একটি মেয়ের জীবনচক্র
তানজিয়া রহমান ।। এত শিক্ষা, এত সচেতনতা, এত অগ্রগতি। ছেলে মেয়ে সমানে সমান করে দেখাচ্ছে, কেউ কারো থেকে কম নয়, তবু এখনও মেয়েদের আলাদা করেই দেখা হয়। এখন মেয়েরা পড়াশোনা করে, চাকরি করে। তারপরও ভেদাভেদ করা হয়, দুর্বল ভাবা হয়, মেয়েদের মতামতের প্রয়োজন পড়ে না, তাদের চাপিয়ে দেয়া হয়, একটা ছাঁচে ফেলতে চায়। যার যার মতো করে পেতে চায় মেয়েদের। জনে জনে আলাদা চাহিদা, মেয়েদের নিজেদের যেন কোনো অস্তিত্বই নেই।
জন্ম থেকে ভেদাভেদ। পরিবার থেকেই শুরু হয় এই বৈষম্য। ছোট্ট অবুঝ বাচ্চাকে তৈরি করা হয় মেয়ের মতো। বুঝে বা না বুঝে খেলনা দেয়া হয় সাংসারিক। হাড়ি-পাতিল, বেলন পিড়ি, পুতুল এসব মেয়ে বাচ্চাদের দেয়া হয়। গাড়ি, বল, ব্যাট, টুলস কয়টা মেয়ে বাচ্চাকে দেয়া হয়? পছন্দ করে না – এটা বলে অনেকে। কী করে পছন্দ করবে? ওকে দেয়া হয়? ওর সাথে জিনিসগুলো নিয়ে খেলা করা হয়? বাচ্চারা হৈ হুল্লোড় করে, ছুটাছুটি করে, তাতেও বলা হয় মেয়ে হলে শান্ত হয়, ছেলে হলে দুষ্ট হয়। মেয়েদের রঙ গোলাপি, ছেলেদের নীল। এভাবে একটু একটু করে পার্থক্য শুরু হয়।
স্কুলে ভর্তি করানোর পর শোনা যায়, ছেলে বাচ্চাদের লেখা সুন্দর না, মেয়েদেরটা সুন্দর। ছেলে মেয়ে হওয়ার জন্য কি লেখা সুন্দর অসুন্দর হয়? নাকি মনোযোগ আর যত্নের কম বেশির কারণে হয়? মেয়েরা ভালো আর্ট পারে, মেয়েরা প্রতিদিন পড়া ভালো পারে, মেয়েরা রেজাল্ট ভালো করে এসব তো আছেই। আচ্ছা মেয়েরা যে এতো ভালো পারে, তবু মেয়েদের সব সেক্টরে এত কম দেখা যায় কেন? কারণ মেয়েরা পারলেও মেয়েদের কাজ ঘুরে ঘুরে সেই ঘর সামলানোতেই আটকে যায়।
মেয়েদের স্কুল, কলেজে ভর্তি নিয়েও ঝামেলা করে। মেয়েদের বাড়ির কাছে স্কুল, কলেজে দেয়া হয়। তারা ভালো কলেজে চান্স পেলেও ভর্তি করানো হয় না। কলেজ দূরে, ওই কলেজে ছেলে মেয়ে একসাথে পড়ে, ওই কলেজটার এলাকা ভালো না, ওই কলেজের খরচ আমরা চালাতে পারবো না আরো কত কি! মেধা দিয়ে যে মেয়েটা এতো ভালো কোথাও পড়ার সুযোগ পেল তার কোনো মূল্যই নেই।
এখন কলেজ অব্দি পড়ে অনেক মেয়ে। জোরালো আইন হয়েছে, ১৮ বছরের আগে মেয়েদের বিয়ে দেওয়া যাবে না। দিলে পুলিশ ধরে নিয়ে যাবে। সেই ভয় পায় অনেকে। তাই বলে বন্ধ হয়ে যায়নি। এখনও বাল্যবিবাহ হয় কিন্তু কমেছে অনেকটাই। ১৮ বছর হওয়ার আগে থেকেই শুরু হয় ছেলে খোঁজ করা। একের পর এক পাত্রপক্ষ দেখতে আসে। আগে থেকে জানানো হয় কবে পাত্রপক্ষ আসবে। পোলাও-মাংস, শরবত, মিষ্টি, পিঠা-চিড়া খাইয়ে মেয়েকে সাজিয়ে, ঘোমটা দিয়ে পাঠানো হয় এদের সামনে। একজন খালি পায়ে হাঁটা দেখে, হাইট কত, পায়ে সমস্যা আছে কিনা বুঝতে, একজন চুল টেনে দেখে পরচুলা কিনা, একজন পায়ের রঙ দেখে মেয়ের গায়ের রঙ কী জানতে, একেকজন একেক প্রশ্ন করে কথা কী ক’রে বলে শুনতে। প্রতি সপ্তাহে লেগে থাকে মেয়ে দেখা। সবাই বলে যায় বাড়িতে গিয়ে জানাবো। মেয়ের বাড়ির লোকেরা চাতক পাখির মতো বসে থাকে কবে ওরা বলবে মেয়ে পছন্দ হয়েছে। মেয়ে যদি বলে বিয়ে করবো না, পড়বো এখনো। বলা হয় পড়বা তো। আমরা কথা বলবো এ বিষয়ে। আমরাও চাইনা তোমার পড়া বন্ধ হোক। শুনে মনে হবে খুব সাপোর্ট দিচ্ছে তারা। যদি তাই দিতো তাহলে তো এতো তাড়াহুড়ো করে বিয়ের চিন্তাই করতো না। তারপর মেয়ে পড়বে এটা সরাসরি না বলে পাত্রপক্ষের কাছে মিনতি করে বলবে আমাদের মেয়ে পড়া চালায়ে যেতে চায়। বলে অপেক্ষা করবে তারা রাজি আছে এটা শোনার জন্য। ছেলে পক্ষ বলবে আপনাদের মেয়ে যা চাইবে তাই হবে। সে যত দূর পড়তে চায় পড়বে। আহা! সবার মুখে হাসি। কথাবার্তা এগোতে থাকে। বিয়ে যে এখন করতেই হবে তা পরিষ্কার।
এবার বিয়ের পরের চিত্র। নতুন বাড়ি, নতুন নিয়ম, নতুন মানুষজনদের বুঝে উঠতেই পার হবে কয়েক মাস। সবাই চাইবে সে যেটা বলবে বউ তাই করবে। শ্বাশুড়ি বলবে এ বাড়ি সবাই ভোরে ওঠে। সকাল করে উঠে যাবা পুরুষলোক ওঠার আগে। এবার মেয়ে সকালে উঠে দেখবে সে আর শ্বাশুড়ি বাদে সবাই দেরিতে ওঠে। পরের নিয়ম, এ বাড়ি সবাই রুটি খায় নাস্তায়। বউ আর শ্বাশুড়ি মিলে প্রতিদিন কয়েক ডজন রুটি বানাবে। যখন যে খাবে তাকে গরম গরম ভেজে দেবে। এ বাড়ির কেউ পুরুষলোকের আগে খায় না। তাদের জন্য অপেক্ষা করে। মেয়ের ক্ষুদা লাগবে, মেয়ে বসেই থাকবে। পুরুষ খায়নি যে এখনও। এবার যখন পুরুষরা খেতে বসবে তখন তাদের সামনে সব দিয়ে পাতে তুলে খাওয়াতে খাওয়াতে নিজে সময়ই পাবে না খাওয়ার। সে খেতে বসতে বসতে সবার খাওয়া শেষ হয়ে যাবে। এরপর সবার শেষে একা একা খাবে। এরপর নাস্তা পর্ব শেষ হলে দুপুরের রান্নার প্রস্তুতি। ভাজি, তরকারি, ডাল আবার একেকজন একেক তরকারি খায় না, তাদের জন্য আলাদা পদ। এসব করে কত কত পদ রানতে হবে প্রতিদিন। রান্নার জোগাড়যন্ত্র করে, রান্না শেষে গোছগাছ করে কয়েক ঘণ্টা লেগে যাবে। রান্নার ফাঁকে ফাঁকে কাপড় কাঁচা, কাপড় মেলা, ঘর ঝাড়ামোছা, কত কি। সবাই খাবে তাদের পাতে তুলে খাওয়ানো। নিজে খাওয়া, বাসন মাজা,শুকনো কাপড় তোলা, ভাজ করা, গুছিয়ে রাখা, বিকালের নাস্তা, রাতের খাবার তৈরি – বাপরে যেন এক যুদ্ধ সারাটা দিন। আরো তো কত টুকটাক কাজ থাকে। এসবের মধ্যে আপনার শুনতে হবে এটা কেন করলে, এটা কেন এমন হলো, এই পোশাক কেন পরলে, মাথায় ঘোমটা কেন দিলেনা, ওড়না কেন পরলে না, চুল কেন খুলে রেখেছো, গোসলে এত সময় লাগে কেন, পিরিয়ডের ব্যাথা আবার কী? ব্যাথা হয়ই, তাই কি আমাদের বসে থাকা মানায়? বাচ্চা নেও ঠিক হবে। প্যাড কেন ব্যবহার করো? খরচ বেশি। পুরোনো ন্যাকড়া ব্যবহার করবা। আমরা তাই করতাম। শুয়ে আছো কেন? শরীর খারাপ লাগছে মানে! তুমি এতো অসুস্থ হও কেন?
এসবের মধ্যেও অনেক মেয়েই চাইবে পড়তে। মেয়ে বলবে ভর্তি করে দেও। তাকে বলা হবে এবার একটা বাচ্চা নেও। একই কথা পুনরাবৃত্তি হতে থাকবে। এসব করে একসময় ভর্তি করানো হবে বাড়ির পাশের ডিগ্রি কলেজে। শুধু পরীক্ষা দিলেই চলবে। ভর্তি করেই বলা হবে রেজাল্ট খারাপ যেন হয়না। মানুষ তখন বলবে ওমুকের বউ খারাপ রেজাল্ট করেছে। মেয়ে বাড়ির কাজ করবে সাথে পড়াও চালাতে থাকবে। এর মধ্যে বাচ্চাও নিয়ে নেবে। পরীক্ষার সময়ও সব কাজ একা হাতেই করতে হবে। কারো সহযোগিতা নেই। কেউ পড়ার সুযোগ করে দেয় না। রেজাল্ট খারাপ হয়। শুনতে হবে এই তোমার রেজাল্ট। মানসম্মান আর থাকলো না। মেয়ে ক্লান্ত বিরক্ত হয়ে আর পড়ার নাম মুখেও আনবে না।
একসময় বাচ্চা স্কুলে যাবে। তখন বাচ্চা পড়াতে গিয়ে বোঝা যাবে পড়া বাদ দিয়ে ভুল হয়েছে। বাচ্চাকে পড়াতে অসুবিধা হবে। তখন শুনতে হবে অশিক্ষিত। এত কম পড়েছো বাচ্চাটাকে পড়াতে পারো না। ভর্তি করে দিলাম, পড়াটা শেষ করলে না। একসময় ধমক দেবে, কিছুক্ষণ পর স্যরি বলবে। এরপর একদিন একটা চড় দেবে, কিছুক্ষণ পর স্যরি বলবে, ঘুরতে নিয়ে যাবে। এরপর দুইটা চড় দেবে, এবার ঘোরার সাথে বাইরে খাওয়াবেও। এভাবে চড়ের সংখ্যা বাড়তে থাকবে। একদিন মেয়ে খুব রাগ করে বাবা মায়ের কাছে চলে যাবে। তাকে বুঝানো হবে স্বামীর রাগের কাজ করো কেন? ফিরে যাও। নিজের ইচ্ছেতে বিয়ে করেছো। যেদিন যা চেয়েছো দিয়েছি। এবার আমাদের শান্তি দেও। তোমার স্বামী খুব ভালো যে বাচ্চা নিয়েও পড়ার সুযোগ দিয়েছিল। তুমিই পড়োনি। এবার আর কী করবা। ওইটাই তোমার বাড়ি। ওখানেই থাকতে হবে। ওরা যেমন চায়, ওদের মতো থাকো, তাহলেই সুখি হতে পারবা। কালকে জামাই আসবে, তুমি চলে যাবা। মেয়ে শুধু শুনতে থাকবে কথাগুলো। বাকরুদ্ধ হয়ে যাবে। নিজের কানকে বিশ্বাস করতে পারবে না। সে নিজে পছন্দ করে বিয়ে করেছিল? সে পড়া বাদ দিয়েছে? সব দোষ এখন তার?
আবার কেউ কেউ এসব সামলে কায়দা করে পড়া চালায়ে যায়। তখন চাকরি করা যাবে না বাধা আসে। চাকরি অব্দিও যায় অনেকে। তাতে কী? তখন তাদের ঘর আর বাইরে দুই জায়গায় সামলাতে হয়। আগে ঘর পরে বাইরের কাজ। নাস্তা রেডি করে, দুপুরের রান্না শেষ করে কাজে যায়। এসে টেবিল গুছায়, থালা বাসন মাজে, রাতের রান্না করে। পরিবারের সবার যত্ন করা, আত্মীয়দের সাথে যোগাযোগ রাখা সবই তার দায়িত্ব। নিজের আয়, নিজের সংসার, নিজেকেই সব কাজ করে পরের আদেশ উপদেশ শুনতে হয়। কাজ থেকে তাড়াতাড়ি বাড়ি ফেরার তাড়া থাকে। হুটহাট গেস্ট আসবে, তাদের আপ্যায়ন – এসবের মধ্যেই করতে হয়। ছুটির দিনে সংসারের অন্য ফেলে রাখা কাজগুলো করতে হয়। আবার বাচ্চার পুরো দেখাশুনাও এরই মধ্যেই করতে হবে। ক্লান্ত হলে বলা হবে, চাকরি করো না। তোমার কষ্ট হয়ে যায়। বাসায়ই থাকো। যেন বাসায় থাকলে তার আর কোনো কাজ নেই। চাকরিই তার একমাত্র কাজ। এটা করেই সে অসুস্থ হয়েছে। প্রতিটা কর্মজীবী নারীর পিছনে এমন গল্প থাকে। কেউ কেউ আর না পেরে চাকরি ছেড়েই দেয়।
পড়া ছেড়ে দিয়ে, কাজ ছেড়ে দিয়ে শুধু সংসার সামলে একটা বয়স পার করে দেয়া যায় হয়তো কিন্তু সারাজীবন কি কাটানো যায়? একসময় বাচ্চারা বড় হবে। যে যার মতো আলাদা জীবন কাটাবে। তখন কী করে সময় পার হবে? একাকীত্ব, বিষন্নতা ভর করবে। সারাক্ষন অনুতাপ হবে, জীবনে কী করলেন সেটা ভেবে কাটবে সারাক্ষণ। একেকটা দিন তখন পাহাড় সমান মনে হবে। সময় থাকতে নিজের ভালো বুঝতে হবে। নিজে কী চাচ্ছেন? কী করলে নিজে শান্তি পাবেন, কোনটা আপনাকে ভালো রাখবে তা বুঝতে হবে। নিজেকে ভালো না রাখলে কখনোই সুখি হতে পারবেন না। আগে নিজেকে ভালোবাসুন।
[ফেমিনিস্ট ফ্যাক্টরে প্রকাশিত মুক্তমত লেখকের নিজস্ব বক্তব্য]