয়ে কানের কানপাশা বিক্রি কিরে আব্বাকে টাকা দিয়েছিল একবার। রিমিকে বলেছিল, “এসব কথা ভুলেও যেন নানুবাড়িতে গিয়ে বলবে না, কেমন?” বিপদের সময়গুলোতে সুখের পায়রার মতো আত্মীয়-স্বজনেরা কোথায় যে উড়ে যেতো!
আব্বা নেশা করতো না, টাকার জন্য আম্মাকে জোরাজুরি করতো তাও না। কিন্তু অসম্ভব বোকা মানুষ ছিল, যতোটা বোকা হলে পৃথিবীর সাথে তাল মিলিয়ে চলা দুষ্কর হয়ে পড়ে।
[চলবে]
ফুলেশ্বরী প্রিয়নন্দিনী : সমাজবিজ্ঞানে স্নাতক সাবেক ব্যাংক কর্মকর্তা। এই মুহূর্তে শিল্পকর্ম এবং স্বাধীন লেখালিখিতে ডুবে থাকাতেই স্বচ্ছন্দ। মিশ্র মাধ্যমে শিল্পকর্মের বিষয় হিসেবে জানালার গল্পের আড়ালে আসলে ফেলে আসা সময়, স্মৃতির সঞ্চয় অথবা জীবনের কোনো চেনা গল্প রয়ে যায়। জীবনের ক্ষুদ্র অভিজ্ঞতায় নানা ঘাতপ্রতিঘাত পেরিয়ে যে বিষয়গুলো বিশেষভাবে ভাবায় : নারী – পুরুষের সমতা, সম্পর্কের টানাপোড়ন ও জটিলতা। পারিবারিক – সামাজিক নির্যাতন ও বৈষম্য। শিশুর নিরাপত্তা এবং সর্বোপরি, ১৯৭১ সালের মহান মুক্তিযুদ্ধে আড়াই লক্ষাধিক বীরাঙ্গনা মুক্তিযোদ্ধাদের যুদ্ধ ও যুদ্ধ পরবর্তী জীবন সংগ্রামের ইতিহাস।