September 20, 2024
অনুবাদসাহিত্যফিচার ২বই নিয়ে আলাপ

পর্ব-১৩: সঙ্গীতের মহাফেজখানা আর ঐতিহাসিক পেইন্টিং-এর ভিন্ন বয়ান

শিল্প সমালোচক, লেখক শার্লট মালিন্সের A Little Feminist History of Art বইটি বাংলায় অনুবাদ করছেন বিশিষ্ট অনুবাদক, শিক্ষক জি এইচ হাবীব। বইটির অনুবাদ ধারাবাহিকভাবে প্রকাশ হচ্ছে ফেমিনিস্ট ফ্যাক্টরে। আজ পড়ুন এর  ত্রয়োদশ পর্ব। সব পাঠকের সুবিধার জন্য প্রতি পর্বের শুরুতে বইটির এবং লেখক শার্লট মালিন্সের সংক্ষিপ্ত পরিচিতি দেয়া থাকবে।।

[নারীবাদী শিল্প আন্দোলনের শুরু ১৯৬০-এর দশকের শেষের দিকে। পুরুষ প্রাধান্যবিশিষ্ট রঙ্গমঞ্চে প্রতিযোগিতায় অবতীর্ণ হওয়ার জন্যে সে সময় নারী শিল্পীরা তাঁদের কাজগুলোর জেন্ডারচ্যুতি ঘটাবার সংগ্রামে নামেন। এরপর থেকে সেই আন্দোলন শিল্প জগতে গোটা বিশ্বজুড়ে অন্যতম প্রধান ভূমিকা পালন ক’রে আসছে। ‘নন্দনতাত্ত্বিক ফরমালিযম’ ব’লে অভিহিত যুগের পর সামাজিকভাবে প্রাসঙ্গিক নানান ইস্যুতে কথা বলার জন্য ‘নারীদৃষ্টি’-র সাহায্যে নারী শিল্পীরা বিভিন্ন মাধ্যমে কাজ ক’রে জেন্ডার, পরিচয় এবং ফর্মের দিকে সবার দৃষ্টি আকর্ষণ করতে চেয়েছেন, সমালোচনা করেছেন সাংস্কৃতিক প্রত্যাশাগুলোকে এবং নারীকে সনাতনী দৈনন্দিন ধারণায় আটকে ফেলার ব্যাপারটিকে। সমাজের দৃষ্টি ঘোরাতে চেয়েছেন সাম্যের জন্যে নারীর সংগ্রাম এবং নারীদেহকে পণ্য হিসেবে দেখবার মানসিকতা ও ক্রিয়াকর্মের দিকে। “অল্প কথায় নারীবাদী শিল্প-ইতিহাস” (A Little Feminist History of Art) নামের ছোট্ট বইটিকে এই আন্দোলনের ফসল হিসেবে জাত অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ কিছু শিল্পকর্মের সংক্ষিপ্ত কিন্তু সারগর্ভ ভূমিকা বলা যেতে পারে। ১৯৬০-এর দশক থেকে বর্তমান কাল অব্দি পঞ্চাশটি অসামান্য কাজ নারীর জীবন ও অভিজ্ঞতাকে তুলে ধরেছে। সেই সঙ্গে, ভিয্যুয়াল সংস্কৃতির ওপর নারীবাদী আদর্শ ও রাজনীতি যে প্রভাব ফেলেছে সেটাও এই কাজগুলো মেলে ধরেছে। “অল্প কথায় নারীবাদী শিল্প-ইতিহাস” নামের এই গ্রন্থটি জেন্ডার বৈষম্য, যৌনতা, গার্হস্থ্য জীবন, ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতা আর নারী দেহের মতো বিষয়গুলো খতিয়ে দেখা বিংশ শতকের সবচাইতে উচ্চাকাঙ্ক্ষী, প্রভাবশালী ও টেকসই শৈল্পিক আন্দোলনগুলোর একটির আনন্দ উদযাপন। 

শার্লট মালিন্স একজন শিল্প সমালোচক, লেখক এবং সম্প্রচারক। তিনি রেচল হোয়াইরিড, সেসিলি ব্রাউন, র‌্যাচেল লামসডেন,  জেনি স্যাভিল, ক্যাথে ডে মনসাউক্স, স্যু অ্যারোস্মিদ, সুজ্যান কুন, স্যুযি হ্যামিলটন এবং পলা রেগোসহ বিভিন্ন নারী শিল্পীকে নিয়ে লেখালেখি করেছেন। তাঁর রচিত ও প্রকাশিত বিভিন্ন গ্রন্থের মধ্যে রয়েছে “লাইভ্স অভ দ্য গ্রেট আর্টিস্টস” (২০০৮) এবং “র‌্যাচেল হোয়াইহেড” (২০০৭)। তিনি বিবিসি রেডিও ফোর-এর “ফ্রন্ট রো” এবং “স্যাটারডে রিভিউ’’-র নিয়মিত প্রদায়ক]

সোনিয়া বয়েস (Sonia Boyce)

(জন্ম ১৯৬২)

‘মাই বয় ললিপপ’, ‘ম্যানচাইল্ড’ এবং ‘ডায়ামন্ডস আর ফরেভার’-এর মধ্যে মিল কোথায়? মিলটা এখানেই যে এগুলো সবই ব্রিটেনের কৃষ্ণাঙ্গ নারীদের রিলিজ করা গান। সোনিয়া গত বিশ বছর ধরে এ-ধরনের নারীদের সঙ্গীতের একটি মহাফেজখানা (আর্কাইভ) গড়ে তোলার চেষ্ট করছেন। আর এই প্রকল্পটির শুরু সেই ১৯৯৯ সালে, লিভারপুলের ফ্যাক্ট (Foundation for Art and Creative Technology) গ্যালারিতে ।

বয়েস অবশ্য ১৯৮০-র দশকের শেষ থেকেই যৌথভাবে কাজ করছেন; এখন আর তিনি জাতিগত স্টেরিওটাইপগুলোর ব্যাপারে প্রশ্ন উত্থাপন করার জন্য কৃষ্ণাঙ্গ পুরুষ ও নারীর প্রতিচ্ছবি আঁকেন না, পেইন্টিং বা ড্রইং করেন না, বরং বিভিন্ন গোষ্ঠী এবং সংস্থার সঙ্গে সরাসরি কাজ করেন। তাঁর Devotional Collection  গড়ে উঠেছে ‘লিভারপুল ব্ল্যাক সিস্টার্স’-এর সঙ্গে সহযোগিতার ফল হিসেবে। বয়েস তাঁদের কাছে জানতে চেয়েছিলেন সঙ্গীতে কোন কোন কৃষ্ণাঙ্গ ব্রিটিশ নারী তাঁদেরকে প্রভাবিত করেছেন, অনুপ্রাণিত করেছেন। প্রাথমিকভাবে তৈরি করা তালিকাটায় বন্ধু-বান্ধব আর পরিবারের সদস্যরাও নানান নাম যোগ করেছেন, সেই সঙ্গে সেটা মুখে মুখেও বড় হয়েছে। কেউ কোনো নাম দিলে বয়েস এখনো সেগুলো তালিকাতে যুক্ত ক’রে নেন। বর্তমানে সেখানে তিনশরও বেশি নাম রয়েছে, এবং সেই সঙ্গে বয়েস-এর ক্রমবর্ধমান মহাফেজখানায় রয়েছে এই তিনশ জনের সঙ্গীতের সঙ্গে সম্পৃক্ত একহাজারেরও বেশি আইটেম। তিনি বলেন, “একজন শিল্পী হিসেবে আমি মহাফেজখানার মতো প্রাতিষ্ঠানিক কাঠামো আর একটি শিল্পচর্চার মধ্যে একটি নমনীয় বা প্রবহমান সম্পর্ক রক্ষা করতে পারি। প্রক্রিয়াটিতে একটি যূথবদ্ধ জ্ঞানকে দৃশ্যমান করে তোলার ব্যাপারও রয়েছে।”

শিল্পকর্ম পরিচিতি:

Devotional Collection  ১৯৯৯ — চলমান

সঙ্গীতের মহাফেজখানা, এফিমেরা*  এবং ওয়ালপেপার

বিচিত্র মাত্রিক

(এফিমেরা* – ephemera – পোস্টার, টিকিট, ব্রডসাইড বা একপাশে প্রিন্ট নেয়া বড় কোনো কাগজ , ইত্যাদি নানান ধরনের কাগজ যেগুলো লোকে ব্যবহারের পরে সাধারণত ফেলে দেয়, কিন্তু ফেলা না হলে দীর্ঘকাল পরে সংরক্ষণযোগ্যতার মর‌যাদা লাভ করে )

 

মিকালেন টমাস (Mickalene Thomas)

(জন্ম ১৯৭১)

Le déjeuner sur l’herbe: Les Trois Femmes Noires (ঘাসের ওপর মধ্যাহ্নভোজ: তিন কৃষ্ণাঙ্গ নারী) এক বিশাল শিল্পকর্ম- সাত মিটারেরও বেশি দীর্ঘ এবং তার তিনগুণ বেশি উঁচু। এটি দৃশ্যমানতার একটি বিবৃতি বা বিবরণ; আর এটির বিষয়বস্তু হচ্ছে এদুয়ার মানে-র (Édouard Manet) সেই বিতর্কিত মাস্টারিপীস Le déjeuner sur l’herbe বা ‘ঘাসের ওপর মধ্যাহ্নভোজ’- এর একটি শক্তিশালী পুনর্কল্পনা।

একটি চিত্রকর্মের কাজ শুরু করার আগে মিকালেন টমাস নিউ ইয়র্কে অবস্থিত তাঁর স্টুডিওর এক কোণায় তাঁর মডেলদের ছবি তোলেন। স্টুডিওটি এমন ভাবে সাজানো যে দেখে মনে হবে সেটা ১৯৭০-এর দশকের কোনো কাঠের প্যানেল লাগানো বসবার ঘর। প্যানেলিংটি যেসব উপাদানে তৈরি তা Le déjeuner sur l’herbe: Les Trois Femmes Noires  ছবিটির নারীদের ঘিরে থাকা মোজাইকের নকশায় দৃশ্যমান। বাড়ির বাইরে একটা সন্ধ্যা উদযাপনের জন্য তিন কৃষ্ণাঙ্গ নারী সাজ-পোশাক পরে বসে আছেন। তাঁদের চুল কুণ্ডলী পাকানো, আর আইশ্যাডো জ্বলজ্বল করছে। তাদের দেখতে খুব ভালো লাগছে, আর সেটা তাঁরা জানেন- এই নারীদের শরীর তাঁদের নিজেদের নিয়ন্ত্রণাধীন, এবং তাঁরা আপনার স্থিরদৃষ্টির স্বীকৃতি দেয় সে-দৃষ্টি দ্বিগুণ তীব্রতা দিয়ে ফিরিয়ে দিয়ে।

শিল্পের ইতিহাসটা মিকালেন টমাসের বেশ ভালোই জানা। এবং প্রায়ই তিনি ঐতিহাসিক পেইন্টিং-এর কোনো ভিন্ন বয়ান বা সংস্করণ হাজির করেন- মূলত পুরুষ দর্শকের জন্যে পুরুষের আঁকা নগ্ন নারীদের উদাহরণগুলোকে নিয়ে নতুন ক’রে কাজ করতে পছন্দ করেন তিনি। গোইয়া-র নগ্ন মাজা (Naked Maja, ১৭৯৫-১৮০০) এবং ইংগ্রেস-এর La Grande Odalisque ১৮১৪ হয়ে যায় গর্বিত কৃষ্ণাঙ্গ নারী, নকল হীরেতে তাদের গা চাকচাক করে, তাঁদের স্থিরদৃষ্টিগুলো একে অন্যেরটায় বাঁধা পড়ে যায়। তিনি বলেন, “বাস্তবের নারীদেরকে তাঁদের নিজস্ব অনন্য ইতিহাস, সৌন্দর্য আর পটভূমিসহ আঁকার মধ্যে দিয়ে আমি শিল্পে কৃষ্ণাঙ্গ নারীর প্রতিনিধিত্বগুলোকে বৈচিত্র্যপূর্ণ করার কাজ করছি।”

 

শিল্পকর্ম পরিচিতি:

Le déjeuner sur l’herbe: Les Trois Femmes Noires ২০১০

কাঠের প্যানেলের ওপর নকল হীরে, অ্যাক্রিলিক আর এনামেল

৩০৪.৮ X ৭৩১.৫

 

শিল্পকর্ম পরিচিতি:
এদুয়ার মানে : Le déjeuner sur l’herbe ১৯৬৩
অয়েল অন ক্যানভাস
২০৮ সে.মি. ×২৬৪ সে.মি

 

(চলবে)

পর্ব-১: শিরীন নিশাত ও যারিনা হাশমি- দ্রোহ আর স্মৃতিকাতরতা

পর্ব-২: মহাজাগতিক সৃজনকারী শক্তি ও নারীর স্বরূপে ফেরা

পর্ব-৩: শিল্পের নতুন বিষয় ও শিল্পীর শরীর

পর্ব-৪: শ্রম বৈষম্য এবং সন্তান পালনের দলিল

পর্ব-৫: নারীর প্রতীকী ইতিহাস এবং শিল্পকর্ম হিসেবে দেহ

পর্ব-৬: দেহ ভাস্কর্য ও চিরন্তন মাতৃসত্তার বিরুদ্ধচিত্র

পর্ব-৭: গার্হস্থ্য জীবন আর অন-স্ক্রীন নারীত্বের স্বরূপ উন্মোচন

পর্ব-৮: দেহাস্ত্র এবং অনিরপেক্ষ প্রতিচ্ছবি

পর্ব-৯: বোধ স্বতন্ত্র এবং ফিউশন অস্বস্তিকর

পর্ব-১০ নির্যাতন নিরন্তর ও পিতৃতান্ত্রিক বিশ্বে নারী হওয়ার জটিলতা

পর্ব-১১: ব্যক্তিগত ক্ষমতায়ন এবং কৃষ্ণাঙ্গ নারী সমকামীর অভিজ্ঞতা

পর্ব-১২: পেশল বাস্তবতা আর পূর্বকল্পিত জেন্ডার বিষয়ক মতামত