ব্যক্তিপুরুষ বনাম পুরুষতন্ত্র
কানিজ ফাতেমা তনিমা ।। “সব পুরুষই কি খারাপ নাকি? এক নারীই তো আরেক নারীর শত্রু।আর এসব বিষয়ে লিখে কী-ই বা হবে?” – এই বাক্যগুলো খুবই পরিচিত।
আমার মনে হয় “নারী” শব্দটাকেই এখন পর্যন্ত আমরা ঠিকমতো গ্রহণ করতে পারি নি। তাই হয়তো নারী সম্পর্কিত যেকোনো কিছুতেই একটা নিষিদ্ধ ভাব বের হয়ে আসে। নারীর অধিকার, সংগ্রাম এবং স্বাধীনতা নিয়ে কথা বলাদের’কে একরকম পৃথক করে দেওয়া হয়; কেমন যেন একটা বিদ্রূপ, ঠাট্টা, তামাশার চোখে দেখা হয়। আমি জানি নারীবাদ নিয়ে লেখালেখি এই দেশে অনেকটাই কঠিন কিন্তু এই কাজটা আরও কঠিন হয়ে পড়ে যখন বন্ধুবান্ধব থেকে শুরু করে বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক পর্যন্ত তার দিকে বিদ্রুপের দৃষ্টিতে তাকান কেবল ভিন্নমত প্রকাশ এবং চিন্তাচেতনা ধারণ করার জন্য।
বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ুয়া নিজের পছন্দমতো শার্ট এবং জিন্স পরা মেয়েটাও যখন বলে- ‘‘তুই তো আবার নারীবাদী!’’ – তখন বড্ড হাসি পায়। নারীবাদী আন্দোলন এদের জন্য যা এনে দেয়, এরা তার সুবিধা নিতে নিতেই পুরুষতন্ত্রের মন্ত্র জাপে। এরা আদৌ নারীবাদ কী তা জানে কিনা আমার সন্দেহ। কারণ নারীবাদ সম্পর্কে স্বচ্ছ ধারণা থাকলে প্রতিটা মানুষেরই নারীবাদী হওয়ার কথা। সম্ভবত স্বচ্ছ ধারণা না থাকার কারণেই এদের এত ইচিং এই শব্দটার সাথে।
আমাদের দেশে ভিন্ন মত,চিন্তা, চেতনার সর্বোপরি ভিন্ন কারো চালচলনকে একেবারেই নিতে পারে না মানুষ। আমাদের সমস্যাটা মূলত এখানটাতেই।
পৃথিবীতে সব ধরনের লোক আছে – এই সাধারণ সত্য যারা মানতে নারাজ তারা আসলে প্রচন্ড রকমের অসভ্যের কাতারে পরে বলে আমার ধারণা, তাদের পরিবারিক শিক্ষা নিয়ে আমার মনে প্রশ্ন জাগে বারবার। পারিবারিক এই কুশিক্ষার শেকড় অনেক গভীরে।
নিজের মত আরেকজনের ওপর চাপিয়ে দেওয়া, আরেকজনকে নিজের মতো করে তৈরি করতে চাওয়া – এই যে একটা কুশিক্ষা, এটা তাদের পরিবার থেকেই অনুশীলন করা।
আমরা বলি নারীর প্রতি দৃষ্টিভঙ্গি বদলাতে প্রয়োজন শিক্ষার, আমরা মূলত ভুল বলি। পকেট ভর্তি টাকা দিয়ে মাথাভর্তি বিদ্যা অর্জন করলেই যে শিক্ষা অর্জন হয় সেই শিক্ষা নারীর প্রতি দৃষ্টিভঙ্গি বদল করতে খুব যে বিশেষ ভূমিকা রাখে তা আমার মনে হয় না। এই মাথাভর্তি বিদ্যা ধারণ করা বহু লোককে বলতে শুনেছি একজন কর্মজীবী নারী নাকি কখনোই ভালো মা হতে পারেন না। কষ্ট হয় যখন কোনো তথাকথিত শিক্ষিত মানুষের কাছ থেকে এমনটি শুনতে হয়।
আইনস্টাইনের একটি বিখ্যাত উক্তি আছে – “স্কুলে যা পড়ানো হয় তার সবটুকু ভুলে যাবার পরেও যা রয়ে যায়, তাই হলো শিক্ষা।” এই সময়ে এসে আমার মনে হয় না স্কুলে যা পড়ানো হয় তা ভুলে গেলে এখনকার তথাকথিত বেশিরভাগ শিক্ষিত মানুষের মাঝে কিছু অবশিষ্ট থাকবে।
যারা প্রশ্ন করে – এইসব লিখে কী হবে? তারা আসলে ঠিকই বলে।
সত্যি তো! যে সমাজে পুরুষতন্ত্রের সমালোচনায় সমগ্র জাতি বেদনা অনুভব করে; নারীবাদী শুনলে ভ্রু কুঁচকে তাকায়; বাঁকা হাসি হাসে; মস্তিষ্কবিহীন, মেরুদণ্ডহীন হয়েও একটা ভিত্তিহীন যুক্তি নিয়ে লড়াই করবার মতো ক্ষমতা যে জাতির আছে সেখানে বসে খুব যে বড় কিছুর আশায় দু’কলম লেখা, তা কিন্তু নয়।
তবে, কেন লিখছি? কেন লিখবো?
কারণ এই যে, আজ আমি লিখছি, নিজের কথা বলতে পারছি তার কারণ একসময় কোনো নারী কলমের ডগাতেই প্রথম তুলে এনেছিলেন তাদের অধিকার, আন্দোলন, সংগ্রাম এবং বিপ্লবকে।তখন “মেয়েদের লড়াই” শব্দটি এখনকার মতো জলে ভেজা পাউরুটি হয়ে ওঠে নি। নারী মানে তখন ছিল কেবল যৌনতার প্রতীক, সন্তান উৎপাদনের যন্ত্র এবং ভোগ্য বস্তু। এখন অনেকখানিই পরিবর্তন এসেছে, হয়তো পুরোপুরি উপসংহারে পৌঁছতে এখনও অনেক পথ বাকি। তবে পরিবর্তন কিন্তু এসেছে।
নারীর অধিকার, নারীর সংগ্রাম, নারীর লড়াই এসব কল্পনা করবার মতো স্পর্ধাও যখন কোনো নারীর ছিল না, তখন গুটিকয়েক নারী যারা তাদের কলমের ডগাতেই তুলে এনেছিলেন নিয়ম ভাঙার স্পর্ধা। সেই স্পর্ধাই বারবার মনে করিয়ে দেয় কলমের ক্ষমতা। আর এই ক্ষমতাই আশা জাগায় কিছুটা। তাই বারবার প্রতিবাদ লিখবো, প্রতিবাদ আঁকবো।
সব পুরুষেরাই খারাপ?
যারা এই প্রশ্নটা করে তারা আসলে ব্যক্তিপুরুষ এবং পুরুষতন্ত্র এক করে ফেলে। পুরুষতন্ত্রের বিরোধিতাকে তারা পুরুষবিদ্বেষ বলে মনে করে। তাই পুরুষতন্ত্র কিংবা পিতৃতান্ত্রিক কাঠামোর সমালোচনায় তাদের গায়ে ফোস্কা পড়ে।
যে গেঁড়ে বসা কাঠামো নারী পুরুষের সম্পর্ককে এখনো বাঘ আর হরিণের সম্পর্ক মনে করে। যেখানে নারী পুরুষ উভয়ের মাথায় ঢুকিয়ে দেওয়া হয় বাঘ- ভাল্লুক, সিংহের চাইতেও পুরুষ ভয়ংকর।
যে কাঠামো নারীকে বারবার জানান দেয় নারী একটু কম মানুষ বা ঊনমানব। আর পুরুষ বোধহয় মানুষ ছাড়িয়ে তারও একটু উপরে।
পুরুষমানুষ কাঁদে না; ব্যথা পায় না; পুরুষ মানুষের হারতে নেই; পুরুষকে সব পারতেই হবে। এই যে পুরুষকে পুরুষ যা কিছু তার চাইতে একটু ওপরের স্তরে ফেলে দেওয়ার মানসিকতার কাঠামো, সেটাই হচ্ছে পুরুষতন্ত্রের ফাঁদ। এই ফাঁদের শিকার পুরুষ নিজেও।
কিন্তু পুরুষ এই প্রতিটা ফাঁদকে পৌরুষত্ব জেনে বড় হয়ে এসছে। তাই তারও যে ব্যথা হয়, সেও যে কাঁদতে পারে, সেও যে মানুষ তা একরকম ভুলে থেকে তথাকথিত পৌরুষত্ব বজায় রাখে। এই তথাকথিত পৌরুষত্ব বজায় রাখতে রাখতে তারা আসলে পুরুষ স্তর অতিক্রম করে মানুষ অব্দি আসতে ভুলে যান।
আর আমরা যাদের তথাকথিত প্রগতিশীল বলে জানি, যে সকল পুরুষ নারীদের পাশে থাকার ভান করে, নারীবাদের সুরে তাল মেলায়, বোঝাতে চায় তারা পিতৃতান্ত্রিক কাঠামোর বিপরীতে তাদের মধ্যেও অনেকে ভেতরে ভেতরে ভীষণ রকমের পুরুষতান্ত্রিক চিন্তা চেতনা ধারন করে; উপরে কেবল প্রগতিশীলতার মুখোশ পরা এই লোকগুলো মূলত স্বার্থান্ধ, ধান্ধাবাজ। একবার স্বার্থে ধাক্কা লাগলেই তাদের মুখোশ খুলে পরবে।
মেয়েরাই মেয়েদের সমালোচক – একবাক্যে যদি বলি “নারীই নারী শত্রু” – এটা বর্তমানে বহুল প্রচলিত একটা বাক্য। কিন্তু আসলেই কি তাই? নারী যে নারীর সমালোচনা করে, ভেতরে ভেতরে যে নারীবিদ্বেষী একটা ভাব পোষণ করে সেটার গোঁড়ায় কি পুরুষতন্ত্র নাই? নারীর বিরুদ্ধে নারীকে লেলিয়ে দেওয়া কি পুরুষতন্ত্রের সবচেয়ে ধারালো অস্ত্র না?
চিন্তার শেকড়ে পুরুষতন্ত্রের বীজ বপন করা একজন নারী যখন আরেক নারীকে নিয়ে বিরূপ মন্তব্য করে, হাবিজাবি বলে, দমিয়ে রাখবার চেষ্টা করে, তখন সেটাকে আসলে শত্রুতা নয় আমি বলবো পুরুষতন্ত্রের তাবেদারি।
পুরুষতন্ত্রের তাবেদার নারী পুরুষ উভয়ই হতে পারে। পুরুষ মাত্রই পুরুষতান্ত্রিক নয়। বরং পুরুষের চাইতেও পুরুষতন্ত্রের মন্ত্রে মগজ ধোলাই হওয়া নারী অনেক বেশি পুরুষতান্ত্রিক হতে পারেন। পিতৃতান্ত্রিক কাঠামো নারী, পুরুষ উভয়কেই তার এঁকে দেওয়া ছকে এভাবেই দেখতে চান। এতে করে এই কাঠামোর স্বার্থ হাসিলের পথ অনেকটাই সহজ হয়।
[ফেমিনিস্ট ফ্যাক্টরে প্রকাশিত মুক্তমত লেখকের নিজস্ব বক্তব্য]