September 20, 2024
সম্পাদকীয়

‘প্লিজ… আমরা নিঃশ্বাস নিতে পারছি না!’

শারমিন শামস্।। যুক্তরাষ্ট্রের মিনেসোটা অঙ্গরাজ্যের মিনিয়াপলিস শহরে জর্জ ফ্লয়েড নামে এক কালো মানুষকে হত্যা করেছে এক শ্বেতাঙ্গ পুলিশ সদস্য। একজন প্রত্যক্ষদর্শীর ধারণ করা ১০ মিনিটের এক ভিডিওতে দেখা গেছে, হাঁটু দিয়ে ফ্লয়েডের গলা চেপে ধরে তাকে শ্বাসরোধ করে হত্যা করছে পুলিশটি। নিহত ফ্লয়েড নিরস্ত্র ছিলেন।  নিঃশ্বাস নিতে না পেরে তিনি কাতরাচ্ছিলেন, বারবার বলছিলেন, ‘Please I can’t breathe’.  পুলিশ কর্মকর্তা ডারেক চাউভিন হ্যান্ডকাপ লাগা অবস্থায় ফ্লয়েডের ঘাড়ে হাঁটু দিয়ে কমপক্ষে পাঁচ মিনিট চেপে ধরে থাকেন। দম আটকে মারা যান ফ্লয়েড।

জর্জ ফ্লয়েডের হত্যার প্রতিবাদে আরেরিকার বিভিন্ন রাজ্য এখন উত্তাল। কৃষ্ণাঙ্গ একজন মানুষকে পুলিশ যে অত্যাচার করেছে তা পথচারীরা মোবাইল ফোনে রেকর্ড করে সামাজিক মাধ্যমে ছড়িয়ে দেন। সেটি ভাইরাল হলে জনগণ বিক্ষোভে ফেটে পড়ে। বিক্ষোভকারীরা ফ্লয়েডের নামে শ্লোগান দিচ্ছে- ‘আমি শ্বাস নিতে পারছি না’।

ফেমিনিজমের একটি ধারা আছে। ইকো ফেমিনিজম। ইকো ফেমিনিস্টরা প্রাণ প্রকৃতির প্রতি অসদাচরণের সাথে লিঙ্গবৈষম্যের বিষয়টির একটি সংযোগ রয়েছে বলে মনে করেন। আশির দশকে পারমানবিক বোমাবিরোধী, পরিবেশবাদী এবং লেসবিয়ান ফেমিনিস্ট মুভমেন্টের ভেতর থেকে ইকো ফেমিনিজমের ধারণাটি ধীরে বেরিয়ে আসে। পৃথিবীর প্রাণ প্রকৃতিকে আমরা যেভাবে নিয়ন্ত্রণ করতে চাই, তাকে দমন পীড়ন করি, সেই একইভাবে নারীকেও নিপীড়িত বঞ্চিত ও দমন করে রাখা হয়; এই দুটি ঘটনার সাথে এক ধরণের যোগসূত্র রয়েছে বলে মনে করেন ইকো ফেমিনিস্টরা।

প্রকৃত অর্থে এই পুঁজিবাদী পিতৃতান্ত্রিক সমাজে একটি শ্রেণি আরেকটি শ্রেণির উপর প্রভুত্ব করে। এই প্রভুত্বটিই পুঁজিবাদের প্রাণভোমরা। দীর্ঘদিনের শাসনকে অভ্যাসে পরিনত করানোটাও পুঁজিবাদের উদ্দেশ্য। পুঁজিবাজ শুধু দরিদ্রের উপরে ধনীর শাসন শোষণ না, একই সাথে পুরুষের শাসন নারীর উপরেও। একই সাথে বর্ণ ধর্ম গোত্রের মত উপাদানগুলোকে কাজে লাগিয়ে একের ওপরে অপরের আধিপত্য টিকিয়ে রাখে পুঁজিবাদ। আবার পুঁজিবাদের এই শাসন চলে প্রকৃতির ওপরেও। প্রকৃতি নীরব, শান্তিময়; তাই অর্থ আর মুনাফার লোভে তাকে দমন পীড়ন করা সহজ। একইভাবে নারীর চুপ থাকা, নারীর নীরব থাকাকেও কাজে লাগিয়ে তাকে শোষণ করা হয়। আর এই যে বর্ণবাদ- সারা পৃথিবী জুড়ে, যে আমেরিকা মানবতার গল্প কাহিনী বলে আমাদের মুখ বন্ধ রাখতে চায়, তারাই আজ বর্ণবাদের সবচেয়ে বড় উদাহরণ হয়ে উঠেছে। এও সেই নিয়ন্ত্রণ আর নিপীড়নের ইচ্ছে থেকেই উদ্ভুত বিষ, যে বিষ পুঁজিবাদের পেয়ালায় সুন্দর মনোরম করে গেলানো হচ্ছে আমাদের, আমরা টেরও পাচ্ছি না। যে আমেরিকা বিজ্ঞানে প্রযুক্তিতে মহাকাশ গবেষণায় একের পর এক তাক লাগিয়ে যাচ্ছে, সেই আমেরিকাই একজন মানুষের শরীরের রঙ কালো হবার অপরাধে তাকে প্রকাশ্য দিবালোকে নিঃশ্বাস বন্ধ করে খুন করছে।

নিজের দেশের দিকে একটু চোখ ফিরাই। নোয়াখালী সদর উপজেলার সল্লা গ্রামের একটি পুকুরে ভেসে উঠেছে আড়াই মাস বয়সী শিশু মাইমুনার লাশ। আর তার ২৬ বছর বয়সী মা বিবি মরিয়মের লাশ ঝুলছিল পুকুর পাড়ের একটি গাছ থেকে।  এ ঘটনায় মরিয়মের স্বামী আকবর আলী বাবর ও শ্বশুর বাড়ির সবাই পলাতক আছে। পুলিশ ধারণা করছে, পরকিয়ার জের ধরে ও যৌতুকের জন্য মা ও শিশুটিকে হত্যা করা হয়েছে। মরিয়মের আরো দুটি সন্তান আছে।

একটি সন্তানকে মা গর্ভে ধারণ করে। প্রায় নয়টা মাস ধরে বয়ে নেন শরীরে। সেই সন্তানটিকে যখন কেউ হত্যা করে, তখন আসলে সেই মা’টাকেই হত্যা করা হয়। আর যে শিশু সন্তানদের মাকেও খুন করে কেউ, সেই সন্তানদেরও বাঁচিয়ে রাখা বা না রাখাটাও আসলে কোন মানে বহন করে না। মা হারানো শিশুও মৃতপ্রায়।

যে সমাজ, যে রাষ্ট্র মা ও শিশুর মৃত্যুকে এত সহজলভ্য করে রেখেছে, সেই রাষ্ট্রের কাছে আর কতবার দাবি তুলবো ন্যায়বিচারের? কেনই বা তুলবো? নারী ও শিশুর জন্য একটা নিরাপদ, বৈষম্যহীন সমাজের দাবি আর কতবার দেয়ালে আছাড় খেয়ে ফিরে আসবে আমাদেরই কাছে, এক একটা বীভৎস হত্যাকাণ্ডের সংবাদসহ? এই পৃথিবীর সাদা লোকেদের অহংকারে আর কত কালো মানুষ দম আটকে মরবে?

এই মহামারীকালেও একটুও বদলাতে পারিনি আমরা। ঠিক আগের মতই বর্ণের, অর্থের, শ্রেণির, লিঙ্গের, ক্ষমতার তীব্র দেমাগে ছুটছি আর হত্যা করে চলেছি মানবতাকে। হাঁটু দিয়ে ঠেসে ধরছি মনুষ্যত্বকে। পানিতে চুবিয়ে প্রাণ কেড়ে নিচ্ছি। গাছের ডালে ঝুলিয়ে দিচ্ছি সভ্যতার লাশ।

আর কত? আর কত? আর কতবার? আর তো নিতে পারি না এই বীভৎসতার দাগ! দাঁড়িয়ে আছি এই মহাশ্মশানে, চিৎকার করে বলে উঠতে চাই, ‘থামুন এবার, থেমে যান..প্লিজ…আমরা আর নিঃশ্বাস নিতে পারছি না!’