ফেমিনিজম আর পুরুষ কি একে অপরের মুখোমুখি?
তৌকির ইসলাম।। বিশ্বে বহুল আলোচিত তাৎপর্যপূর্ণ শব্দের একটি এখন ফেমিনিজম। ফেমিনিজমের শুরুটা উন্নত বিশ্বে হলেও এর বাতাস বইছে আজ সর্বত্র, হয়তো কম বেশি। কিন্তু আমাদের সাউথ এশিয়ান সামাজিক কনটেক্সটে ফেমিনিজম নিয়ে রয়েছে নানা মতামত, নানা বিশ্লেষণ। অন্তরে শতভাগ পুরুষতন্ত্রকে ধারণ করে নিজেকে ফেমিনিস্ট দাবি করে কেউ গর্ববোধ করেন, আবার কেউ বুঝেনই না ফেমিনিজম কী! অথচ ফেমিনিজম নিয়ে তার মাথা ব্যাথায় প্রকৃত ফেমিনিস্টরা ব্যথিত। দুই চোখে ফেমিনিজমকে সহ্যই করতে পারেন না আবার সমঅধিকার নিয়ে কথা বলেন এহেন মানুষও কম নয়।
একটু বিশ্লেষণ করলে আমরা হয়তো দেখতে পাব যে, পুরুষের বিরুদ্ধে নয় বরং সমাজে, অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক ক্ষেত্রে যে পুরুষতন্ত্র বিদ্যমান যার দ্বারা নারীর অধিকার ক্ষুণ্ণ হয়েছে সেই ধরনের ব্যবস্থা থেকে নারীর অধিকার ও নারীকে আর্থসামাজিক প্রেক্ষাপটে সুরক্ষিত করতে ফেমিনিজমের জন্ম এবং আজকের পথচলা। এই চলার পথ খুব মসৃণ নয়। কুসংস্কার আর ধর্মীয় গোঁড়ামিতে ভরা একটি পুরুষতান্ত্রিক সমাজ ব্যবস্থায় ফেমিনিজমের সুফল শতভাগ ভোগ করা কখনোই সম্ভব নয়। কেননা পুরুষতন্ত্র পুরুষকে কখনোই নারীকে মানুষ ভাবতে শেখায়নি, কখনো নারীকে অধিকার দেওয়ার কথা বলেনি বরং নিজের কর্তৃত্বকে বহাল করে রাখতে নারীর প্রতি সহিংস হতে শিখিয়েছে।
আমি ব্যক্তিগতভাবে বিশ্বাস করি নারীদের একটি বড় অংশও ফেমিনিজমকে বুঝতে পারেননি। আমাদের নারীদের এক বিরাট অংশ মনে করেন যে ফেমিনিজম নারীর সংসারে অশান্তির কারণ, নারীর ধর্ম পালনের পথে বাঁধা। কিন্তু তারা ভুলেই যান যে তাদের এই বাকশক্তি ফেমিনিজমের আশীর্বাদপুষ্ট। আবার তাদের এই ধারণার জন্য দায়ী কিছু নামধারী ফেমিনিস্ট যারা পুরুষতন্ত্রে হোঁচট খেয়ে পুরুষতন্ত্রের বিরুদ্ধে কথা না বলে সমগ্র পুরুষজাতির বিরুদ্ধে কথা বলেন, ফলশ্রুতিতে ঘটে বিপত্তি। আমাদের ধর্মীয় জ্ঞান গোঁড়ামিতে ভরপুর। মাথায় টুপি মুখে দাঁড়ি কিংবা গায়ে পৈতা থাকলেই যে তিনি প্রকৃত যোগী নন তা আমরা জানতেও রাজি না আর মানতে তো আরও রাজি না। এমন ব্যক্তি, যে নিজেই বোঝে না ফেমিনিজম কী, তার কাছে ফেমিনিজমের তর্জমা জানতে গেলে ফতোয়া শুনতে হয় এটাই স্বাভাবিক। একে তো তিনি নিজেই পুরুষ, তার উপর ফেমিনিজম বিদেশি শব্দ, তার কাছে অপশব্দ, সাথে সমাজের চোখে কথিত যোগী তিনি, সুতরাং ভুলভাল বলে দক্ষিণার কমতি হয় না।
আসলে ফেমিনিজম নারীপুরুষ সকলের জন্য। ভাবছেন কীভাবে! ফেমিনিজম নারীকে পুরুষের বিরুদ্ধে নয় পুরুষতন্ত্রের বিরুদ্ধে তার প্রতিবাদ, তার অধিকারের কথা শেখায়। আর পুরুষকে শেখায় কী করে নারীকে সমঅধিকার দিতে হয়। সমঅধিকার বলতে আমি বিশ্বাস করি নারীকে কোন কিছুতে খাটো করে না দেখা বরং পুরুষের পাশাপাশি নারীকে যথাযথ সম্মান দেওয়া। সমঅধিকার হল এমন যে একই সময় কর্মস্থলে ব্যয় করে একই পদে চাকরি করে একই শিক্ষাগত যোগ্যতাসম্পন্ন একজন পুরুষ ও একজন নারীর পারিশ্রমিক সমান হবে; বায়োলজিক্যাল আইডেন্টিটি ভিন্ন বলে স্যালারি স্ট্রাকচার ভিন্ন হবে এমন নয়।
ফেমিনিজম নারীপুরুষকে প্রতিদ্বন্দ্বী হিসেবে নয় বরং সমানভাবে সুস্থ প্রতিযোগী হিসেবে জ্ঞান করে যেখানে মানুষ হিসেবে সে তার প্রাপ্য সম্মান ও অধিকারটুকু পাবে। কেউ কারো উপর কর্তৃত্ব খাটাবে না। যৌক্তিক হলে একজন নারীর বক্তব্য যে গ্রহণযোগ্য তা ফেমিনিজম সমাজকে শিক্ষা দেয়। ফেমিনিজম নারী যে একজন মানুষ, তারও যে স্বতন্ত্র মন আছে, শরীর আছে, মেধা আছে, মেধা বিকাশের সুযোগ আছে তা সমাজকে তথা পুরুষতন্ত্রকে বুঝাতে চায়। ফেমিনিজমের লক্ষ্য হলো নারীর ইচ্ছাকে প্রাধান্য দেওয়া। যে নারী ঘরে থাকতে চান তাকে নিয়ে ফেমিনিজমের কোন আপত্তি নেই কিন্তু ঘরে থাকা নারীর অধিকার সুরক্ষিত কিনা তা নিয়েই ফেমিনিজম চিন্তা করে। কর্মস্থলে নারীর অধিকার সুরক্ষিত কিনা তা ফেমিনিজম ভাবে।
ফেমিনিজম আর পুরুষ দুটো মুখোমুখি বিষয় নয় বরং পাশাপাশি বিষয়। কারণ নারী পুরুষের অধিকার সমুন্নত রেখেই একটি সুস্থ সুন্দর পৃথিবী সৃষ্টি করা সম্ভব।
[ফেমিনিস্ট ফ্যাক্টরে প্রকাশিত মুক্তমত লেখকের নিজস্ব বক্তব্য]