November 22, 2024
ফিচার ৩মুক্তমত

যারা আমার শরীর ছুঁয়ে এত বাহাদুরী করেছে….

সাদিয়া মেহজাবিন।। আমার চোখ কেন জানি বড় বড় সমস্যাগুলো দেখতে পায় না। আমি দেখি সেসব কিছু যা অতি তুচ্ছ, যেখানে অতিমাত্রার বাড়াবাড়ি নেই। অনেকে আমাকে বলতে পারেন আমার দেখার চোখ কিংবা মনের চোখ খুবই নিচু। আমাদের সমাজে কিংবা এ পৃথিবীতে এত এত ঘটনা ঘটে যাচ্ছে, সেগুলোর কিছুই আমার মনকে বেগ দেয় না। আমি যখন নিজের সমস্যাকে খুব বেশি দেখি, নিজের কষ্টকে বেশিমাত্রায় আশকারা দিই তখন নিজেকে ছোট কোন এক কূপের অধিবাসী মনে হয়। আমি নিজেকে পরিবর্তন করে নিচ্ছি। তবে এখনো কিছু বিষয় মনে আসলে আমার সমস্ত শরীর হিম হয়ে যায়। নিজেকে তুচ্ছ করে দেখি কেন আমি প্রতিবাদ করিনি!

আমি তখন সবে ৩য় শ্রেণীতে পড়ি। খেলার বয়সে কে শোনে কার কথা। যত রকম খেলা আছে সব খেলে দিন শেষে তাও রেশ রয়ে যায়। আমাদের স্কুলের স্যারের মেয়ে মারিয়া। আমরা সবাই মিলে প্রতিদিন বিকালে খেলতে যেতাম। একদিন বিকালে ঘুমিয়ে পড়েছি। আর খেলতে যাওয়া হয়নি। সন্ধ্যায় যখন ঘুম ভাঙ্গলো তখন ভাবলাম মারিয়ার বাসায় গিয়ে ঘুরে আসি। আমাদের পরের গলিতে থাকে মারিয়া। মারিয়ার বাসায় গিয়ে গল্প সেরে আসছি, তখন প্রায় সোয়া ৮ বাজে। দ্রুত বাসায় যাওয়ার জন্যে হাঁটা শুরু করলাম। পিছন থেকে কে যেন মুখ চেপে ধরল। আমি চিল্লানোর সুযোগ পাইনি। তবে লোকটা আমার শরীরে হাত দিতে যাবে তখনি হাতে এক কামড় বসিয়ে জোড়ে দৌঁড়ানো শুরু করলাম। এক দৌঁড়ে বাসায়। রাতে প্রচুর ভয় পেয়েছি, অনেক কেঁদেছি।

কিছু মাস পরে আমি ভুলে যাই এ কথা। যখন ৪র্থ শ্রেণিতে,  অন্যদের তুলনায় আমারিএকটু আগেই ঋতুস্রাব হয়। আমার সহপাঠী কেউ এসব নিয়ে জানতো না। আমি কম বয়সে এমন যন্ত্রণার মধ্যে পড়েছি দেখে খুব কান্না পেত। আমার বুক এবং চেহারায় পরিবর্তন আসতে থাকে, সবাই এখন কেমন যেন চোখে দেখে। আমার দুলাভাই বিদেশ থাকেন। আমাকে অসম্ভব আদর করেন। তখন তিন দুলাভাইয়ের মধ্যে তিনিই আমাকে খুব বেশি আদর করতেন। দুলাভাই বিদেশ থেকে এসেছেন, আপু তাদের বাসায় আমাকে নিয়ে যাবে। আমি মহাখুশি! যেদিন গেলাম সেদিন অনেক মজা হলো। রাতে গল্প শেষে সবাই ঘুমাতে যাব। আপু আমাকে বললো, “মনি সবাই এক সাথে ঘুমাই। আমরা তো মাত্র তিনজন। তুই নাহলে ভয় পাবি”। আমিও রাজি হয়ে গেলাম। বিছানায় আমি আর আমার দুলাভাই শুয়ে পড়েছি। আপু গেছে আমাদের জন্য দুধ আনতে। আমি প্রায় ঘুমিয়ে পড়েছি। দেখলাম কে যেন আমার ঐ ছোট স্তনে হাত দিচ্ছে!

আমি ভয়ে ঘেমে গেলাম। হাতের মালিক আমার দুলাভাই। আপু কিছুক্ষণের মধ্যেই এসেছে। আমি কিছু না বলেই ঘুমের ভান করে গেলাম এবং পরের দিন চলে আসলাম। আসার সময় আমার বোন আমার হাতে ২০ টাকা দিল যেন কিছু খেয়ে নিই। আমাদেরকে আপু প্রায়ই  আর্থিকভাবে সাহায্য করত। আমি টাকা পেয়ে মহা খুশি কেননা বাসায় যাওয়ার পথে যে মিষ্টির দোকান পড়ে, তাতে অসম্ভব বাহারি মিষ্টি আছে। আমি এর পরের দিন খেলতে যাব, যাওয়ার আগে ভাবলাম দোকান থেকে কিছু খেয়ে নিই।

গিয়ে দেখি মারিয়ার আব্বু দোকানে। এ অবেলায় খেলতে এসেছি দেখে খুব বকবেন, তাই তিনি বেরিয়ে যাওয়ার পরে আমি গিয়েছি। গিয়ে আমি মামাকে বললাম আমাকে মিষ্টি দিতে। তিনি কোনটি দিবেন এমন প্রশ্ন করতে করতে আমার স্তনে হাত দিলেন। আমি দ্রুত কিছু না বলে পালিয়ে আসি। এরপর আর কোনদিন খেলতে যাইনি। আমাদের বাসায় অনেক কিছুই ঐ দোকান থেকে কিনত। ভাইয়ার সাথে একবার গিয়েছিলাম সেখানে, প্রচুর ভয় পাচ্ছি দেখে ভাইয়া আমাকে নিয়ে আসে। বাসার সবাই ভাবে আমি ছোট থেকেই ভীতু তাই এমন করছি।

আমি যখন ৫ম শ্রেণিতে তখন একটা সিরিজ দেখাতো, ক্রাইম সিরিজ। সেখানে বিভিন্ন ক্রাইমের ধরণ এবং আমাদের করণীয় সম্পর্কে বলা হতো। একদিন সেখানে একটা সিরিজ দেখাবে যেখানে বাচ্চা মেয়ে মা হবে এবং তার সাথে আসলে কি হয়েছে এসব দেখানো হবে। আপু বলেছে আমি যেন এ সিরিজ দেখি। আমরা সবাই মিলে দেখলাম এবং আপুও আমাকে বুঝিয়ে বলেছে কীভাবে আমি সেফ থাকব। আমি বুঝে গিয়েছি আমার সাথে যা হচ্ছে তা খারাপ স্পর্শ এবং এখানে আমার দোষ নেই, বরং আমার এখানে প্রতিবাদ করা উচিত। আমি তখন থেকেই প্রতিবাদ করব ভেবে নিয়েছি।

কিছুদিন পর আমার মামাতো ভাই আমাদের বাসায় এসেছে। আমি তখন ৬ষ্ট শ্রেণিতে পড়ি। মেয়েদের ওড়না দিয়ে তাদের যক্ষের ধন সামলাতে হবে এমন লেইম কিছু আমাদের সবার বাসাতেই প্রচলিত ছিল। কিন্তু নিজের ঘরে তো ওড়না পরে কেউ বসে থাকে না। একদিন ঘরে বসে আছে, মামাতো ভাই এসে আমার স্তনে জোরে এক ঘুষি মারে। কোথায় আমার প্রতিবাদ? আমি পালিয়ে আম্মুর কাছে গিয়ে বসে থাকি আর ঘামতে থাকি। সেদিন নিজের উপর অনেক রাগ হয়েছিল কেন আমি থাপ্পড় দিয়ে তাকে ঘর থেকে বেড় করে দিইনি? এই প্রশ্ন আমাকে এখনো ঘুমাতে দেয় না।

আমার এখনো একবারের জন্যে হলেও আমার ভাইয়ের বন্ধুকে একটা জোরে থাপ্পড় দিতে মন চায় যখন মনে পড়ে সে আমাকে কীভাবে বিচ্ছিরিভাবে ছুঁতে চাইতো। আমি এখনো অনেক ঘটনা মনে করতে চাই না কিংবা লিখতে ভয় পাই। যাতায়াত আমাদের করতে হয় বাস দিয়ে, লোকাল বাস।  অনেক খারাপ স্পর্শের সম্মুখীন হই। এখন কিছু প্রতিবাদ করি আর কিছু প্রতিবাদ করার প্রয়োজন মনে করি না। আমি আমার দুলাভাই কিংবা মামতো ভাই যারা আমারই পরিবারে লুকিয়ে আছে তাদের চিনে রেখেছি। কিন্তু যারা আমার চারপাশে রাস্তায় আছে তারা? সবাইকে এখন সন্দেহ হয়। পেপারে এত এত ধর্ষণের খবর পড়ে খারাপ লাগে কিন্তু একটি স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলি আমি বেঁচে গেছি। যদিও আমি জানি এমন ভাবনা খুব সংকীর্ণ তবুও সবখানে যেমন ধর্ষক ঘুরে বেড়াচ্ছে সেখানে আমি এখনো সেইফ আছি ভাবতে কার না ভালো লাগবে! তবে আমি জানি, আমি বেশিদিন সেইফ থাকবো না কেননা আমাদের দেশে এসব কিছুরই কিছু হয় না। বরং মেয়েকে খারাপের সিল দিয়ে ঘরে বসিয়ে দেবে। আমি জানি এমন কোন মেয়ে আমি খুঁজলেও পাব না যারা এসবের সম্মুখীন হননি।

যারা শরীর ছুঁয়ে এত বাহাদুরী করেছে তারা কি জানে এত সব কিছুর পরও আমার মনকে একবিন্দুও তারা কুলষিত করতে পারেনি?

তাদের ঘরে কি কোনদিন মেয়ে হবে না? আমি চাই না এমন যারা করে, তাদের কারো শিশু সন্তানের সাথে এমন হোক। কেননা আমি জানি, শিশুদের মানসিকভাবে এসব বিষয় কত প্যাড়া দেয়। আমি চাই আমরা সবাই সুকুমারবৃত্তি নিয়ে বেড়ে উঠি।

 

[ফেমিনিস্ট ফ্যাক্টরে প্রকাশিত মুক্তমত লেখকের নিজস্ব বক্তব্য]