সারা গিলবার্ট এবং নারীর মেধা
মেহেরুন নূর রহমান।। এই মুহূর্তে একটা নাম খুব উচ্চারিত হচ্ছে সেটি হলো- ব্রিটিশ বিজ্ঞানী সারা গিলবার্ট। যিনি অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের যে দলটি কোভিড-১৯ এর ভ্যাকসিনেশন তৈরিতে কাজ করছে তার নেতৃত্ব দিচ্ছেন তিনি। ভ্যাকসিনের ক্লিনিক্যাল ট্রায়াল শুরু হয়ে গেছে। সারা বলেছেন, এই ট্রায়াল যদি সফল হয় এবং তিনি যদি যথাযথ আর্থিক সহায়তা পান, তাহলে সেপ্টেম্বর ২০২০’র মধ্যে কোভিড-১৯ এর ভ্যাকসিন সরবরাহ করতে পারবেন। তাঁর অতীত সাফল্যের ট্র্যাক রেকর্ড বিবেচনা করলে আমরা আশাবাদী হতেই পারি।
এই ব্রিটিশ বিজ্ঞানীর পুরো নাম সারা ক্যাথরিন গিলবার্ট (Sarah Catherine Gilbert)। জন্ম এপ্রিল, ১৯৬২। ইস্ট আঙ্গলিয়া বিশ্ববিদ্যালয় (University of East Anglia) থেকে জৈবিক বিজ্ঞান বিভাগে স্নাতক এবং হাল বিশ্ববিদ্যালয় (University of Hull) থেকে ডক্টরেট অর্জন করেছেন। বর্তমানে অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের ভ্যাকিসিনোলজির অধ্যাপক। সারা ইনফ্লুয়েঞ্জা এবং নতুন করে উঠে আসা ভাইরাল প্যাথোজেন (সোজা বাংলায় জীবাণু) এর বিরুদ্ধে ভ্যাকসিন উৎপাদনে পারদর্শী। তিনি ভ্যাকসিটেক নামক একটি একটি জৈবপ্রযুক্তি সংস্থার সহ-প্রতিষ্ঠাতাও বটে। ভ্যাকসিটেক মৌসুমী ইনফ্লুয়েঞ্জার ভ্যাকসিন এবং প্রোস্টেট ক্যান্সারের জন্য ইমিউনোথেরাপি উৎপাদনে কাজ করে। তাঁর সাফল্যের গাঁথা গাইতে গেলে কয়েক পাতা লেগে যাবে তাই এখানে আর কিছু বলছিনা। আপনি যদি আগ্রহী হন তাহলে সারা সম্পর্কে গুগল করে দেখতে পারেন।
তাঁর সম্পর্কে বিভিন্ন জিনিস জানতে গিয়ে একটা জিনিস চোখে পড়লো যেটি তাঁর ব্যক্তিগত জীবন। ১৯৯৮ সালে সারা একসাথে তিন সন্তানের (triplets) জন্ম দেন। তার সঙ্গী তখন নিজের ক্যারিয়ার ছেড়ে দিয়ে বাচ্চা পালনের প্রধান দায়িত্ব গ্রহন করেন।
সারা গিলবার্ট ভাগ্যবান যে তিনি এমন একজন জীবনসঙ্গী পেয়েছেন যে তাঁর মেধার যথার্থ মূল্যায়ন করতে পেরেছেন। বুঝতে পেরেছেন সারা’র কাজটিতে কতখানি মনোযোগ এবং আত্মোৎসর্গের প্রয়োজন, আর সে জন্যই হয়ত সন্তান পালনের মত সময়সাপেক্ষ দায়িত্বটি তিনি নিজের কাঁধে তুলে নিয়েছিলেন। সব নারীর ভাগ্যে কিন্তু এমনটি ঘটে না। বরং উল্টোটিই ঘটে।
আমি আমার জীবনে অনেক প্রতিভাবান নারীর সম্ভাবনাকে ধ্বংস হতে দেখেছি সংসারের যাঁতাকলে। স্বামী বা অন্য কারো থেকে কোন রকম সাহায্য পাননি। কিছু কিছু ক্ষেত্রে স্বামী স্বয়ং বাধা হয়ে দাঁড়িয়েছে। কিছু কিছু ক্ষেত্রে তথাকথিত উদার স্বামী তার স্ত্রীদের পেশা গঠনে বাধা দেয়নি ঠিকই কিন্তু সংসারে দায়িত্ব পালনে সেভাবে সাহায্যও করেনি। ফলে নানা সাংসারিক কাজের জন্য সেসব স্ত্রীর পেশাগত জীবন ক্রমাগত বাধার সম্মুখীন হয়েছে।
স্বামীর চেয়ে পড়াশুনা এবং ক্যারিয়ারে সফল নারীকেও দেখছি সন্তান পালনের জন্য নিজের ক্যারিয়ায় ছেড়ে দিতে। স্বামী কিন্তু তার পেশার সাথে একটুও আপোষ করেনি। বহু মেধাবী নারীকে দেখেছি দেশের সফল পেশা ছেড়ে দিয়ে বিদেশে স্বামীর কাছে চলে যেতে, যেখানে সে কেবল গৃহিনী বা ছোটখাট কোন কাজ করছে। কোন নারী যদি তার পেশার ব্যাপারে একটু বেশি সিরিয়াস হয় তাহলে সে ‘স্বার্থপর’ ট্যাগ পায় এবং সংসারে বা বাচ্চাদের কোন সমস্যায় তাকেই মূলত দায়ী করা হয়, যেন এগুলো মেইনটেইন করা শুধু তার কর্তব্য। স্বামীর কোন দায় নেই। এসব ক্ষেত্রে নারীরা বাবার বাড়ি থেকেও তেমন সাহায্য পান না কারণ সকলেই মনে করে সংসার এবং সন্তান পালনই নারীর সবচেয়ে বড় ধর্ম সে আপনি যাই হন না কেন। স্বামী, সংসার, বাচ্চা ঠিক রেখে কিছু করতে পারলে করেন।
নারী পুরুষের মেধার তুলনামূলক বিচার করতে গিয়ে একজন আমাকে বলেছিল যে, বিজ্ঞান, সাহিত্য, মেডিসিন এসব ক্ষেত্রে নারীদের চেয়ে পুরুষের পদচারণা অনেক বেশি, এমনকি নোবেল পুরস্কার পাওয়ার ক্ষেত্রেও পুরুষদের সংখ্যা নারীর চেয়ে অনেক বেশি। সুতরাং পুরুষরাই বেশি মেধাবী।
এসব শুনলে হাসি পায়, তর্ক করতে ইচ্ছা করে না। বিজ্ঞান, মেডিসিন বা সাহিত্যে চূড়ান্ত সাফল্য পেতে গেলে যে পরিমান সময় এবং মনোসংযোগ দরকার তা কি একজন নারী দিতে পারে? একজন পুরুষ এসব ক্ষেত্রে সমাজ, পরিবার থেকে যতটা সহযোগিতা পায়, একজন নারী কি তা পায় ? সঠিক সুযোগ সুবিধা দেবেন না আবার বলবেন মেয়েরা কম মেধাবী, এটা তো ঠিক না।
নারীদের বলছি, এই মুক এবং বধির সমাজ আপনার মেধার সঠিক মূল্যায়ন করবে সে আশা ছেড়ে দিন। আপনি নিজে আপনার মেধা এবং ক্যারিয়ার নিয়ে আরো সচেতন হোন। যুগ যুগ ধরে সংসার পালনের যে পুরুষতান্ত্রিক ধ্যানধারণা যা অনেক নারীও বহন করে, তা থেকে যতটা পারেন বেরিয়ে আসুন। এতে যদি আপনাকে কেউ স্বার্থপর বলে, তবে গা ঝাড়া দিয়ে ফেলে দিন। নিজের সঠিক মূল্যায়ন করে এগিয়ে যান। মনে রাখবেন আপনি যদি আপনার মূল্য না বোঝেন অন্য কেউ বুঝবে না। আর নিজের জন্য নিজেকেই শক্ত হয়ে দাঁড়াতে হবে, না হলে সকলেই আপনার উপর ক্রমাগত সুযোগ নিতে থাকবে সে যত আপনজনই হোক না কেন।
মেহেরুন নূর রহমান: লন্ডনে আন্তর্জাতিক মিডিয়া ও অ্যাডভার্টাইজিং সংস্থায় কর্মরত
[ফেমিনিস্ট ফ্যাক্টরে প্রকাশিত মুক্তমত লেখকের নিজস্ব বক্তব্য]