September 20, 2024
ফিচার ২মুক্তমত

কর্মক্ষেত্রে নারীর অদৃশ্য শত্রু গ্লাস সিলিং ভাঙ্গবে কে?

মেহেরুন নূর রহমান।। আমি ঠিক নিশ্চিত না আমরা ঠিক কতজন গ্লাস সিলিং (Glass Ceiling) টার্মটির সাথে পরিচিত। গ্লাস সিলিং রূপক হিসেবে কর্মক্ষেত্রে অগ্রগতির ক্ষেত্রে ‘অদৃশ্য পক্ষপাতিত্বমূলক বাধা’কে উপস্থাপন করে যা মূলত নারী ও সমাজের সুবিধাবঞ্চিত মানুষের উপর আরোপ করা হয়। আজকের আলোচনা আমি নারীর উপর গ্লাস সিলিংয়ের প্রভাব- এর মধ্যেই সীমাবদ্ধ রাখবো।

১৯৭৮ সালে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে নারীবাদীরা প্রথম এই রূপকটি তৈরি করেছিলেন কর্মক্ষেত্রে উচ্চপদ অর্জনে নারীদের বাধার প্রসঙ্গে। এই টার্মটি কোন দেশকেন্দ্রিক নয়। এটি ব্যবহৃত হয় বিশ্বের সকল কর্মজীবী নারীদের জন্য যারা সম্ভাবনা থাকা সত্ত্বেও প্রতিষ্ঠানের উচ্চপদে আরোহন করতে পারেন না। গ্লাস সিলিং সাংগঠনিক পক্ষপাতভিত্তিক সেই কৃত্রিম বাধাগুলিকে প্রতিনিধিত্ব করে যা নারীকে তার প্রতিষ্ঠানের পরিচালনা পর্যায়ের পদে অগ্রসর হতে বাধা দেয়।

সকল কর্মজীবী নারী গ্লাস সিলিং টার্মটির সাথে পরিচিত না হলেও শুধুমাত্র নারী হবার কারণে পক্ষপাতমূলক সেই সব প্রতিবন্ধকতার সাথে খুব পরিচিত যা তাদের পেশার উন্নতিতে, বিশেষ করে ব্যবস্থাপনার উচ্চতর স্তরে (টপ লেভেল ম্যানেজমেন্ট) উঠতে অন্তরায় সৃষ্টি করে, যদিও সেই স্তরে যাবার যোগ্যতা তাদের আছে। এই জন্যই সম্ভাবনাময় অনেক নারীকেই কর্মক্ষেত্রে তাদের পুরুষ সহকর্মীদের থেকে পিছিয়ে পড়তে হয়। বেতন বৈষম্য, দেরিতে পদন্নোতি দেয়া, মিড ম্যানেজমেন্ট লেভেল-এর পর প্রমোশন আটকে দেয়া- এ সবই গ্লাস সিলিং এর পরিপূরক।

গত ২০ বছরে কর্মক্ষেত্রে নারীর সমাগম বেড়েছে। প্রাথমিক থেকে মধ্যবর্তী (এন্ট্রি টু মিড লেভেল) পর্যায়ে কাজ করছেন অনেকেই,  কিন্তু ক’জন নারীকে আমরা কার্যনির্বাহী পদে বা ব্যবস্থাপনার উঁচু স্তরে দেখতে পাই? বাংলাদেশের মত উন্নয়নশীল দেশের কথা না হয় বাদই দিলাম, বিশ্বের উন্নত দেশগুলোতেও প্রতিষ্ঠানের শীর্ষ পদে নারী পুরুষের তুলনামূলক অনুপাত অসমান।

এই যে নারীরা উচ্চপদে যেতে সাংগঠনিকভাবে বাধাপ্রাপ্ত হচ্ছেন এর কারণগুলো কী? এর প্রধাণ কারণ দীর্ঘদিন ধরে চলমান পিতৃশাসিত সমাজের প্রভাব, যার ফলে-

নারীকে এখনো পুরুষদের সমকক্ষ মনে করা হয় না।

এখনো মনে করা হয় নারীর প্রধানতম দায়িত্ব সংসার পালন এবং সন্তান উৎপাদন।

মনে করা হয় নারীরা ঘরে থাকতেই বেশি পছন্দ করে এবং এক্সিকিউটিভ লেভেলে প্রবেশের জন্য যে পরিমান মনোযোগ ও দক্ষতা দরকার তা তাদের নেই। মনে করা হয় উচ্চপদের জন্য প্রয়োজনীয় সময় এবং শ্রম তারা দিতে অক্ষম।

নারীর মেধার উপর অনাস্থা- যদিও মেধার এই পরীক্ষাতে বহু নারী পুরুষদের সমপর্যায়ের বা বেশি সক্ষম তা প্রমাণিত।

নারী নেতৃত্বে (লিডারশিপ) অনভস্ততা এবং নারী নেতৃত্বের প্রতি অবজ্ঞা, অনীহা এবং সন্দেহপ্রকাশ।

উপরোক্ত বিষয়গুলো কর্পোরেট ম্যানুয়ালে পাওয়া যায় না বা কোনও ব্যবসায়িক মিটিংয়ে  আলোচনা করা হয় না। এগুলো মূলত অদৃশ্য, এবং অব্যক্ত ধারণা যার কারণে মনে করা হয় কার্যনির্বাহী স্তরের নেতৃত্বের জন্য পুরুষেরাই বেশি উপযোগী। যদিও উচ্চপদে অবস্থানরত বহু নারী উপরোক্ত সব  ক’টি পয়েন্টকে মিথ্যা প্রমাণ করেছেন।

সমাজের চাপ তো রয়েছেই কিন্তু যথেষ্ট প্রতিভা ,যোগ্যতা এবং সুযোগ থাকা সত্ত্বেও বহু নারী এই গ্লাস সিলিং ভাঙ্গতে পারছে না শুধুমাত্র নিজের ইচ্ছাশক্তির অভাবে। তাদের পিছিয়ে থাকবার নানা কারণের মাঝে, নিন্মোক্ত কারণগুলোতে জোর দিচ্ছি বেশি-

অল্পে তুষ্টি মনোভাব: নারীদের যোগ্যতার চেয়ে কম পেয়েও সন্তুষ্ট থাকার অভ্যস্ততা যা পিতৃতান্ত্রিক সমাজেরই অবদান। নেগোশিয়েট করতে তারা তেমন উদ্যোগী হয় না। প্রমোশন বা বেতন বৃদ্ধির দাবি জোর গলায় প্রকাশ করতে চায়না।

নিজের প্রতিভাকে অবমূল্যায়ন করা: শুধু সমাজ না, নারী নিজেও নিজের প্রতিভাকে সঠিক মূল্যায়ন করতে জানে না। বহু প্রতিভাবান নারীকে দেখেছি কত সহজে নানা সাংসারিক চাপে সম্ভাবনাময় কেরিয়ার থেকে সরে আসতে।

প্রযুক্তির প্রতি অনীহা: যদিও প্রযুক্তির দিকে নারীদের আগ্রহ আগের চেয়ে বাড়ছে কিন্তু এ ব্যাপারে তাদের আরো বেশি দক্ষতা বাড়ানো দরকার।

জয়ী হবার মনোভাবের অভাব: নারীরা যোগ্যতাসম্পন্ন হবার পরও কর্মক্ষেত্রে চূড়ান্ত সফলতার জন্য যে যুদ্ধ বা দ্বন্দ্ব বা প্রতিযোগিয়ায় যেতে হয়, অনেক্ষত্রেই তারা তাতে যেতে চায় না। ফলে বহু ক্ষেত্রেই তাদের চেয়ে কম যোগ্য পুরুষ সহকর্মী সামনে এগিয়ে যায়। অথচ একটু Winning Attitude তাকে নিয়ে যেতে পারতো সর্বোচ্চ শিখরে।

২০১৯ সালে প্রকাশিত ILO (International labour Organisation) এর একটি প্রতিবেদন ‘Women in Business and Management: The business case for change’-এ  বলা হয়েছে, পুরুষদের তুলনায় নারী নেতৃত্বের ব্যবসা বেশি সফলতা নিয়ে আসে। বলা হয়েছে, যে সব  প্রতিষ্ঠানের উচ্চ স্তরে (সিনিয়র লেভেলে) লিঙ্গ বৈচিত্র্য (Gender Diversity) আছে, সে সব প্রতিষ্ঠানের কর্মদক্ষতা বেশি ভালো এবং তারা উল্লেখ করার মত মুনাফার মুখ দেখছে।

এই প্রতিবেদনটির জন্য ৭০টি দেশের প্রায় ১৩ হাজার প্রতিষ্ঠানের উপর জরিপ চালানো হয়েছিল। ৫৭% এর বেশি উত্তরদাতা স্বীকার করেছে যে উচ্চপদে লিঙ্গ বৈচিত্র্যর কারণে তাদের প্রতিষ্ঠানের ব্যবসায়িক কার্যক্রম আগের চেয়ে উন্নত হয়েছে। এই সকল প্রতিষ্ঠানের ৬৬% স্বীকার করেছে যে কার্যনির্বাহী পদে লিঙ্গ বৈচিত্র্য’র কারণে তাদের মুনাফা ৫% থেকে ২০% বৃদ্ধি পেয়েছে (বেশিরভাগের ক্ষেত্রে মুনাফার এই উর্ধ্বগতির পরিমান ১০% থেকে ১৫%)।

প্রায় ৫৭% স্বীকার করেছে এই ধরণের ব্যবস্থাপনা মেধাবী ও প্রতিভাবান কর্মীদের আকৃষ্ট এবং ধরে রাখতে সাহায্য করছে। ৫৪% এরও বেশি বলেছে যে তারা তাদের প্রতিষ্ঠানে সৃজনশীলতা, উদ্ভাবন ও স্বচ্ছতায় লক্ষণীয় উন্নতি লক্ষ্য করেছে এবং তারা মনে করে এই ব্যবস্থাপনা কাস্টমারদের কাছে তাদের কোম্পানির বিশ্বাসযোগ্যতা ও খ্যাতি বাড়িয়েছে।

সুতরাং নারী নেতৃত্ব বা উচ্চ পদে নারীর পুরুষের পাশপাশি সমান উপস্থিতি যে কোন প্রতিষ্ঠানের জন্য কল্যাণকর, তা বলাই বাহুল্য। উন্নত বিশ্বে এই সারসত্য কিন্তু মালিকপক্ষ বুঝতে পেরেছে। এসব দেশের বড় বড় প্রতিষ্ঠান টপ লেভেলে লিঙ্গভিত্তিক সমতা (জেন্ডার ব্যালেন্স), বেতনের সমতা- এসব নিয়ে কাজ করছে। আমাদের দেশেও সময় হয়েছে এই গ্লাস সিলিং ভেঙ্গে ফেলার। সহজ নয় কিন্তু কাজ করে যেতে হবে।

প্রিয় নারীরা, চাইলে আপনি ঊনমানুষ হয়ে, পরনির্ভরশীল হয়ে জীবন কাটিয়ে দিতে পারেন। কিংবা পারেন নিজস্ব একটি পরিচিতি/অস্তিত্ব তৈরি করতে। স্বকীয়তা ও পরিচয় নিয়ে বাঁচতে চাওয়া নারীদের জন্য কোন কিছুই সহজে আসেনি। জীবনের প্রতিটি ক্ষেত্রে সফলতার জন্য তাকে পরিবার, সমাজ সবকিছুর সাথে লড়াই করতে হয়েছে। আপনি যদি যোগ্যতাসম্পন্ন হন, আপনার যদি সঠিক দক্ষতা থাকে, আপনার মাঝে যদি লিডারশিপ কোয়ালিটি থাকে তবে তা অবহেলায় নষ্ট করবেন না। নিজের ভেতর ডেডিকেশন আর উইনিং এটিটিউড নিয়ে আসুন। এগিয়ে যান সামনে। গ্লাস সিলিং ভেঙ্গে টপ লেভেল ম্যানেজমেন্টে নিজেকে প্রতিষ্ঠা করে নেতৃত্ব দিন। মনে রাখবেন, আজ আপনার দেখানো পথেই আগামী দিনের মেয়েরা হাঁটবে।

 

[ফেমিনিস্ট ফ্যাক্টরে প্রকাশিত মুক্তমত লেখকের নিজস্ব বক্তব্য]