September 20, 2024
সাহিত্যগল্প

ক্ষত

সায়মা আরজু।।

অনেকদিন পরে আজ বাড়ি পরিস্কার করা হচ্ছে। দোতালার ঝুল বারান্দা দিয়ে পুরো বাড়িটা দেখা যায়। সকালের নাস্তা-পানির পাট চুকলো কেবল। আরাম করে চায়ের কাপটা নিয়ে যেই বসেছি, অমনি ঘস্ ঘস্ একটা শব্দে কান খাড়া করলাম। ঠিক ডান দিক থেকেই শব্দটা আসছে। বাড়ির ডান ধারের দেওয়ালে একটা বটগাছ  শিকড় ছড়িয়েছে বেশ অনেকদিন ধরেই, ওটাই সরানোর চেষ্টা চলছে। দুটো লোক শাবল দিয়ে যতটা সম্ভব গাছটাকে আলগা করছে। শব্দটার উৎস সেটাই।

লোক দুটো সজোরে টান দিয়ে বটগাছটা তুলতে যাবে, আহ্! একটা অস্ফুট শব্দ বের হল মুখ থেকে। মনে হল গাছটার সাথে সাথে দেয়ালটা জুড়েও কতটা ক্ষত হল, অনেকদিনের পুরনো সম্পর্ক ওদের। লোকদুটো সেটা শুনতে পেল কি পেল না কে জানে? একবার আমার দিকে তাকিয়ে ফের কাজে মন দিল।

নীচে বাইরের কলতলায় বাসন মাজছিল আমার সহকারি হিন্দু বউটি। দেখলাম আজ সে বড় জড়সড়, রোজকার তেজী ভাবটা উধাও। গলা বাড়িয়ে ডাক দিলাম তাকে। বললাম হাতের কাজ শেষ করে যেন একবার এদিকে আসে।

আল্লাহু আল্লাহ বলে লোকদুটো যেই দ্বিতীয় টান মারল, অমনি ঝন করে একটা শব্দ হল। হঠাৎ শব্দে একটু আঁতকে উঠলাম মনে হয়। ছলকে কিছুটা চা কাপড়ে পড়ল। দেখলাম একটা জং ধরা ছুরি মাটিতে পড়ে আছে। গাছটার ডালপালার ফাঁকে কেউ রেখে দিয়েছিল। আচ্ছা, এটা কি কেউ লুকিয়ে রেখেছিল?

হঠাৎ স্মৃতি সরব হলো। মনে হল এই রকমই একটা ছুরি হাতে নিয়ে কেউ একজন দৌড়াচ্ছিল। কিন্তু কে সেটা মনে পড়ছে না। কিছুদিন আগে সিলেট যাওয়ার পথে একটা গ্যাস স্টেশনে নেমেছিলাম। পাশেই এক তরমুজওয়ালা ভ্যানে করে তরমুজ কেটে বিক্রি করছিল। তার হাতের ছুরিটা দেখেও সেদিন এমন মনে হয়েছিল। তার মানে সিলেট আর ছুরি কি সম্পর্কযুক্ত? ভাবনার গতির সাথে সাথে আমি হাঁটতে থাকি পিছন দিকে। দিন, মাস, বছর পার হয়ে যেতে শুরু হল ক্রমাগত। না কিছুই তো মনে আসছে না। আমি মনে মনে আওরাতে লাগলাম, চা বাগান, মৌলভিবাজার, জাফলং, তামাবিল, শিলং, মেঘালয়…।

এবার যেন একটা শাড়িপরা মেয়ের সাদা কালো ছবি ভেসে উঠলো মনের কোনে। মেয়েটার হাঁটু অবদি পানি, হাসি হাসি মুখ, নুয়ে হাত বাড়িয়ে দিয়েছে পানিতে। হঠাৎই মাথায় বিদ্যুৎ খেলে গেল। মনে পড়ছে! অনেকদিন আগে বিচিত্রা ম্যাগাজিনের পাতায় দেখেছিলাম ছবিটা। কত ছোট তখন আমি, স্কুলে পড়ি। মেয়েটা রিমা, খুন হয়েছিল সিলেটে বেড়াতে গিয়ে। ঘটনাটার এত বিশদ বর্ণনা খবরের কাগজে, সাপ্তাহিক ম্যাগাজিনে পড়েছি যে আমার অবচেতন মন পুরো ঘটনাটা ধারন করেছে। এই যে ছুরি নিয়ে দৌড়ে যাওয়া এটা তো ঘাতক মুনিরের স্বীকারোক্তিতে ছিল, অথচ আমার মনে হয়েছে আমি এটা দেখেছি। যেদিন রায় বেরিয়েছিল সেদিন কেমন যেন লেগেছিল। গা গুলিয়ে বমি আসছিল বারবার।

বউটা এসে ডাক দিল, ‘ দিদি ডেকেছ কেন? চানের জল দেব?’
বললাম, একটু পরে। তা তোমার মুখ শুকনো কেন?
– কি করব? দিন কাল যা খারাপ পড়েছে গো, দিদি।
– কেন কি হয়েছে?
– টেলিভিশনে দেকনি একটা জ্যান্ত মেয়েকে অমনে কেরোসিন দিয়ে পুইড়ে মাইরলো !

ক’দিন ধরেই নুসরাতের খবরটা টিভিতে দেখাচ্ছিল। কাল মেয়েটা আর পারলো না, চলে গেল। আরেকটা ক্ষত তৈরি হল বুকের ভিতর। আবার হয়তো কেউ বা অনেকেই নিজের অজান্তেই ট্রমাটাইজড হবে। এই স্মৃতি বয়ে বেড়াবে বছরের পর বছর। কোনও এক গরমের দুপুরে হয়তো চকিতে মনে পড়বে খবরের কাগজের, টিভির পর্দার দুঃসহ এই স্মৃতি। মুহূর্তের জন্য হলেও ক্ষতটা খুব তাজা হয়ে উঠবে তখন।