December 23, 2024
ফিচার ২মুক্তমত

পুরুষের বন্ধুত্ব নারীর শরীরে গিয়ে গড়ায়

মিলি ইসলাম ।। নারী পুরুষের বন্ধুত্ব নিয়ে কথা বলতে গেলে সহজ বাংলায় আমি আমার দৃষ্টিভঙ্গিতে বলবো, নারী পুরুষের বন্ধুত্ব হয় না।

তবে যেকোনো বিষয়ে দ্বিমত চিরকাল থাকবেই। কিন্তু কেন নারী পুরুষে বন্ধুত্ব হয় না, সে নিয়ে যদি আমি আমার বাস্তব উপলব্ধি বলি, তবে বলতে পারি এর অজস্র কারণ রয়েছে। একটা সময় আমিও ভীষণভাবে বিশ্বাস করতে চেয়েছি নারী পুরুষে বন্ধুত্ব হয়, কিন্তু বাস্তবতার মুখোমুখি হয়ে দেখেছি, আমাদের কাছের বন্ধু, অফিস কলিগ, কিংবা যদি ছেলেবেলার বন্ধুও যদি বলি, আমাদের পুরুষ বন্ধুটি কেন জানি আর বন্ধু হয়ে থাকতে পারে না। পুরুষ বন্ধুটি পুরুষত্বের কাছে হেরে যায়। বন্ধুর মানে তো যাকে বিশ্বাস এবং ভরসা করা যায়,  কিন্তু পুরুষের বন্ধুত্ব নারীর সাথে শরীরে গিয়ে গড়ায়।

পুরুষতন্ত্রের কাছে হেরে যায় আমাদের অসংখ্য পুরুষ বন্ধু,  অসহায় মুহুর্তে যে বন্ধুটিকে ভরসা ভেবে হাত বাড়িয়ে চাইবেন, সেও একদিন সময়ে অসময়ে প্রেম নিবেদন করে বসে। আধুনিকতার নামে এখনকার পুরুষ বন্ধুরা বরং হয়েছে আরো উন্নত, প্রেম নয় তারা বরং শয্যাসঙ্গী হতেই বেশি স্বাচ্ছন্দ্য বোধ করে। হতেই পারে কেউ কারো সঙ্গে অন্তরঙ্গ, কিন্তু সেখানে মেয়েটির মত আছে কি না, সে বিষয়ে পুরুষ ভ্রুক্ষেপহীন। যেন তাদের চাই, এবার দিতেই হবে, পেতেই হবে।

একটা সত্যি ঘটনা বলি। আমার ছেলেবেলাকার বন্ধু, দীর্ঘ ২২ বছর একসঙ্গে বড় হয়ে ওঠা, বন্ধুটি চলে গেল দেশের বাইরে,  মাঝখানে ২/১ বছর ছিল না যোগাযোগ, যাকে কোনোদিন বন্ধু ব্যাতীত ভাবিনি কিছুই,  একদিন সেই বন্ধুটি বন্ধুত্ব নয়, প্রেম নয়, দিয়ে বসলো শারীরিক সম্পর্কের প্রস্তাব। প্রচন্ড অবাক হলাম, রইল না বন্ধুত্বটা।

কাজ করতে গিয়ে যতটা ভদ্র আচরণে ফ্রেন্ডলি হয়ে মিশেছি সবার সাথে,  ততটাই তারা ভেবে নেয় মেয়েটা সহজ, চাইলেই পাওয়া যায়। তবে বন্ধুত্বটা করবো কোন পুরুষের সঙ্গে?

এক সময় মনে হলো আর কোনো পুরুষ বন্ধু নয়, কিংবা কোনো বন্ধু নয়, একাই থাকি, একাই বাঁচি। ধীরে ধীরে ফ্রাস্ট্রেশনে ভুগছিলাম, কেন এমন হয়, কেন সব পুরুষ যৌনতায় গিয়ে ঠেকে যায়! মনে হতো ঘর থেকে বের হবো না, করবো না কোনো অফলাইন জব, শুধু পুরুষ থেকে বাঁচতে।

করলামও ঠিক তাই,  যে ছেলেটা বয়সে ৭/৮ বছরে ছোট, সেও দেখি থাকে না তার সীমানায়, সম্মানে, যে পুরুষটা বাবার বয়সী সেও তার সীমা অতিক্রম করে। যে বন্ধুটাকে খুব আপন মনে করি,একা থাকায় হাজার সমস্যার মুখোমুখি হয়ে যদি বন্ধুত্বের আবদারে চাই – দোস্ত একটু ডাক্তারের কাছে যাব, সঙ্গে যাবি চল, সে বন্ধুটাও অসুস্থ অবস্থায় দেখেও হাত অন্য স্পর্শে ছুঁতে চায়। আর প্রতিবাদ করলে দিন শেষে মন্দ হতে হয় নারীদের।

কেউ কেউ বলবে ‘‘মেয়েদের কিসের এতো ছেলে বন্ধু থাকবে!’’ যদি কোনো অঘটন ঘটে তবে আর অপেক্ষা রাখে না সব দোষ একটা মেয়ের ঘাড়ে চাপাতে – ‘‘অমন শ’খানেক ছেলে বন্ধু থাকলে এমন তো হবেই’’।

একটা শ্রেণির ধারণা তো আছেই, পুরুষের সঙ্গে ওঠা বসা করা মানেই মেয়েটা খারাপ। এই পুরুষতন্ত্র বিশাল একটা অংশের নারীদের রেখেছে অন্ধকারে, রেখেছে ঘর বন্দি করে, তাই সহজ করে সেই সংখ্যার নারীরাই হয়ে উঠতে পারে না উন্নত মানসিকতা অধিকারী, বাঁচতে পারেনা সহজ করে।

পুরুষকে বন্ধু হিসেবে ভাবা তো কোনো অপরাধ নয়, অন্যায় নয়, কিন্তু পুরুষ পারে নি তার সীমানায় স্থির হয়ে থাকতে। একটা মেয়েকে শুধুমাত্র মানুষ, শুধুমাত্র একজন বন্ধু হিসেবে ভাবতে পারে না, পারে না ভিতরের কাপুরুষকে নিয়ন্ত্রণে রাখতে। তখন পুরুষ নামে বন্ধুটি আর বন্ধু থাকে না।

এখনো আমরা অতটা উন্নত চিন্তার মানুষ হয়ে উঠতে পারি নি, এখনো একটা মেয়ের ‘না’ মানে না, বন্ধু মানে শুধুই বন্ধু মেনে নেওয়ার মতো মানসিকতা এদেশের অধিকাংশ পুরুষের হয়নি বলেই এতো জটিলতার সৃষ্টি।

পুরুষের ভিতরের ভাবনাটা যেদিন শুদ্ধ হবে, পুরুষ যেদিন পুরুষ থেকে মানুষ হয়ে উঠবে, হয়তো সেদিন পুরুষ আদর্শ বন্ধু হয়েও উঠবে।

নারী পুরুষের সম্মতিতে বন্ধুত্ব থেকে প্রেমে গড়ালে অসুবিধে ছিল না, কিন্তু গন্ডায় গন্ডায় প্রেম তো হয়না; বন্ধু তো হয়, হতেই পারে, হতে পারে  সুসম্পর্ক, গোবর মস্তিষ্কে তারা ধারণ করে স্বাধীন নারী মানেই সব কিছু স্বাধীনভাবে চাইতে পারে, চাইতেই পারে বন্ধুত্বের নামে শরীর – সমস্যা তো এখানেই।  রাজী না হলে সেই সুপুরুষ বন্ধুটি দুর্নাম করতে দেরি করে না।

এই মস্তিষ্ক থেকে যৌনতা যেদিন পুরুষ নিয়ন্ত্রণ করতে শিখবে, কোথায় কোন কথা বলতে হয় শিখবে, একটা মেয়েকে বান্ধবী মানেই ভোগের বস্তু নয় বলে ভাবতে যেদিন পারবে,  সেদিন হয়তো মেয়েরা ঘর থেকে বের হতে আর কোনো সংশয়ে পড়বে না, মেয়েদের জন্য কর্মক্ষেত্র হবে স্বস্তির।

হয়তো একদিন পুরুষরাও পারবেন বন্ধু হয়ে উঠতে, শরীর থেকে আঠা ছাড়িয়ে মনের জগতে বন্ধু হয়ে উঠতে। ততদিনে নারীদের যথাসময়ে যথাযথ সিদ্ধান্তে নির্ণয় করতে হবে, কোন পুরুষ কতখানি বন্ধু হওয়ার যোগ্য,  কতখানি সীমাবদ্ধতা রাখা উচিত।

পরিশেষে বলবো, আমার সেই সরল বিশ্বাস কোনো একদিন  সত্যি হোক যে পুরুষও বন্ধু হতে পারে। আমি যাদের বিশ্বাস করি তারা বিশ্বাসের যোগ্য। আমি যাদের ভালোবাসি তারাও ছলনায় নয় সত্যি আমাকে ভালোও বাসে।

পৃথিবী নারীবান্ধব হোক।

 

[ফেমিনিস্ট ফ্যাক্টরে প্রকাশিত মুক্তমত লেখকের নিজস্ব বক্তব্য]

2 thoughts on “পুরুষের বন্ধুত্ব নারীর শরীরে গিয়ে গড়ায়

  • তাতে সমস্যা কোথায় আপনাদের? শরীরের মেলামেশা একটা মজার ও সুখের জিনিস। গড়ালে গড়াক। জাস্ট ফিল ইট।

    Reply
  • এই যে পুরুষ তার সীমানায় বন্দি থাকতে পারে না, এই যে সীমা অতিক্রম করে ফেলে – এই উপাদান তো এই সোসাইটিতেই আছে। তাকে ইগনোর করলেই কি সব শোধরানো যাবে ?
    পুরুষের সঠিক শিক্ষার জন্য এই সমাজের আয়োজন কি ?

    Reply

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *