ডাইনোসোর, উল্কাপিণ্ড আর বন্ধদেশের গল্প
সাব্বির ইরফান।। কোটি কোটি বছর আগের কথা, পৃথিবী তখন দাপিয়ে বেড়াচ্ছে ডায়নোসোরেরা। শিক্ষিত কুশিক্ষিত অর্ধশিক্ষিত অশিক্ষিত ধর্মান্ধ পুঁজিবাদী সাম্যবাদী ধনী গরীব- নানা ধর্মের নানা কিসিমের ডায়নোসোরদের নিয়ে বৈচিত্রময় পৃথিবী। পছন্দমত সামর্থমত সীমানা বেছে নিয়ে তারা তৈরি করেছে এক একটি দেশ, যারা নিজেদের মধ্যে নানা রকম প্রতিযোগিতা প্রতিদ্বন্দিতা যুদ্ধ- এসবে লিপ্ত। উগ্র জাতীয়তাবাদ, ধর্মীয় মতবাদের মধ্যেই ডায়নোসোরাতাবাদীরা চেষ্টা করে যাচ্ছিল একটি সুখি সমৃদ্ধ পৃথিবী তৈরির জন্য। কিন্তু যারা গরীব-দিনমজুর শ্রেণির ডায়নোসোর তাদের আবার এসব বড় বড় বিষয় নিয়ে ভাববার সময় নেই, নিজের জীবন চালাতে তারাই চালু রেখেছে মিল কারখানা, যাতে ফুলে ফেঁপে উঠছিল এক একজন পুঁজিবাদী ডায়নোসোর। তো যাই হোক এভাবেই প্রেম-ভালোবাসা ঘৃণা ছলছাতুরির মধ্যেই চলছিল ডায়নোসোরদের পৃথিবী। কিন্তু হঠাৎ এক খবরে উল্টেপাল্টে গেলো সব।
“ডাসা” ডায়নোসোরদের সবচেয়ে সমৃদ্ধশালী দেশের মহাকাশ গবেষণা কেন্দ্র, তারা জানালো আর মাত্র কয়েক মাসের মধ্যেই পৃথিবীতে আছড়ে পড়বে এক বিশাল উল্কাপিণ্ড, যাতে ধ্বংস হয়ে যাবে গোটা ডায়নোসোর জাতি। পুরো বিশ্ব দারুণ উৎকণ্ঠায়, নামী-দামী সব ডায়নোসোর বিজ্ঞানীরা নেমে পড়লেন মহাবিপদ থেকে পৃথিবী তথা ডায়নোসোর জাতিকে রক্ষা করতে। কোনোভাবে যদি উল্কাপিণ্ডটির দিক পরিবর্তন করানো যায়, কিংবা কোনোভাবে যদি একে মহাকাশেই চূর্নবিচূর্ণ করা যায়, এসব নিয়েই তাদের কারবার। এর মধ্যে হয়েছে আবার আরেক ঝামেলা, এমন এক সংকটময় পরিস্থিতি থমকে গেছে ডায়নোসোরদের জীবনযাত্রা, যাতে সবচেয়ে ক্ষতিগ্রস্থ হয় অর্থনীতি। এই আকালের জন্য থামেরিকা অর্থাৎ ডায়নোসোরদের সমৃদ্ধশালী দেশ দায়ী করা শুরু করলো “ঠীন” নামের এক দেশকে। এই উল্কাপিন্ড নাকি ঠীনের তৈরি, এমন দাবি থামেরিকার রাষ্ট্রপ্রধানের।
এসব বৈশ্বিক রাজনীতিতে কান দেয়ার সময় নেই বিজ্ঞানীদের। তারা নিজেদের মতো করে কাজ করে যেতে লাগলো। চেষ্টা চালাচ্ছে কীভাবে থামানো যায় এই উল্কাপিণ্ডকে। আবার যদি শেষ পর্যন্ত থামানো না যায়, তাহলে যে কয়জন ডায়নোসোর ভাগ্যগুণে বেঁচে যাবে তারা কিভাবে বিরূপ পরিস্থিতিতে খাপ খাবে সেই গবেষণায় খাওয়া দাওয়া ঘুম হারাম করে তাদের চেষ্টা চলছে।
কিন্তু সেসময় ডায়নোসোর বিশ্বে ছিলো আজব এক দেশ, দেশটির নাম বন্ধদেশ। এমন এক দুর্দিনে একমাত্র দুশ্চিন্তামুক্ত দেশ এটাই। এমনিতেই দেশটি বাকি ডায়নোসোর জাতির কাছে আজব হিসেবেই পরিচিত। অনেকে আবার এই জাতকে চেনে বেঈমান জাতি হিসেবে, কারণ এই দেশটির স্থপতিকে তারাই নাকি সপরিবারে হত্যা করেছিলো! আবার যারা এমন নির্মম ঘটনাটা ঘটিয়েছিলো তাদের নাকি পরবর্তীতে পুরষ্কারও দেয়া হয়েছিল, যদিও অনেক বছর পর সেই সব অপরাধীদের কয়েকজনকে বিচারের আওতায় আনা সম্ভব হয়, তবুও একদল ডায়নোসোর সেসব খুনীদের জন্য সারাক্ষণ সাফাই গেয়ে যায়। কেমন আজব না? মানুষের পৃথিবীতে এটা সম্ভব? অবশ্য তারা তো ডায়নোসোর ছিলো, মানুষ না!
যাই হোক এই দেশটি কেন এতো দুর্দিনেও দুশ্চিন্তামুক্ত, এটা নিয়েই সবার আগ্রহ। সে সময়ে ডায়নোসোরদের এই দেশটিতে দাপট ছিলো একটি বিশেষ গোত্রের ডায়নোগুরুদের। তো তাদের মধ্যেই এক ডায়নোগুরু আবিষ্কার করে ফেললেন কিভাবে থামানো যায় এই উল্কাপিণ্ডকে, শুধু তাই নয় কেন এই উল্কাপিণ্ড পৃথিবীতে আছড়ে পড়বে সেই বিষয়েও বিস্তারিত তিনি বের করে ফেলেছেন, আর এটা তাকে জানিয়েছে খোদ সেই উল্কাপিণ্ড!
বড় বড় বিজ্ঞানীরা সবাই চমকে গেলো, এ কীভাবে সম্ভব? ডায়নোগুরু জানালেন “ফিঠালি” নামক এক দেশ থেকে আরেক আধ্যাত্মিক ক্ষমতার অধিকারী, তারই শিষ্য স্বপ্নে এসব জেনেছেন। আরেক ডায়নোগুরু আবিষ্কার করে ফেললেন উল্কাপিণ্ডে নাকি বন্ধদেশের ডায়নোসোর তো বটেই বিশ্বের এই বিশেষ গোত্রের ডায়নোসোরদেরও কিছু হবে না, হলে নাকি ওই গোত্রের ডায়নোগ্রন্থটাই মিথ্যা হয়ে যাবে। উল্কাপিণ্ডের ভয়ে তখন বন্ধ হয়ে গেছে ডায়নোসোরদের সব ডায়নো উপসনালয়, কিন্তু আজব দেশের আরেক ডায়নোগুরু তিনবার করে বলে গেছেন বন্ধদেশে এসবের কিছুই করা যাবে না। সে সময় আবার প্রাক্তন খেলোয়াড় এক ডায়নোগুরু যিনি আবার একাধিকবার ডাসা থুক্কু ডাশা থেকে ঘুরে এসেছেন এমনকি ডায়নোসোরদের অন্যতম সেরা বিদ্যাপীঠ থেকে কয়েকবার শ্রেষ্ঠ শিক্ষক হয়েছেন, তিনিও জানালেন এসব উল্কাপিণ্ডতে ওই বিশেষ গোত্রের কিছু হবে না। আরেক ডায়নোগুরু বড় বড় বুলি আউড়ে সে সময় পালিয়ে গেছেন উন্নত ডায়নোসোরদের আরেক দেশে।
আবার বন্ধদেশের পাশের দেশে আরেক বিশেষ গোত্রের ডায়নোসোররাও থেমে নেই, তাদের ডায়নোগুরুরাও তৈরি করে ফেলে দুইটি বিশেষ আবিষ্কার। একটি হচ্ছে বিশেষ প্রাণির বিষ্ঠা, আরেকটি হচ্ছে সবাই সমস্বরে চিল্লাবে “গো-উল্কাপিণ্ড-গো”, এই দুই ফর্মূলাতে নাকি উল্কাপিণ্ড আর হামলা করবে না। আবার উন্নত দেশের এক উন্নত ডায়নোগুরু আরেক কাঠি সরেস, তিনি “ভেলিভিশন” নামের এক যন্ত্রের মাধ্যমে কিভাবে উল্কাপিণ্ড থেকে রক্ষা পাওয়া যায় তার উপায় বলে দিতে শুরু করলো। ধনী ডায়নোসোরদের ধনী কারবার।
বড় বড় ডায়োনোগুরুদের এমন সব আবিষ্কারের পর ডায়নোসোর বিজ্ঞানীরা নিজেদের ভুল বুঝতে পারল। তারা অনুধাবন করলো এতদিন তারা যা করেছে সব বৃথা, সব ভুল। গবেষণা বন্ধ করে, যে যার গোত্র অনুযায়ী ডায়োনোগুরুদের কথামতো পথচলা শুরু করল। পুরো পৃথিবীর সব ডায়নোসোর এখন এসব ডায়োনোগুরুদের কথা পালন শুরু করেছে অক্ষরে অক্ষরে। সবাই বুঝে গেছে এই মহাবিপদ থেকে রক্ষা পাওয়ার একমাত্র উপায় এটাই।
কিন্তু সে সময় একদল ডায়নোসোর বলেই যাচ্ছিলো এভাবে ডায়নোসোর প্রজাতিকে বাঁচানো সম্ভব না, উল্কাপিণ্ডের আঘাতে কেউ বাঁচবে না, গবেষণা করতে হবেই। কিন্তু তাদের কথা কে শোনে! ডায়নোগুরুরা তো বলেই দিয়েছেন এতে তাদের গোত্রের ডায়নোসোরদের কিছুই হবে না! এই গোত্রের ডায়নোসোরদের বিশ্বাস ওই গোত্র মরবে, ওই গোত্রের বিশ্বাস এই গোত্র মরবে। অবস্থাটা সামগ্রিকভাবে দেখলে এমন যে আসলে কোনও ডায়নোসোরই মরবে না। তো কী দরকার এসব গবেষণা করার! তাই যেই দল ডায়নোসোরেরা বলে যাচ্ছিল গবেষণা চালিয়ে যেতে তাদের কথা কানে তোলার কোনও দরকারই নেই। এরপর সুখে শান্তিতে ডায়োনোগুরুদের কথা মতো চলতে থাকল ডায়নোসোররা।
কোটি কোটি বছর পরের ঘটনা। পৃথিবীতে এখন মানব জাতির দাপট। আকাশ-বাতাস-সাগর-মাটি জয় করে তারা চাঁদেও পৌঁছে গেছে, মঙ্গল জয় করি করি অবস্থা। গবেষণা-আবিষ্কারে তারা অনেক এগিয়ে, মানব বিজ্ঞানীরা তাদের গবেষণায় জানতে পারে কোনও এক কালে পৃথিবীতে বাস ছিল ডায়নোসোর নামের এক প্রজাতির। এক বড় উল্কাপিণ্ডের আঘাতে সেসময় পুরো ডায়নোসোর প্রজাতিটাই ধ্বংস হয়ে গেছে। একটা ডায়নোসোরও বাঁচতে পারেনি সেদিন।