September 20, 2024
ফিচার ২মুক্তমত

সাধারণ মানুষ প্রতিপক্ষ নয়, বন্ধ হোক দোষারোপের খেলা

শেখ সিরাজুম মুনিরা নীরা।। যে কোনো ইস্যুতে দুইভাগে ভাগ হয়ে যাওয়া আমাদের বৈশিষ্ট্য। এ নিয়ে দ্বিমত নেই, এ নিয়ে আলোচনারও কিছু নেই আর। তবে আমাদের আরেকটি বৈশিষ্ট্য হলো, যে কোনো দুর্যোগে বা বিপদে সাধারণ মানুষকে প্রতিপক্ষ বানিয়ে ফেলা। এক্ষেত্রে সাধারণ মানুষের বিপরীতে কখনো থাকেন চিকিৎসক সমাজ, কখনো সেনাবাহিনী, কখনো পুলিশ, কখনো সাংবাদিক ভাইয়েরা আবার কখনো রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দ।

ধরেন, একটা দেশ। তার নির্দিষ্ট সীমারেখা আছে, সংবিধান আছে, আইন আছে, আদালত আছে, সরকারও আছে। কিন্তু সেখানে কোনো সাধারণ মানুষ নেই।

তাহলে সেই রাষ্ট্র ঠিক কী কারণে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী পুষবে? কেন চিকিৎসক তৈরি করবে গাদা গাদা ভর্তুকি দিয়ে? অবশ্য সাধারণ মানুষ কর না দিলে এই ভর্তুকির টাকা তো আর আকাশ থেকে পড়বে না! আবার ধরেন যদি মানুষই না থাকে, সাংবাদিক ভাইয়েরা কাদের বলবেন? ‘আপনারা ঘরে থাকুন, আমরা সংবাদ পৌঁছে দেবো’। পুলিশ বাহিনীই বা কাদের জানমাল রক্ষার দায়িত্ব নেবেন? কিংবা রাজনৈতিক নেতারাই বা কাদের ঘাড়ে কাঁঠাল ভেঙ্গে খাবেন?

ফলে, যত বড় বড় কথা, যে গোষ্ঠীর লোকেরাই বলুন না কেন, আপনারা যে যেখানে আছেন, তার পেছনে এই সাধারণ মানুষেরই অবদান, এই সাধারণ মানুষই আপনাদের অবস্থানের কারণ।

যা বলতে এতো বড় ভূমিকা নিলাম, এবার সে প্রসঙ্গে আসি।

করোনাভাইরাসজনিত রোগ কোভিড-১৯ এর প্রাদুর্ভাব যতক্ষণ গোটা বিশ্বে ছিল ততক্ষণ ঠিকই ছিল। বেশ একটু আহা উহু করা যাচ্ছিলো, চীনের মুণ্ডুপাতও হচ্ছিলো জোরসে। যেই না এর সংক্রমণ বাংলাদেশে শুরু হলো সেই আমরা নিজেদের স্বরূপে ফিরলাম। শুরু হয়ে গেল পক্ষ-বিপক্ষের খেলা।

বলাই বাহুল্য, এখানে ফের প্রতিপক্ষ সাধারণ মানুষ। অন্য দলে আছেন সেনা সদস্য, পুলিশ সদস্য, সাংবাদিক ও চিকিৎসক। অল্প কিছু ক্ষেত্রে ব্যাংকাররাও।

শিক্ষিতের হার নিয়ে ক্ষমতাসীন সরকারগুলো যতই লাফাক না কেন, আপনার আমার ঠিকই জানা আছে, ওই হার কেবল নাম দস্তখতেই সীমাবদ্ধ। আরেকটু বেশি হলে সার্টিফিকেট পাওয়ার জন্য শিক্ষা। তো এই মানুষগুলোকে যখন আপনি লক ডাউনের রাখতে চাইবেন, তখন স্বভাবতই এরা নিয়ম মানতে চাইবে না। নিয়ম না মানার সংস্কৃতি এখানে বহু বছরের। কারণ, সেই যে বিচারহীনতার সংস্কৃতি। নিয়ম না মেনেও বিশেষ বাহিনীর পকেটে বিশেষ কিছু গুঁজে দিলেই এখানে ছোটখাটো অন্যায় থেকে পার পাওয়া যায়। ফলে লকডাউন যখন দেওয়া হলো তখন এই মানুষগুলো গুরুত্ব দিল না।

যথারীতি তাদের ঘরে রাখতে মোতায়েন হলো সেনাবাহিনী। ইতিহাস বলে, একমাত্র জলপাই পোশাককেই কিছুটা মান্যগন্য করে এই দেশের মানুষ, মানে ভয় পায় আর কি। আবার সেনা মোতায়েন হলে বুঝতে পারে, আসলেই গুরুতর কিছু হয়েছে।

সেনা মোতায়েনের পরপরই সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে দেখা গেল নানা ধরনের বক্তব্য। যার সারকথা হলো, সাধারণ মানুষ নিয়ম মানে না, তারা খারাপ, তাই তাদের নিরাপত্তা দিতে সেনা মোতায়েন হলো। অথচ এই সেনাবাহিনীর বা পুলিশ বাহিনীর সদস্যদের নিরাপত্তার কথা কেউ ভাবলো না! তারা কী মানুষ না?

বেশিরভাগ বক্তব্যেরই মূলকথা এমন। একই রকম কথা উঠলো পুলিশ, চিকিৎসক, ব্যাংকার আর সাংবাদিকদের বিষয়েও। সবারই অভিযোগ সাধারণ মানুষের বিরুদ্ধে, কারণ সাধারণ মানুষ ‘আবাল’, তারা কিছু বোঝে না, নিয়ম মানে না, জীবাণু ছড়ায় আর বিপদে ফ্যালে।

স্বাধীনতার এতো বছর পরও কেন এই দেশের সাধারণ মানুষ এমন ‘আবাল’ রয়ে গেছে, সেই প্রশ্ন কেউ করে না। সমস্যাটা সাধারণ মানুষের না রাষ্ট্রের সেই প্রশ্ন কেউ করে না।

আমি আশ্চর্য হয়ে এই দোষারোপের খেলা দেখি!

এই যে সাধারণ মানুষ, যাদের ওপর আপনাদের এতো ক্ষোভ, তাদের শিক্ষিত করার কথা ছিল রাষ্ট্রের, তাদের মানবিক মানুষ হিসেবে, নিয়ামানুবর্তী হিসেবে গড়ে তোলার কথা ছিল রাষ্ট্রের। রাষ্ট্র সেটা করতে পারেনি, এটা রাষ্ট্রের ব্যর্থতা।

প্রিয় সাংবাদিক, পুলিশ ভাই, সেনাসদস্য ভাই, চিকিৎসক ভাই, আপনারা যে ডিভাইস ব্যবহার করে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে গরল ছড়ান, সেই ডিভাইসের দাম দিয়ে এদেশের লাখো সাধারণ মানুষের কয়েক মাসের সংসার খরচ হয়, জানেন? আপনারা যে পরিমাণ সুবিধা নিয়ে এই পর্যন্ত এসেছেন, তার ১০০ ভাগের এক ভাগও পায় না এমন লাখো মানুষ আছে এই দেশে। আজকে তারাই আপনাদের প্রতিপক্ষ হয়ে গেল?

দেশের জরুরি অবস্থায় দায়িত্ব পালনের শপথ নেননি আপনারা? জীবন দিয়ে দেশের সেবার করার জন্য এসব চাকরি বেছে নেননি আপনারা? যখন সেনা, নৌ, বিমান বা পুলিশ বাহিনীতে যোগ দিয়েছেন, তখন জানতেন না যে, তৃতীয় বিশ্বের একটা উন্নয়নশীল দেশের বিশেষ বাহিনীতে যোগ দিচ্ছেন? যে দেশে প্রয়োজন পড়লে ঢাল তলোয়ার ছাড়াই যুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়তে হতে পারে? তাহলে এখন এতো আফসোস, এতো ক্রোধ, এতো রাগ কেন? সাধারণ এই মানুষেরা কী আপনাদের পায়ে ধরেছিল এসব পেশায় যোগ দেওয়ার জন্য?

ধরে নেন, দেশের জন্য এই যুদ্ধে আপনার প্রাণ গেল। আপনি তো শহীদের মর্যাদা পাবেন। আপনার স্ত্রী-পুত্র-কন্যারা শহীদ পরিবারের মর্যাদা পাবে, থাকার জন্য ছাদ পাবে, চিকিৎসা পাবে, শিক্ষা পাবে।

অথচ, একজন সাধারণ মানুষ, যে কি না আপনার প্রতিপক্ষ, তার কথা ভেবেছেন? সে তো মরার সময়ও একবুক দুশ্চিন্তা নিয়ে মরবে। তাহলে সে কিভাবে আপনার প্রতিপক্ষ হয়?

আবার ধরেন চিকিৎসকরা, আপনারা কি জানতেন না যে, চিকিৎসা করার সময় কোনো ছোঁয়াচে রোগে আপনারাও আক্রান্ত হতে পারেন। তবু তো চিকিৎসাবিদ্যায় পড়েছেন, কেন পড়েছেন জানতে চাইলে গালভারী করে বলবেন, মানুষের সেবা করার জন্য।

তাহলে এখন কেন করোনার ভয়ে অন্য রোগে আক্রান্তদেরও চিকিৎসা দিচ্ছেন না। এ কেমন বিচার? দেশে যেখন মহামারী তখন আপনারা ঘরে বসে থাকবেন?

হ্যাঁ আমি মানছি, সরকার আপনাদের নিরাপত্তা দিতে পারছে না। যা করার দরকার ছিল সেটা হচ্ছে না। আপনারাও মানুষ, আপনাদেরও বাঁচার অধিকার আছে। সব ঠিক আছে। তাই বলে, করোনা সন্দেহে আর কাউকেই চিকিৎসা দেবেন না আপনারা? এ কেমন বিচার?

আপনারা কি চিকিৎসা বিদ্যায় পড়ার সময় ভেবেছিলেন ইউরোপে প্র্যাকটিস করবেন? আর বাস্তবে দেখলেন, এসে পড়েছেন বাংলাদেশে? যখন এই পেশায় আসবেন ঠিক করলেন, তখন জানতেন না এটা বাংলাদেশ? এখানে সবকিছু সহজলভ্য নয়, সব সুবিধা পাওয়া যায় না, পায়ে পায়ে মৃত্যু ঘোরে, এটা জানতেন না?

আমি বারবারই বলছি, আপনাদের প্রশ্ন থাকলে রাষ্ট্রকে করুন, রাষ্ট্রকে ধরুন, রাজনীতিবিদদের ধরুন। সাধারণ মানুষকে প্রতিপক্ষ বানিয়ে কী লাভ? সাধারণ মানুষ বোকা, অর্বাচীন, অর্ধ শিক্ষিত, এরা ছুরি কাঁটাচামচ দিয়ে খেতে পারে না, এরা নিজের ভালো বোঝে না, বা অন্যভাবে বললে, নিজের ভালো কীভাবে বুঝতে হয় সেটাই এদের শেখানো হয় না।

এরা জানে স্থানীয় ঠিকাদার রাস্তার কাজ হাতে নিলে তাতে নয়ছয় করে, তাই যখন সেই রাস্তার কাজ সেনাবাহিনীর দায়িত্বে যায়, তখন এরা স্বস্তির নিঃশ্বাস ফ্যালে, ভাবে এইবার ঠিকঠাক কাজ হবে। সেনাবাহিনী তাদের কাছে আস্থার নাম, তাই সরকার যখন সেনা মোতায়েন করে বলে ঘরে থাকুন, তখন এরা বোঝে, আসলেই ঘরে থাকতে হবে। সেই সেনাবাহিনীর সদস্যদের জন্য এরা প্রতিপক্ষ কিভাবে হয়, বলবেন?

ডায়ারিয়ায় মৃতপ্রায় সন্তানকে যখন একজন চিকিৎসক সুস্থ করে তোলেন, হয়ত খুব সামান্য বিদ্যা প্রয়োগ করে, তখনও এরা সেই চিকৎসককে স্রষ্টার প্রেরিত দূত মনে করে ভক্তি করতে শুরু করে। সেই চিকিৎসক যদি সেবা না দিয়ে দুয়ার বন্ধ করে রাখেন, তাহলে এই সাধারণ মানুষগুলো কোথায় যাবে?

আমি খুব অবাক হয়ে লক্ষ করি, আমার বন্ধু তালিকায় থাকা ‘সেনসেবল’ মানুষগুলোও (যারা বিশেষ পেশার সদস্য বা তাদের পরিবার) দুর্যোগের সময় কেমন ‘আনসেনসেবল’ আচরণ শুরু করেন। আমার কষ্ট হয়। যে জীবন তারা বেছে নিয়েছেন, তা সব জেনে বুঝেই নিয়েছেন। তাহলে এখন কেন এই আচরণ?

একজন সাংবাদিক কী জানতেন না যে দুর্যোগে তাকে ভয়াবহ পরিস্থিতির মধ্যে সংবাদ সংগ্রহ করতে হবে? তিনি তো কাউকে দয়া করছেন না। তার কাজই হলো মানুষকে খবর জানানো। তিনি কেবল তার তার কাজটাই করছেন। বাড়তি কিছু না। তাহলে কেন মনে করবেন যে, তিনি বিরাট কিছু করে ফেলছেন?

আবার পুলিশ সদস্যরা যখন এলাকায় মাইকিং করছেন, সবাইকে ঘরে থাকতে বলছেন, আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির দিকে নজর রাখছেন, তখনও তিনি তার দায়িত্বই কেবল পালন করছেন। দয়া বা করুণা করছেন না। এই কাজের জন্যই আসলে তাকে বেতন দেওয়া হয়। তারা জেগে থাকেন তাই সাধারণ মানুষ নিশ্চিন্তে ঘুমিয়ে থাকেন বিষয়টা কিন্তু তা না। বরং সাধারণ মানুষ যেন নিশ্চিন্তে ঘুমাতে পারেন, সে কারণেই তাদের নিয়োগ দেওয়া হয়।

(ব্যতিক্রম আছে। সাংবাদিক মারধর, চিকিৎসক লাঞ্ছণা, আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সঙ্গে সংঘর্ষ এসব ঘটনা ঘটে, স্বীকার করে নিচ্ছি। কিন্তু এসবের পেছনের মনস্তত্ত্বটাও ভাবতে হবে। কোন বঞ্চণা বা প্রেক্ষাপট থেকে এসব ঘটে সেগুলো বিশ্লেষণ করতে হবে। হয়ত দেখা যাবে, এর পেছনেও আছে সেই অসমবণ্টনের খেলা।)

একটা দেশ তৈরি হতে, এগিয়ে যেতে সব শ্রেণি-পেশার মানুষ প্রয়োজন। সবাই হাতে হাত রেখেই দেশকে এগিয়ে নেয়। এটা ভাবার কোনো কারণ নেই যে কেবল বিশেষ পেশার মানুষেরাই দেশকে এগিয়ে নিয়ে যান। যদি তাই হতো, তাহলে পৃথিবী এগোতোই না। স্রেফ থমকে থাকতো।

ভয়ানক একটা দুর্যোগের সময় পেরোচ্ছি আমরা। এটা কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে (করোনার ঝুঁকির কারণে হাতে হাত রেখে, কথাটা বলা গেল না) কাজ করার সময়। এই দুর্যোগ থেকে বেঁচে ফিরলে দুনিয়ার অসমবণ্টন নিয়ে কথা বলা যাবে, নিজের পক্ষে জোর গলায় আওয়াজ তোলা যাবে। কিন্তু বাঁচতে হলে সবার সম্মিলিত প্রচেষ্টা লাগবে। পক্ষ-বিপক্ষের খেলা খেলে অন্তত এই অবস্থা থেকে বাঁচা যাবে না।

মানুষের প্রতি ভালোবাসা আর বিশ্বাসই তৈরি করবে নতুন পৃথিবী। সেই পৃথিবীতে সকাল দেখার প্রত্যাশা করে গেলাম।

(বিশেষ দ্রষ্টব্য: কোনো শ্রেণি-পেশার মানুষের প্রতি আমার ব্যক্তিগত কোনো বিরোধ নেই। নৃবিজ্ঞানে লেখাপড়া করা আর বেশ বড় একটা সময় সাংবাদিকতার চর্চা করায়, যে কোনো বিষয় নিরপেক্ষভাবে দেখতে চেষ্টা করি আমি। আমার পরিবারে সেনা সদস্য, পুলিশ সদস্য, সরকারি চাকরিজীবী, চিকিৎসক, ব্যাংকার সবাই আছেন। সবার প্রেক্ষাপট আমি বুঝি বা বোঝার চেষ্টা করি। সে কারণেই আমি জানি, ‘দেশ মানে, এক লোকের পাশে অন্য লোক’।)

শেখ সিরাজুম মুনিরা নীরা: সাংবাদিক