মিম-এ্যানীর ঘটনায় নারীবাদের সাধারণীকরণ
বাপ্পাদিত্য বসু।। ঢাকার উত্তরায় নারী অধিকার আন্দোলনের কর্মি ও স্থপতি সাইয়্যেদা সুলতানা এ্যানী কর্তৃক গৃহসহকারী পাপিয়া আক্তার মিমকে নির্যাতনের ঘটনায় ফেসবুকে আমার একটি পোস্ট ভাইরাল হওয়ার প্রেক্ষিতে কিছু জরুরি কথা বলা খুব প্রয়োজন বলে মনে করছি। এই লেখাটি লিখছি যখন, তখন পর্যন্ত আমার ওই পোস্টের লাইক বা রিঅ্যাক্ট সংখ্যা ১৬শ’ ছাড়িয়েছে এবং শেয়ার প্রায় হাজারের কাছাকাছি। এর বাইরেও আরো প্রায় শ’ খানেক আইডি থেকে আমার পোস্টটি কপি-পেস্ট করা হয়েছে। এছাড়াও আমার ওই পোস্ট থেকে উদ্ধৃত করে বেশ কয়েকটি নিউজ পোর্টাল ওই ঘটনার সংবাদ প্রকাশ করেছে। এ সংখ্যা থেকে আমাকে তথাকথিত ফেসুবক সেলিব্রেটি বলে মনে হতে পারে। কিন্তু আমি জানি, কাল যখন আমি কোনো এক মৃত্যুপথযাত্রী মানুষের জীবন বাঁচাতে এক ব্যাগ রক্ত চেয়ে পোস্ট করবো ফেসবুকে, তখন তাতে সাকুল্যে লাইক সংখ্যা ৩০ আর শেয়ার ১০ ছোঁবে না। মানুষ আসলে ইস্যু চায়। সেই ইস্যুকে আবার যার যার মতো করে ব্যবহার করতে চায়। আমি এই শেয়ার ও লাইক সংখ্যার কিছু মনস্তাত্ত্বিক নেপথ্য ঘটনা তুলে ধরার চেষ্টা করছি।
নারী আন্দোলনের সংগঠক এবং বামপন্থী আদর্শের কথা বলা এ্যানীর নিজেরই নারী নির্যাতকের ভূমিকায় অবতীর্ণ হওয়ার মধ্য দিয়ে তিনি তার ভেতরের যে কদর্য রূপ তুলে ধরেছেন, তার প্রকাশ ও এই নির্যাতনের ঘটনা যেন বিচারহীনতার মিছিলে হারিয়ে না যায়, সে দাবি উপস্থাপন করা ছিল আমার লক্ষ্য। আমি শেষ পর্যন্ত এ দাবি জানিয়েই যাবো।
কিন্তু যারা আমার এ পোস্ট শেয়ার করছেন, তারা কারা? তাদের এ শেয়ারের উদ্দেশ্যই বা কী? আমি দৈবচয়নের ভিত্তিতে এসব শেয়ারকারীদের মধ্যে অন্তত একশ’ প্রোফাইল বিশ্লেষণ করার চেষ্টা করেছি। এদের ভিতর প্রায় সমানুপাতে আওয়ামী লীগ, বিএনপি, বামপন্থী, সাম্প্রদায়িক, ঘৃণাজীবী, জামাতী মতাদর্শের লোক খুঁজে পেয়েছি। আসুন, একটু দেখে নেওয়া যাক।
শেয়ারকারীদের মধ্যে কেউ কেউ এ্যানীর পুরনো রাজনৈতিক মতাদর্শ তথা বামপন্থাকে সাধারণভাবে আক্রমণ করেছেন। এটা আমাদের দেশের মানুষের একটা স্বাভাবিক প্রবৃত্তি। এদের মত করেই এ পক্ষের লোকজনও যখন আওয়ামী লীগ করা একজন ত্রাণের চালচোর ধরা পড়ে, তখন তাকে ব্যক্তি অপরাধী হিসেবে না ধরে তার দলীয় পরিচয়কে বিশেষায়িত করে দল বা মতাদর্শকে গালিগালাজের বহর ছোটান। আমি এ উভমুখী ঘৃণাপ্রবৃত্তির বিরোধিতা করে যাচ্ছি। এই করোনাকালে সমাজের নিচের তলার মানুষের জন্য উপরতলার মানুষের কার কী করার ছিলো বা কে কী করেনি তা ভুলে আমি কেবল কে কী করেছে মানুষের জন্য সেই ইতিবাচক গল্পগুলোই করে যাচ্ছি গত কিছুদিনে। যখন আওয়ামী লীগের কেউ ভালো কোনো কাজ করছেন, তখন তাকে ধন্যবাদ দিচ্ছি। যখন বামপন্থী কেউ ভালো কাজ করছেন, তখন তাকে ধন্যবাদ দিচ্ছি। আমার ফেসবুক প্রোফাইলে সাম্প্রতিক সময়কে একটু ঘাঁটাঘাঁটি করলে যে কেউ তা দেখতে পাবেন।
আবার বামপন্থী শেয়ারকারীদের ভিতর যে সাধারণ প্রবণতা দেখলাম, তার সারকথা হলো, একে অপরকে খোঁচাখুঁচি করা আর নিন্দামন্দ করা। বাংলাদেশের বামপন্থী দলগুলোর বহুধাবিভক্তির ইতিহাস ও কারণ বিশ্লেষণ করলে পাঠক নিশ্চয় ব্যক্তি ও ক্ষুদ্র গোষ্ঠীগত দ্বন্দ্ব ছাড়া আদতে কোনো আদর্শিক ব্যাপারস্যাপার কখনোই খুঁজে পাবেন না। ফলে ছাত্র ইউনিয়ন সমর্থিত একজন প্রাক্তন ছাত্রনেতার দোষ পাওয়ায় অন্যরা বেশ উৎফুল্লই বটে। আবার উল্টোটা যখন এদেশের রাজনীতি বা সমাজের কোনো পর্যায়ে ঘটে, অর্থাৎ অন্য কোনো বামপন্থী কারো কোনো দোষের খবর পেলে চুটিয়ে মজা উপভোগ করে ছাত্র ইউনিয়নের প্রাক্তন-বর্তমান সদস্যরাও। এগুলোর উর্ধে উঠে বাম প্রগতিশীল রাজনৈতিক দর্শনের ঐক্যচিন্তা এদেশে কখনোই হয়নি আর অদূর ভবিষ্যতে সে সম্ভাবনাও দেখা যাচ্ছে না।
আর সাম্প্রদায়িক মোল্লাতন্ত্রের আদর্শধারীরা তো বেশ আরেক কাঠি সরেস। এই গোষ্ঠীর লোকেরা তো নারীর যেকোনো অগ্রগতির বিরোধী। তাই হুট করে সমাজের এমন এক অগ্রবর্তী নারীর একটা বিরাট দোষ পাওয়া গেছে বলে তাদের আনন্দের কোনো সীমা নেই। এই নির্যাতনের ঘটনার বিচার বা ভিকটিম মিমের সুবিচার পাওয়ার বিষয়টা কোনোভাবেই এই গোষ্ঠীর কাছে মুখ্য বিষয় ছিলো না। বরং একজন শিক্ষিতা, পেশাজীবী, অগ্রবর্তী নারীর কৃত অপরাধকে পুঁজি করে নারীর অগ্রগতির বিরুদ্ধে তাদের আস্ফালনের একটা নতুন পথ পেয়েছে। আমার পোস্ট শেয়ার করার ক্ষেত্রে সাথে লিখে দিচ্ছে- “মাগীদের স্বাধীনতা দিলে এমনই হবে।”
আরেকটি শ্রেণির মানুষ যাদের কেউ মৌলবাদী সাম্প্রদায়িক, কেউ আওয়ামী লীগ, কেউ বিএনপি, কেউ বামপন্থী- এরা মিম-এ্যানীর এই ঘটনাকে পুঁজি করেছেন সবচেয়ে দারুণভাবে। তারা ‘নারীবাদবিরোধী’। কিন্তু আদতে নারীবাদ যে আসলে কী, তা তারা নিজেরাই বোঝেন কিনা সন্দেহ। এই গোষ্ঠীর মধ্যে প্রচুর পুরুষের পাশাপাশি প্রচুর নারীও আছেন বৈকি! আমার পোস্ট শেয়ারকারীদের মধ্যে এদের সংখ্যাই সর্বোচ্চ। কারণ এরা ধর্মেও আছেন, জিরাফেও আছেন। সকল অংশের ভিতর এরাই কমন। তাদের ভাবখানা এমন- “দেখ শালা নারীবাদীরা, কেমন লাগে!” এদের বক্তব্য- “নারীবাদীরা আজ কোথায়? নারীবাদী নেত্রীর মনের ভিতর এমন পাপ, বাকি সব নারীবাদীরাও এমনই হয়।”
আরেকটু বিস্তারিত বলতে চাই এ বিষয়ে। নারীবাদ নিয়ে কোনো তাত্ত্বিক আলোচনায় যাবো না। আমি সহজসরলভাবে নারীবাদ বলতে বুঝি মানুষ হিসেবে নারীর সমান অধিকার নিয়ে মাথাটাকে সমান উঁচুতে তুলে বাঁচা। এটুকুই। এখন আপনি (পুরুষ বা নারী যাই হোন না কেন) যদি মানুষ হন, তাহলে আপনি নারীবাদী। আর যদি নারীবাদী না হন, তাহলে আপনি মানুষই না। মানুষ হিসেবে এই সৃষ্টিজগতের কিছু মানুষ এক রকম অধিকার আর মর্যাদা ভোগ করবে, আরেক দল এই অধিকার আর মর্যাদা থেকে বঞ্চিত হবে- এটা মানুষের কাজ নয়, মানুষের আচরণ নয়। আমি ব্যক্তিগতভাবে নিজের জীবনে হাজারটা অন্যায় করলেও একটা ইথিক্স ধারণ করার সাধনা করি- মানুষ হিসেবে অপর মানুষকে তার মর্যাদাবোধে আঘাত না করা। কোনোদিন যদি এই ইথিক্স থেকে আমি কখনো সরে যাই, সেদিন মানুষ হিসেবে আমার অপমৃত্যু ঘটবে।
এই অপর মানুষ পুরুষও যেমন, নারীও তেমন। কোনো মানুষ (পুরুষ বা নারী) নারীকে তার জন্মগত কারণে, শারীরিক গঠনজনিত কারণে, কর্মগত কারণে বা অন্য কোনো কারণে মর্যাদাবোধে আঘাত করলেই সে আর মানুষ থাকে না। সে তখন পুরুষ বা নারী অর্থাৎ মানুষ থাকে না। সে তখন স্রেফ পরিণত হয় অমানুষে। যখন কেউ অন্য নারীকে ধর্ষণ বা যৌন নিপীড়ন করে, যখন শারীরিক, মানসিক বা সামাজিকভাবে হেয় করে, এমনকি কথা বা লেখা দিয়েও অমর্যাদা করে, তখন আর সে পুরুষ বা নারী বা মানুষ কিছুই থাকে না, হয়ে পড়ে অমানুষ। এই অমানুষেরা লিঙ্গগতভাবে পুরুষ বা নারী যে কোনো গঠনের হতে পারে।
আজ যখন সাইয়্যেদা সুলতানা এ্যানী তার গৃহসহায়িকা পাপিয়া আক্তার মিমকে নির্যাতন করেছেন, তখন তিনিও আর নারী বা মানুষ কিছুই নেই, হয়ে পড়েছেন কেবল এক অমানুষ। এই অমানবিক আচরণের পক্ষ যারা নিচ্ছেন, তারাও প্রকারান্তরে অমানুষই হয়ে পড়ছেন। আবার কেবল এ্যানীর অপরাধের কারণে যে সকল পুরুষ ও নারী সকল নারীবাদী আন্দোলনের কর্মিদের গালিগালিজ করছেন, তারাও তাদের পৌরুষত্ব বা নারীত্ব তথা মনুষ্যত্ব হারিয়ে কেবল অমানুষের কাতারে দাঁড়াচ্ছেন।
বলে রাখা দরকার, মিম-এ্যানীর এই ঘটনাটা আমাকে জানিয়েছেন একজন নারী যিনি আবার নারীবাদী লেখালেখি ও কর্মকাণ্ডের সাথেও জড়িত। ঘটনার পরদিন সকাল থেকে আমার পরিচিত নারীবাদী আন্দোলনের সাথে জড়িত সব নারীদের ফেসবুক আইডি আমি দফায় দফায় ঘুরে দেখেছি, তাদের মধ্যে একজন মাত্র নির্যাতক অমানুষ এ্যানীর পক্ষে লিখে নিজেকে ওই কাতারে নিয়েছেন। বাকি সবাই, হ্যাঁ, সবাই এ্যানীর বিচার চেয়ে মিমের পাশে দাঁড়িয়েছেন। অর্থাৎ আমার এই বোনেরা তাদের মনুষ্যত্ব বিসর্জন দেননি। বিপরীতে নারীবাদবিরোধী যারা তারা একজন এ্যানীর অপরাধকে পুঁজি করে সচেতন বা অবচেতনভাবে নারীবাদ, নারীবাদী আন্দোলন এবং নারীবাদী আন্দোলনের এক্টিভিস্টদের বিপক্ষে কেবল ঘৃণা ছড়িয়ে গেছেন। তাদের বক্তব্যের সারকথা মোটামুটি এ ধরনের- “নারীবাদ বলতেই এ ধরনের ভণ্ডামি”, “নারীবাদ মানে নিজের স্বামীকে ফেলে রেখে পরপুরুষের সাথে অবাধ যৌনাচারের স্বাধীনতা”, “নারীবাদ মানেই ওপেন সেক্স আর পুরুষের সাথে বসে সিগারেট আর গাঁজা টানা”, “নারীবাদীদের জামাই টেকে না” ইত্যাদি। এমনকি এক পরিচিতা নারীকে লিখতে দেখলাম, “নারীবাদীদের জামাই লাগে না, এরা সবাই ডিভোর্সী নয়তো সামনে ডিভোর্স হবে নয়তো সংসারে ঝামেলা চলে।” বলতে দ্বিধা নেই, এই পরিচিতা নারী আমার বেশ ঘনিষ্ঠ এবং সেই ঘনিষ্ঠতার সুবাদে তার সংসারে কতোখানি ঝামেলা চলছে, সেই সংসার যে ভাঙার উপক্রমে পৌঁছেছে এবং ভাঙার জন্য ওই নারীই যে বেশি উদগ্রীব তা আমি বেশ ভালো করেই জানি। জানি এ কারণে যে সেই সংসারটি গড়ার সময়টিতেও যেমন আমি ছিলাম, এখন ভাঙন ঠেকাতেও আমি সর্বাত্মক চেষ্টা করে যাচ্ছি। এই যে নারীবাদের বিরুদ্ধে গড়পড়তায় বিষোদ্গার করে চলেছেন যেসব পুরুষ ও নারীর দল, তারা কার্যত সবাই তাদের মনুষ্যত্বকে বিসর্জন দিয়েছেন।
আবার বিপরীতক্রমে নারীবাদের নামে এক ধরনের অহেতুক পুরুষবিদ্বেষী মনোভাব পোষণকারী নারীও আমাদের সমাজে আছেন। তাদের একটা বড় অংশ কোনো না কোনো পারিবারিক বা আর্থ-সামাজিক কারণে কখনো না কখনো পুরুষ দ্বারা নিপীড়িত বা বঞ্চিত হয়েছেন বলে মনের ভিতরে জগতের সকল পুরুষ সম্পর্কে এক সাধারণ ঘৃণা পোষণ করেন। আমি এদের দোষী মনে করি না, বরং মনে করি, তাদের নিপীড়ন বা বঞ্চনার প্রতিকার পেলে তারা এই ঘৃণার পথ থেকে ভালোবাসার পথে নিশ্চয়ই ফিরে আসবেন। আর একটা অংশ সেসব কোনো কারণের সম্মুখীন না হলেও কেবল ফ্যাশন হিসেবে পুরুষবিদ্বেষী মনোভাব পোষণ করেন। এদের সংখ্যা কম, এদের নারীবাদ সম্পর্কে ধারণার অভাব আছে বলে আমি মনে করি।
আগেও যে কথা বলেছি, সেখানে আবার ফিরে আসি। এ্যানীর কৃত অপরাধের ঘটনায় পুরো একটা দিন ফেসবুকের লেখালেখি পর্যালোচনা করে নারীবাদবিরোধী তথা মানুষ হিসেবে নারীর মর্যাদা দানের বিরোধী পুরুষ বা নারীর সংখ্যাই আমাদের চারপাশে বেশি বলে আমার উপলব্ধি। এই ঘৃণাজীবী পুরুষদের পাশাপাশি যে ঘৃণাজীবী নারীরা আছেন, তাদেরকে সম্পত্তিতে পুরুষের সমান সমান ভাগ দিতে চাইলেও তারা আপনাকে নারীবাদী বলে গালি দেবেন। তার নিজের মর্যাদার কথা বোঝাতে গেলেও তারা আপনাকে নারীবাদী বলে গালি দেবেন। এরা মানুষ হিসেবে অপরের মর্যাদার প্রশ্ন তো পরের কথা, নিজের মর্যাদার প্রশ্নেও তারা কোনোদিন সচেতন নন, হতে চানও না।
নারীবাদ সম্পর্কে এই সাধারণীকরণ আমাদের বাস্তব চিত্র। মিম-এ্যানীর ঘটনা নতুন করে তাকে আবার সামনে নিয়ে এলো মাত্র।
বাপ্পাদিত্য বসু: প্রাক্তন ছাত্রনেতা; সাধারণ সম্পাদক, ইয়ুথ ফর ডেমোক্রেসি এন্ড ডেভেলপমেন্ট
[ফেমিনিস্ট ফ্যাক্টরে প্রকাশিত কলাম লেখকের নিজস্ব মতামত]