করোনা মহামারী: ঝুঁকিতে মানসিক স্বাস্থ্য, হুমকির মুখে শিশুরা
নাসরীন রহমান।। যে কোন প্রাকৃতিক বা মানব সৃষ্ট দুর্যোগ বা মহামারীতে সবচাইতে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয় নারী এবং শিশুরাই। নারী ও শিশুদের জীবন এই সময় বিপন্ন হয়ে ওঠে সুরক্ষার অভাবে। দুর্যোগ বা মহামারীতে নারী ও শিশুদের সুরক্ষার বিষয়ে গুরুত্ব দেওয়া তাই এক চ্যালেঞ্জ বটে।
কভিড-১৯ এর তীব্র আক্রমণ ও এর প্রতিরোধের মধ্যেই নির্যাতন, অবহেলা,শোষন ও নিপীড়নের ঝুঁকিতে রয়েছে নারী ও শিশুরা। ইউনিসেফের এক প্রতিবেদনে তাই বিশ্বব্যাপী করোনাভাইরাস মহামারিকালীন শিশুদের সুরক্ষা বিষয়ে গুরুত্ব দেওয়া বিষয়ে সরকার ও সংস্থাগুলোর প্রতি আহ্বান করা হয়েছে।
ইউনিসেফ আশংকা করছে ‘করোনা প্রতিরোধে পদক্ষেপসমূহের কারণে বিশ্বজুড়ে লাখ লাখ শিশু দুর্ব্যবহার, লিঙ্গভিত্তিক সহিংসতা, শোষণ, সামাজিক বাধার মুখোমুখি হতে পারে বা যত্নকারীদের থেকে বিচ্ছিন্ন হওয়াসহ তাদের নিরাপত্তা ও কল্যাণের ক্ষেত্রে ক্রমবর্ধমান হুমকির মুখে পড়তে পারে।’
ইউনিসেফ আরো জানাচ্ছে, ‘এই রোগের কারণে সৃষ্ট ক্রমবর্ধমান আর্থ-সামাজিক বিপর্যয়ের মাঝেই শিশুদের নিরাপত্তা ও কল্যাণ নিশ্চিত করার জন্য ইউনিসেফ সরকারগুলোর প্রতি আহ্বান জানাচ্ছে। পরিস্থিতি মোকাবিলায় সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ ও সংস্থাগুলোকে সহায়তা দিতে জাতিসংঘের শিশুবিষয়ক সংস্থাটি ‘মানবিক কার্যক্রমে শিশু সুরক্ষার জন্য জোট’-এ সহযোগিদের সঙ্গে মিলে কিছু নির্দেশনা প্রকাশ করেছে।’
কয়েক মাস জুড়ে বিশ্বজুড়ে এবং সম্প্রতি বাংলাদেশ, ভারতসহ দক্ষিন এশিয়ার দেশগুলোতে করোনা মানুষের জীবন যাত্রা ওলট পালট করে দিয়েছে। ছেলেমেয়েরা স্কুল, কলেজ, বিশ্ববিদ্যালয় বাদ দিয়ে গৃহবন্দী! অলস সময় কাটাচ্ছে তারা। অনেক কর্পোরেট অফিস তাদের কর্মীদের ঘরে বসে অফিসের কাজ করার অনুমতি দিয়েছে ফলে গৃহবন্দী এসব কর্মীরাও। স্বাভাবিকভাবে তাই নারীদের উপর কাজের চাপ বাড়ছে; অন্যদিকে সন্তানের যত্ন, বাড়তি গৃহস্থালী কাজের চাপ নারীর মানসিক বৈকল্যের ঝুকিতে ফেলছে! গৃহবন্দী জীবন মানুষকে অস্থির, হতাশ, বিষন্নতার দিকে ধাপিত করছে, যার প্রকাশ ঘটছে তাদের কাজে। কেউ কেউ অতিরিক্ত খাদ্য মজুদ করছেন, ওষুধ মজুদ করছেন। এসবই হতাশা, অনিশ্চয়তা থেকেই হচ্ছে!
করোনা প্রতিরোধের এই সময়ে একদিকে শিশুদের যেমন অযত্নের আশংকা তৈরি হচ্ছে অন্যদিকে নারীকে ক্রমবর্ধমান সংকটে পরতে হচ্ছে। মায়েরা তাদের সন্তানের যত্ন নিতে বা তাদের চাহিদা মেটাতে হিশমিশ খাচ্ছে, ফলে তারা এর মানসিক চাপ সহ্য করার মত কতটা শক্তি রাখতে পারেন তাও ভাববার বিষয়!
একঘেয়ে, বন্দিজীবন কাটাতে কাটাতে হাঁপিয়ে উঠছেন অনেকেই ফলে পারিবারিক অশান্তি, সহিংসতা বাড়ার আশংকা তৈরি হচ্ছে। ইউনিসেফের এক প্রতিবেদনে লিখেছে, অসমর্থিত সূত্রে জানা গেছে, চীনে মেয়েদের বিরুদ্ধে ঘরোয়া সহিংসতার ঘটনা উল্লেখযোগ্য মাত্রায় বৃদ্ধির পেয়েছে!
আরেকটা বিষয় তা হচ্ছে সাইবার অপরাধ বাড়ার ঝুকি! যেহেতু উল্লেখযোগ্য সংখ্যক মানুষ করোনা প্রতিরোধের এই সময় গৃহবন্দী হয়ে ভার্চুয়াল আওয়ার পার করছে তাই সাইবার অপরাধে জড়িয়ে যাওয়ার আশংকা থেকে মুক্ত নন তারা।
নারী ও শিশুর মানসিক ও শারীরিক স্বাস্থ্য ঠিক রাখতে তাই জোর দিতে হবে, নারীকে বাড়তি কাজের বোঝা থেকে মুক্তি দিতে হবে। পরিবারের সকলে মিলে কাজের ভাগবাটোয়ারা করে নিতে হবে। মানসিক স্বাস্থ্যের দিকে সকলকে যত্নশীল হতে হবে। মনে রাখতে হবে মানসিক দূর্বলতা করোনা প্রতিরোধের শক্তিকে দূর্বল করে দেবে নিঃসন্দেহে।
ইউনিসেফ থেকে শিশুদের সুরক্ষার জন্য যে যে পদক্ষেপের সুপারিশ করা হয়েছে তা হল-
– যৌন নিপীড়ন ও নিগ্রহ প্রতিরোধ এবং নিরাপদে উদ্বেগের কথা জানানোর বিষয়গুলোসহ কভিড-১৯ এর সঙ্গে সম্পর্কিত শিশু সুরক্ষা ঝুঁকি বিষয়ক স্বাস্থ্য, শিক্ষা ও শিশুসেবা প্রদানে নিয়োজিত কর্মীদের প্রশিক্ষণ দেওয়া
– লিঙ্গভিত্তিক সহিংসতার ঘটনা প্রকাশ পেলে কীভাবে পদক্ষেপ নিতে হবে সে বিষয়ে যারা প্রথমেই পদক্ষেপ নেবে তাদের প্রশিক্ষণ দেওয়া এবং ভুক্তভোগীদের সহায়তা প্রদানে স্বাস্থ্যসেবা দিয়ে সহযোগিতা করা
– শিশুদের জন্য প্রাপ্য রেফারেল ও অন্যান্য সহায়তামূলক সেবা বিষয়ক তথ্য শেয়ার বৃদ্ধি করা
– তথ্যসমৃদ্ধ কর্মসূচি গ্রহণ ও প্রচারণার জন্য কভিড-১৯ কীভাবে শিশু, বিশেষ করে কিশোর-কিশোরীর জীবনকে ভিন্ন ভিন্ন উপায়ে প্রভাবিত করে তা মূল্যায়নের জন্য তাদেরকেই সম্পৃক্ত করা
– শিশুদের মানসিক সহায়তা প্রদানে এবং যথাযথভাবে আত্মযত্নে সম্পৃক্ত করতে অন্তর্বর্তীকালীন সেবাকেন্দ্র ও পরিবারগুলোকে লক্ষ্যভিত্তিক সাহায্য করা
– যেসব পরিবারের উপার্জনের পথ ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে তাদের আর্থিক ও উপকরণগত সহায়তা প্রদান করা
এবং
– শিশুকে পরিবারের কাছ থেকে বিচ্ছিন্ন করা ঠেকাতে বলিষ্ঠ পদক্ষেপ নেওয়া এবং বাবা কিংবা মায়ের, অথবা যত্নকারীর হাসপাতালে ভর্তি হওয়া বা মৃত্যুর কারণে পর্যাপ্ত যত্ন থেকে বঞ্চিত শিশুদের সহায়তা করা।