মিস্টেরিয়াস বাঁধন
মাসকাওয়াথ আহসান ।। নেটফ্লিক্সে বলিউডের খুফিয়া ছবিটি দেখে দু’রকম প্রতিক্রিয়া পাওয়া যাচ্ছিল। একটা হচ্ছে, বাংলাদেশকে নেতিবাচক হিসেবে দেখানো হয়েছে। একটা ফিকশনাল ওয়ার্ক নিয়ে এরকম প্রতিক্রিয়া একটু হাস্যকরই শোনায়। দ্বিতীয় প্রতিক্রিয়া হচ্ছে, ওয়াও এ এক অসাধারণ ছবি। হলিউডের বানানো পেশাদার স্পাই মুভি দেখে ফিল্মি টেস্ট গড়ে না উঠলে এরকম প্রতিক্রিয়া হতে পারে।
কারো জানার বা দেখার সীমাবদ্ধতার জন্য তাকে দোষ দেয়া যায়না। ফেলুদা বা ব্যোমকেশ বক্সী’র পরে ভালো মানের গোয়েন্দা গল্প ভারতীয় চলচ্চিত্রে পাইনি আমরা। খুফিয়া ছবিটির গল্পেই যেমন বাহাদুরিটা বাংলাদেশে দেখাবো না আমেরিকায় গিয়ে দেখাবো; এই দোলাচলে গল্পটা বেশ দুর্বল হয়ে গেছে মনে হয়। স্পাই মুভিতে গান কিংবা অভিনেত্রীর শরীর দেখানোর ব্যাপারগুলো ক্লিশে। মানুষ এতে টান টান উত্তেজনার গল্প শুনতে চায়। খুফিয়া চলচ্চিত্রে একমাত্র হলিউড মানের অভিনয় শৈলী পাওয়া গেল বাংলাদেশের অভিনেত্রী বাঁধনের অভিনয়ে। বাকিদের অভিনয়াংশ দেখে মাঝে মাঝে কনফিউশান হচ্ছিল; সনি টিভিতে “সিআইডি” সিরিয়াল দেখছি না তো! গুনী অভিনেত্রী টাবু যেমন প্রোপাগান্ডা মুভির এরকম চরিত্রে অভিনয় করে করে এখন মনে হয় যত্ন নেয়া ছেড়ে দিয়েছেন। আমরা যেহেতু দর্শক, দুটো পয়সা খরচ করে যেহেতু ছবি দেখি; কোনো কিছু ভালো না লাগলে একটু কড়া সমালোচনা করবোই। এই চলচ্চিত্রে বাঁধনের অভিনীত চরিত্রটিকে প্রথমেই মেরে দিয়ে এরপর ছেঁড়া ছেঁড়া ফ্ল্যাশব্যাকে বাঁধনকে নিয়ে আসা; বলিউড পরিচালকের হলিউড ডিরেক্টর ক্রিস্টোফার নোলানের ব্যামোর মতো লেগেছে। বাঁধন যে চরিত্রটি করেছেন, এই চরিত্রটি নাকি অন্য দুজন অভিনেত্রী রিফিউজ করেছেন। এটা ভালো করেছেন তারা; কারণ এরকম চরিত্রে অভিনয় সবার পক্ষে সম্ভব নয়। বাঁধন ভার্সাটাইল অভিনেত্রী; নানারকম চরিত্রে অভিনয়ের যে আনন্দ সেটা উদযাপন করেন। আমাদের চলচ্চিত্রের সোনালী যুগের অভিনেত্রী ববিতার পরে এই আরেকজন অভিনেত্রী পাওয়া গেছে যিনি যে কোন ইন্টারন্যাশনাল ফিল্ম প্রোডাকশনে অভিনয়ের চ্যালেঞ্জটা নিতে সক্ষম। আমার ধারণা বলিউডের পরিচালকরা এটা ধরতে পেরেছেন। কারণ দক্ষিণী ছবির দাপটে বলিউড অভিনেতা-অভিনেত্রী সংকটে ভুগছে। এমনকী পরিবারতন্ত্র থেকে আসা অভিনেতা অভিনেত্রীরাও জান-প্রাণ দিয়ে পরিশ্রম করছে। সেইখানে বাঁধন একেবারেই প্রস্তুত অভিনেত্রী। এখন আমাদের সমাজের প্রিয় বিনোদন যে কোন প্রশ্নে বিভাজিত হয়ে তারপর ঝগড়া করে সময় নষ্ট করা। বিষয়টা বিতর্ক হলে বরং যুক্তি-তর্ক দিয়ে সময়টা একটু কাজে লাগানো যায়। ঝগড়া করতে গেলে এক মুঠো দেশপ্রেম, এক চিমটি ধর্মীয় আবেগ আর “জাত গেলো জাত গেলো”-র আধাসের পানির ওরস্যালাইন ঘুটা দিয়ে বানাতে হবে। তাই এক মুঠো দেশপ্রেম হিসেবে দেখলাম; যে ছবিতে বাংলাদেশকে কথিত “জামাত হয়ে যাবে” প্রোপাগান্ডার জুজুধান বানানো হচ্ছে; সেখানে বাঁধন কেন অভিনয় করলেন!
চলচ্চিত্র একটা কাল্পনিক গল্পের রূপায়ন; অভিনেতার কাজ সেখানে চরিত্রানুগ অভিনয় করা। বাংলাদেশে দেখেন না রাজনৈতিক দলান্ধ বিদূষক হতে গিয়ে কত অভিনেতা-অভিনেত্রীর প্রতিভার মৃত্যু হয়। সেখানে অভিনেতা-অভিনেত্রীদের মধ্যে যারা পেশাদার, যাদের অভিনয় শৈলী গড গিফটেড, তাদেরকে এই ভিলেজ পলিটিক্সের আহাজারি থেকে দূরে রাখা উচিত। আর আমি তো মনে করি অতিরিক্ত দেশপ্রেম ও দেশের ভাবমূর্তি নিয়ে ঘুমাতে না পারা লোকেদের ফিল্ম-টিল্ম দেখে সময় নষ্ট না করে; সময়টা মিটিং-মিছিল ও দলীয় কর্মকাণ্ডে দেয়া উচিত। শিল্প আসলে সবার ভাগ্যে নেই। এরপর এক চিমটি ধর্মীয় আবেগ হিসেবে দেখলাম, বাঁধন কেন এমন একটি চরিত্রে অভিনয় করলেন; সেখানে তার প্রেমের ওরিয়েন্টেশন সমমেরুতে। মানে টাবু’র সঙ্গে কেন প্রেম হলো!
চলচ্চিত্র হচ্ছে সমাজচিত্র। আমাদের সমাজে অগ্রপশ্চাৎ চিন্তা না করে টাবুকে বিয়ে দেয়া হয়; সেখানে প্রতিবেশীদের চাপাচাপিতে টাবুর একটি ছেলেও হয়। কিন্তু টাবু বুঝতে পারে; এটা তার জীবন হবার কথা নয়। একবিংশ শতকেও এসে জীবনের জরুরি বিষয়গুলোতে ঢাকঢাক গুড় গুড় করে অসংখ্য মানুষের জীবন “সমাজকে খুশি করার বার বি কিউ” না বানিয়ে বরং মানুষকে বাঁচার মতো বাঁচতে দেয়াই তো মানবিক। জীবন তো একটাই। কাজেই চলচ্চিত্রের কাহিনীর প্রয়োজনে বাঁধন ও টাবু সমমেরুতে প্রেমের চরিত্রে অভিনয় করেছেন। কাল্পনিক চরিত্রে অভিনয় করে দুকথা শুনতে হয় যে সমাজে; ঐখানে বরং দেশলুট করে ওমরাহ করতে চলে যাওয়াই ভালো মনে হয়। বড় বড় অপরাধ করে ধর্মীয় লেবাস পরে নিলে তখন কিন্তু ধর্মীয় আবেগে আঘাত লাগেনা। এমনই সব অজায়গায় আমাদের আবেগ ও অনুভূতিগুলো তটস্থ।
আমাদের শোবিজের আরেকজন অভিনেত্রী ও চিন্তক বন্যা মির্জা “খুফিয়া” চলচ্চিত্রে বাঁধনের অভিনয় প্রসঙ্গে বললেন, “বাঁধন নটী হয়ে উঠলেন।” অমনি সেই আধাসের পানির মতো “জাত গেল জাত গেল”র কলরোল। এই মন্তব্যটির অর্থ না বুঝে “হাহা” ইমোর সুনামি; ঐ যেরকম বৃটিশদের দেখে তাদের আগমনে হেতু না বুঝে “হাহা” হাসি দিয়ে আমরা বৃটিশ উপনিবেশকে বরণ করেছিলাম। না বুঝে হাহা করার ক্ষেত্রে আমাদের তুলনা মেলা ভার। আমাদের নাট্যচর্চার ঐতিহ্যের সঙ্গে মিশে থাকা দুটি শব্দ নট ও নটী। নটরাজ, নটী বিনোদিনী; এরকম শব্দবন্ধের সঙ্গে আমরা পরিচিত। কিন্তু আমরা ভীষণ মুখফোঁড় তো; একে ওকে ফট করে তকমা দিতে ওস্তাদ; তাই ধরুন ঊনবিংশ শতকে সংগীত, অভিনয়, নৃত্যের সঙ্গে সম্পৃক্ত নারী শিল্পীর পারফরমেন্সে ঈর্ষান্বিত হয়ে কোন জমিদার গিন্নী সুইপিং কমেন্ট করলেন নটী। শিল্পীর কনোটেশন বদলে “নটী” শব্দটিকে নেতিবাচক করে তোলার পেছনে ঈর্ষান্বিত জমিদার গিন্নী কিংবা প্রত্যাখ্যাত জমিদার; এই দুটি চরিত্রকে খুঁজে পাই আমি; এটা ফিকশনাল অনুমান; সমাজ মনস্তত্ব সম্পর্কে অভিজ্ঞতার আলোকে। এই যে নটী বা দক্ষ অভিনেত্রী; এটা কী সবার পক্ষে হওয়া সম্ভব! চোখের অভিব্যক্তি-মুখমণ্ডলের পেশী-ঠোঁট সব কিছু একসঙ্গে অভিব্যক্তি দেয়া; এ হচ্ছে সবচেয়ে কঠিন কাজ। নটী বা দক্ষ অভিনেত্রীর রহস্যময়তাই পৃথিবীর সমস্ত শিল্প সৃষ্টির অনুপ্রেরণা।
সব অভিনেত্রী রহস্যময়তা সৃষ্টি করতে পারে না। বাঁধন সেটা পারেন। রেখা যেমন পারতেন। বিপাশা বসু যেটা পারেন। দর্শককে অনিষ্পন্ন আকাংখার ঘোরে ফেলতে পারেন যে অভিনেত্রী তিনি আসলে ইলিউশনিস্ট। সোফিয়া লরেনের মধ্যে যে ইলিউশন নেই তা আছে মেরিলিন মনরোর মধ্যে। নটী শব্দটিকে আমরা নেতির চোখে দেখি, কারণ আমরা রহস্যময়তাকে ভয় পাই। আমরা আসলে অ্যাডভেঞ্চার ও এক্সপেরিমেন্টকে ভয় পাই। মুলানরুশ ছবিতে অভিনেত্রী নিকোল কিডম্যান অভিনয় করেছেন মূল চরিত্রে; সেইখানে তিনি যে অভিনয় করেছেন, তাতে রহস্যময়তা আছে; না বলা কথার মাঝে অনেক কথা বলা আছে। এই চরিত্রটিতেই টাইটানিক খ্যাত কেইট উইন্সলেটকে নিয়ে এলে তিনি সেই রহস্যময়তা তৈরি করতে পারতেন না। এইজন্য হলিউডের কাস্টিং দক্ষতা উদযাপন করি একজন দর্শক হিসেবে।
খুফিয়া ছবিতে বাঁধন একজন রহস্যময়ী স্পাই; তিনি যখন মির্জা চরিত্রটিকে হত্যা করতে যান, সেই মিশনে বাঁধনের যে অ্যাপিয়ারেন্স, যে রহস্যময়তা, যে আত্মবিশ্বাস, তা নিকোল কিডম্যানের মতো প্রতিশ্রুতিময়ী। আবার বৃষ্টির মধ্যে টাবুর গাড়ির সিটে হঠাৎ বসে যে অভিনয়, সেখানে স্পাই মুভি “রেড স্প্যারো” চলচ্চিত্রের জেনিফার লরেন্সের মতোই কন আর্টিস্টের শৈলী খুঁজে পাওয়া যায় বাঁধনের অভিনয়ে।
বাংলাদেশেই তরুণ প্রজন্মে অনেক ভালো চলচ্চিত্রকার তৈরি হচ্ছেন। আমার ধারণা তারা “বাঁধনে”-র অভিনয় সক্ষমতাকে এক্সপ্লোর করবেন। চলচ্চিত্র বিশ্বায়নের যুগে বাংলাদেশের দর্শকেরা প্রস্তুত এই মিস্টেরিয়াস বাঁধনের অভিনয়ে তৈরি করা ইলিউশানকে সেলিব্রেট করতে। আমাদের বাংলাদেশ সমাজে শক্তির জায়গাটা ঐখানে; এখানে মানুষ মূলত শিল্পী গোছের; শিল্পরস আস্বাদনের তৃষ্ণা তাদের প্রবল। এই যে যারা নেহাত সময় কাটাতে এটা-ওটা-সেটার সমালোচনা করছেন, নটী শব্দ শুনে হাহা করছেন, তারাই কিন্তু ঠিক ঠাক গল্প, ঠিক ঠাক চলচ্চিত্রে “বাঁধন” এসে ইলিউশনিস্টের ভঙ্গিতে দাঁড়ালে, অনুসরণ করবে তার চোখ-মুখাবয়ব-ঠোঁট-চিবুক-কিংবা হাত নাড়া, কোথায় কী বলছেন তিনি। অভিনয় যতটা থাকে সংলাপে, তার চেয়ে অনেক বেশি থাকে অভিব্যক্তিতে। অভিব্যক্তিপ্রধান অভিনেতাই নট, অভিনেত্রীই নটি; শিল্পজগতে হঠাৎ হঠাৎ এমন একজন আপাদমস্তক শিল্পীর আগমন ঘটে।