November 22, 2024
ফিচার ৩মুক্তমত

নারীর লড়াই আপনাদের ব্যবসার পণ্য না

প্রিয়া দেব ।। আজকের বাংলাদেশে দাঁড়িয়ে একটা পরিবারের চিত্র ভাবুন যেখানে স্বামী এবং স্ত্রী দুইজনেই কর্মজীবী। সেখানে কয়েকটা সাধারণ ঘটনা হলো, সারাদিন চাকরি করে এসে পুরুষটি বিশ্রাম করতে বসেন এবং স্ত্রী যথানিয়মে ঘরে ফিরেই রান্নাঘরে ঢোকেন, কারণ সমাজের প্রচলিত নিয়মে রান্না করার দায়টা একমাত্র নারীর।

এই সমাজে কর্মজীবী নারীর স্বামীটি কিংবা শ্বশুরবাড়ির লোকেরা এমনভাবে বড় গলায় বলেন “আমি আমার স্ত্রীকে/বৌকে চাকরি করতে দেই” যেন এই নারীটি তাদের সম্পত্তি, এবং এই সম্পত্তিটিকে চাকরি করতে দিয়ে উনারা বিরাট মহান হবার কাজ করছেন। এদের মাথায় একবারো কাজ করেনা এই নারীটি একজন আলাদা ব্যক্তিত্বের মানুষ যার কিনা নিজের সিদ্ধান্ত নিজে নেওয়ার পর্যাপ্ত সক্ষমতা রয়েছে। এবং এই সমাজে নারীদের জন্য সবচেয়ে সমস্যাযুক্ত একটা চিত্র হচ্ছে “আমি নারী আমি সব পারি” এই লাইনের গর্বিত ব্যবহার। এই লাইন খুবই সতর্কতার সাথে নারীর মাথায় এমনভাবে ঢুকানো হয়েছে যেনো সবকিছু পারার মধ্যেই নারীর সকল সফলতা। এবং এ লাইনের জন্যই এই সমাজে একজন নারীকে চাকরি করতে গেলে ঘর সামলানোর শতভাগ দায় নিতে হয় আগে, এই লাইনের জন্যই অসংখ্য নারীকে শুনতে হয় “অমুকের বউ তো ঘর সংসার সব সামলিয়ে কাজ করতে পারছে, তুমি কেনো পারবে না?”। যেন এই সব পারার দায় একমাত্র নারীরই!

এই সমাজ কখনো একজন পুরুষকে বলেনি যে চাকরি করতে হলে সংসারও সমানভাবে সামলাতে হবে। একজন পুরুষ এ সমাজে কখনোই কর্মক্ষেত্র থেকে ফিরে নারীর সাথে সাথে গিয়ে রান্নাঘরে গরমের মধ্যে রান্না করতে বসে যান না। কারণ সমাজ সেট করেই দিয়েছে এইসব কাজ শুধু নারীর, এবং নারীকে যদি সংসারের বাইরে কাজ করে সফল হতেই হয় তবে সমাজের সকল নিয়ম মেনেই হতে হবে, নাহলে ওই নারীকে সমাজ সফল হিসেবে তার চোখে ধরবেই না।

যে মেয়েটা নিজের ক্যারিয়ার গড়বে বলে সংসার করতে চায় না, ওই মেয়ে সমাজের চোখে উচ্ছন্নে যাওয়া নষ্ট মেয়ে, যে মেয়ে সব পারার দায় কাঁধে নিতে চায়নি সেই মেয়েকে ব্যর্থ স্ত্রী, ব্যর্থ মায়ের তকমা দিয়েছে সমাজ। অনেক বাচ্চাদেরও আক্ষেপ থাকে তাদের মা চাকরি করেন তাই তাদের সময় দেয়নি বলে। আমি কখনো ওইসব সন্তানদের দেখিনি নিজের বাবার প্রতি সমান আক্ষেপ দেখাতে, যেন সন্তানকে সময় দেওয়ার দায়টা শুধু মায়েরই ছিল, দোষটা শুধু মায়েরই। ওইসব সন্তানেরা নিজের বাবাকে কখনোই আক্ষেপের তালিকার ভেতরে রাখেননি। কারণ ওই যে, দিনশেষে একজন নারী যে আলাদা একটা মানুষ, তার যে আলাদা চাওয়া পাওয়া আছে, সেই চিন্তায় কখনো কেউ যায়নি।

এত প্রতিকূল পরিবেশে একজন নারী যখন উঠে দাঁড়ানোর চেষ্টা করছে তখন এই সমাজেরই চিন্তা ধারণ করা কর্পোরেট প্রতিষ্ঠানেরা নারী দিবসে একদিনের জন্য লিবারেল সাজার চেষ্টা করতে গিয়ে একটা বিজ্ঞাপন দিয়েছেন। বিজ্ঞাপনে সফল নারীর সংজ্ঞা দিয়েছেন এমন একজন নারীকে দেখিয়ে যে নারী দাবি করছেন তিনি ঘর সামলিয়ে ব্যবসায় সফল হয়েছেন।

গ্রামীনফোনের উদ্দেশ্যে বলতে চাই, একজন নারী ঘর সামলিয়ে ব্যবসা করার বার্ডেন নেবেন কি নেবেন না ওইটা তার ব্যক্তিগত ব্যাপার, কিন্তু ওই নারীকে দিয়ে সকল নারীর সফলতা মানেই ঘর সামলানো এমন বার্তা সমাজের উদ্দেশ্যে আপনারা কখনোই দিতে পারেন না। কোনো নারীর চয়েস নাই হতে পারে এই সব পারার দায় না নেওয়ার, কোনো নারী উঠে বলতেই পারেন এই ঘর সংসার আমি একা সামলাবো না, এইখানে এই নারীদের চাওয়ায় বিন্দুমাত্র ভুলের কিছু নেই। বরং আপনাদের সফলতার সংজ্ঞায়নে বিরাট বড় ভুল আছে।

নারী দিবসকে সামনে রেখে যে বিজ্ঞাপন আপনারা বানিয়েছেন, এতে নারীর লড়াইয়ের পথকে আপনারা আরো কঠিন করে দিয়েছেন। গ্রামীণফোন আপনারা জানেন না এই ঢাকা শহরেই হাজার হাজার গৃহকর্মী আছেন, যারা সারাদিন অমানবিক পরিশ্রম করার পরও রাতে ঘরে ফিরে ঠিকমতো স্বামীকে রান্না করে দিতে না পারলে শারীরিক নির্যাতনের শিকার হন, ওই স্বামী পুরুষটি নিজে কখনো রান্না করেন না। কারণ ওই যে সংসার সামলানোর দায়টা একা নারীর। গ্রামীণফোন আপনারা জানেন না এই দেশে শিক্ষিত চাকরীজীবী মহিলাদের সন্তানদের একটু সমস্যা হলেই আঙুল উঠে মায়ের চাকরীর উপর, সবাই বলে মা চাকরি করে বলেই সন্তানের অবস্থা এমন, এই সমাজ কখনোই চাকরিজীবী বাবার দিকে আঙুল তুলে বলে না দোষটা সমানভাবে বাবারও। এবং গ্রামীণফোন আপনারা জানেন না, আপনাদের এইসব সস্তা স্ট্যান্ডের জন্য আমাদের মতো মেয়েদের এই সমাজ আরো চেপে ধরে বলে চাকরি করতে চাইলে সংসারকে নিঁখুতভাবে সামলিয়ে তবেই করতে হবে, নাহলে চাকরি করার কোনো দরকার নেই।

এজন্য গ্রামীণফোন আপনারা বরং এবার সস্তা বিজ্ঞাপনে এইসব অগভীর চিন্তার বুলি না আওড়িয়ে নিজেদের চিন্তাকে নিয়ে লজ্জিত হোন, নিজেরা ক্ষমা চান এই দেশের সকল নারীর কাছে। নারী আপনাদের ব্যবসার পণ্য না, নারীদের লড়াইকে নিজেদের চিন্তার সীমাবদ্ধতা দিয়ে ছোট করার প্রয়াসের জন্য আপনাদের সত্যিই এবার লজ্জিত হওয়া উচিত। মাথায় রাখবেন নারীদের লড়াইয়ের পথ কঠিন করার পেছনে আপনাদের যে একটা বিরাট দায় রয়েছে এই জিনিস আমার মতো নারীরা সবসময় মনে রাখবে।

 

[ফেমিনিস্ট ফ্যাক্টরে প্রকাশিত মুক্তমত লেখকের নিজস্ব বক্তব্য]

 

 

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *