নারী তো চিজ্ বড়ি হ্যায় মাস্ত মাস্ত!
মহুয়া ভট্টাচার্য।। নব্বইয়ের দশকের একটি জনপ্রিয় হিন্দি সিনেমার গান- তু চিজ্ বড়ি হ্যায় মাস্ত মাস্ত। কবিতা কৃষ্ণমূর্তি এবং উদিত নারায়ণের কণ্ঠে গানটি যথেষ্ট জনপ্রিয়তা পেয়েছিল, বিশেষত তরুণ প্রজন্মের কাছে। এই গানের বদৌলতে কবিতা তখন তার ক্যারিয়ারে জনপ্রিয়তার শিখরে। একদিন বান্ধবীর বাসায় ডাক পড়লো তার। বান্ধবীর বাবা হলেন কিংবদন্তি গায়ক মান্না দে। তিনিই ডেকে পাঠিয়েছেন কবিতাকে। ডেকে নিয়ে সেদিন কন্যার বান্ধবীটিকে মান্না দে চূড়ান্ত ভৎসনা করেছিলেন। কেন জানেন? যে গানে নারীকে ” চিজ্” বলে সম্বোধন করা হয়, সেই গান কবিতা গাইলেন কোন আক্কেলে!
এবার মাত্র দু’দিন আগের কথা বলি। অফিস থেকে ফিরছি। আমার সাথে একটি আদিবাসী মেয়ে। আমি তার সাথে একটি কামরা শেয়ার করে থাকি, ভাবলাম দুজনে কিছু বাজার সদাই করে রাখি। লকডাউনের ফাঁদে পড়ে মধ্যবিত্তের জেরবার। হাত পেতে সাহায্য চাইতেও লজ্জা লাগে, অথচ পেটের খিদের বিরাম নেই। জিনিসপত্রের দাম বাড়ছে হু হু করে। এই অবস্থায় করোনায় যত না মানুষ মরবে, তারচেয়ে বেশি মরবে হয়তো খেতে না পেয়ে। তো এসব আগপাছ ভেবে অন্তত আরো কিছু চাল, ডাল আর আলু কিনে রাখবো ভেবে মেয়েটিকে নিয়ে বের হলাম।
দুজনে রিকশায় চেপেছি। ওর মুখে মাস্ক, আমি ভুলে মাস্ক ব্যাগ থেকে বের করার কথা বেমালুম ভুলে গিয়ে তার সাথে কথায় মত্ত। হঠাৎই পাশ থেকে শিস বেজে উঠল। চট্টগ্রাম কলেজ আর মহসিন কলেজের দিকটাতে রাতে পর্যাপ্ত আলো কোনকালেই ছিল না।বরাবরই আবছা আলো আঁধারি পরিবেশ। রিকশার পাশ দিয়ে হেঁটে যেতে যেতেই যে ছেলেরা আমাকে অশ্লীল ইঙ্গিত করে মাস্ক পড়ার উপদেশ দিল, তারা বলতে গেলে আমার সন্তানের বয়সী। চেপে গেলাম, বললাম না কিছু। তারাও গান গাইতে গাইতে চলে গেল। গানটা কানে লাগলো, “বড় লোকের বেটি লো, লম্বা লম্বা চুল।” মনে মনে ভাবছিলাম, এই গান তো আজকাল বড় একটা শোনা যায়না। আমরা ছোটবেলায় শুনতাম।
সারাদিনের ক্লান্ত অবসন্ন শরীর বিছানায় এলিয়ে দিলেও সহজে আমার ঘুম আসে না। ইনসমনিয়া কাটছে তবে এখনো রেশ রয়ে গেছে। যেন বিগত দিনের পুরোনো প্রেমের স্মৃতির মত মাঝেমাঝে বিদ্রোহী হয়ে ওঠে। যেন তাকে ভুলে যাওয়া অন্যায়। প্রচন্ড শক্ত করে লাগাম টেনে রাখা মনকেও শিরিষতলায় অপেক্ষারত ভুলে যাওয়া মুখের সামনে দাঁড় করাবেই ইনসমনিয়া। তখন আঁতিপাতি করে খুঁজে ফিরি রবীন্দ্রনাথকে। ইউটিউব ভরসা। খুঁজতে গিয়েই সেই গানটি পেলাম- লাল গেঁন্দা ফুল। স্রষ্টা রতন কাহার নামটি কোথাও নেই, রয়েছে বাদশা নামে একজন কারো নাম।
নায়িকা জেক্যুলিন আর বাদশা নামের আর্টিস্ট যিনি এই গানের ভোকালিস্ট ও কম্পোজার – দুজনে মিলে গানটির দফারফা করে ছেড়েছেন। সবচেয়ে আপত্তিকর গানটির মাঝখানে সংযোজিত কথাগুলো। কোথাও জ্যাকুলিনের শরীরের বর্ণনা মাখনের সাথে তুলনা, কোথাও শক্কর বা চিনির মত মিঠি। গানের ভিডিওতেই অশালীন অঙ্গভঙ্গি এই কম্পোজারের। নারীকে কিংবা নারীর শরীরকে এমন খাদ্যবস্তু হিসেবে তুলনা করার মানসিকতা আগেই তৈরি হয়ে গেছে এবং তা আমাদের নাকের ডগা দিয়েই চলেছে দাপিয়ে। ইয়ো ইয়ো হানি সিং নামে এক গায়কের গানের কথাও এমনই অশ্লীলতায় পরিপূর্ণ। আমাদের তরুণ প্রজন্ম এই গানগুলো আওড়াচ্ছে প্রতিনিয়ত। এই গানের লিরিক্স কিংবা ভিডিওগুলো ধর্ষণ কিংবা ইভ টিজিংয়ের রসদ যোগাচ্ছে তা আর বলার অপেক্ষা রাখে না।
আর আমাদের লোক ঐতিহ্যের অংশ এই গানগুলো নিয়ে তো পশ্চিমবঙ্গেই প্রথম ছেলেখেলা শুরু হয়ে গিয়েছিল। আজকাল বহু জনপ্রিয় লোকগানের মূল রচয়িতা কিংবা সুরকারের নাম আমরা ভুলতে বসেছি। আমাদের ভুলিয়ে দেওয়া হচ্ছে। বিভিন্ন চ্যানেলের রিয়ালিটি শোগুলোতে গানগুলো দাপটের সাথে গেয়ে বাহবা কুড়োচ্ছেন শিল্পী আর কম্পোজারেরা। নিতান্ত অপারগতায় মূল শিল্পীর নাম বলা হলেও তার নামের বানানটি এমন বিদ্ঘুটে ভুল বানানে লেখা হয় আর এত অসুন্দর উচ্চারণে উপস্থাপক বলেন, তৎক্ষনাৎ মনে হয় আমার দেশের ধুলো কাদা মাখা কবি, গায়ক, বাউল, সাধকদের মিঠা সেই সুর আমি বিদেশিদের কাছ থেকে ছিনিয়ে এনে আমার বুকে আগলে রাখি।
ইন্টারনেট সংস্কৃতি দিয়েছে অনেক অনেক! নয়তো এই হোম কোয়ারান্টাইন নামের দুঃখের দিনে আপনি, আমি তো ঘরে বসে পাগলপ্রায় হতাম! কিন্তু মান্না দে হারিয়ে গেলেন। জীবনের জলসাঘর থেকে বিদায় নিয়ে যে মান্না দেরা চলে গেলেন। রয়ে যাচ্ছে এইসব সস্তা চটুল গান, যা প্রতিনিয়ত নারীকে চিজ্ হিসেবে উপস্থাপন করছে, যা শুনলে মনে হয়, সামনে নয়, নারীর সময় তাকে ক্রমশ পিছনের দিকে ঠেলছে।