নারীকে কেন পুরুষের অনুমতি নিতে হয়?
আঞ্জুমান রোজী।। স্বাধীনতা শব্দের নিজস্ব অর্থ আছে। যার অর্থ আত্মসংযম। ইংরেজীতে যাকে বলা হয় Self Control। স্ব+অধীনতা=স্বাধীনতা। স্ব হলো নিজ/আত্ম আর অধীনতা হলো সংযম/নিয়ন্ত্রণ। অর্থাৎ স্বাধীনতার অর্থ আত্মসংযম/self control। এভাবে যদি ভাবি তাহলে স্বাধীনতা মানে স্বেচ্ছাচারিতা নয়। আচার-আচরণ, ব্যবহার, ভাবভঙ্গি, কথাবার্তায়, মেধা, মননে, শিক্ষায় নিজের উপর নিজে নিয়ন্ত্রণ করা, সংযমী হওয়া এবং নিজেকে পরিচালনা করার ক্ষমতাই হলো স্বাধীনতা। এমন স্বাধীনতা অর্জনকারী মানুষের প্রতি বিশ্বাস জাগে, শ্রদ্ধা জাগে কারণ সে মানুষ হিসেবে নিজেকে প্রতীয়মান করতে সক্ষম হয়। এসব বাছবিচারে এবং মূল্যায়নের ক্ষেত্রে আমরা পুরুষকেই বেশি অগ্রাধিকার দিয়ে থাকি। কারণ, স্বাধীনতা বিষয়টি একমাত্র পুরুষেরই প্রাপ্য বলে গণ্য করা হয়৷ অনুন্নত এবং উন্নয়নশীল দেশে অর্থাৎ যেখানে পুরুষতান্ত্রিক সমাজ রয়েছে সেখানে নারী মানেই পরগাছা, তাকে অন্যের উপর নির্ভর করেই চলতে হয়। যতই মেধা, শিক্ষা, মননে, চিন্তা-চেতনায় নারী আত্মসংযমী হয়ে ব্যক্তিত্ববান হোক আর স্ব-স্বাধীনই হোক না কেন, যুগ যুগ ধরে সমাজব্যবস্থায় নারীকে পরাধীন করে রাখা হয়েছে। অর্থাৎ নারীর কোনো স্বাধীনতা নেই।
স্বাধীনতা বিষয়টি মানুষের মৌলিক অধিকারের মধ্যে পড়ে। যা মানুষের স্বতঃস্ফূর্ত বিকাশের প্রথম শর্ত। মানুষমাত্রই স্বাধীন। সে পরাধীন হতে জানে না। নারী কিংবা পুরুষ কেউই পরাধীন হতে চায় না। সামাজিক বিধিব্যবস্থা, আইনকানুন, ধর্মীয় অনুশাসন যুগের পর যুগ মানুষকে অনেকাংশে পরাধীন করে রেখেছে। সুশৃঙ্খল জীবনব্যবস্থা এবং রাষ্ট্রব্যবস্থা সুবিন্যস্ত আকারে পরিচালিত করার জন্যই নিয়মকানুন, ধর্ম এবং আইন। কিন্তু মানুষের স্বাধীনচেতা মনোভাব কোনো নিয়মেই আটকা পড়ে না। মননের দিক থেকে প্রতিটি মানুষই স্বাধীন। এই স্বাধীন বিষয়টি আবার নারী-পুরুষে ভেদাভেদ আছে। পুরুষের স্বাধীনতা আর নারীর স্বাধীনতার মধ্যে দিনরাত্রির পার্থক্য। যদিও মননের দিক থেকে নারী-পুরুষের কোনো পার্থক্য নেই। একমাত্র শরীরবৃত্তীয় ছাড়া। চিন্তাচেতনায়, বুদ্ধিমত্তায়, একটি নারী পুরুষের মতই স্বাধীনতাচেতা হতে পারে। সমাজ, সংসার, রাষ্ট্র সেই অর্থে নারীকে স্বাধীনতা দিচ্ছে না। বরঞ্চ উল্টো যা হয় পুরুষের ইচ্ছা অনিচ্ছার মূল্য দিতে গিয়ে নারীকেই তার স্বাধীনতা জলাঞ্জলি দিতে হচ্ছে।
নারীর স্বাধীনতা নারীর কাছে। নারীই তার নিয়ন্তা। অথচ সমাজব্যবস্থা এমনভাবে আছে, যেখানে নারী পরাধীন হয়ে আছে। নারী জন্মে বাবা দ্বারা নিয়ন্ত্রিত, বড় ভাই থাকলে বড় ভাই দ্বারা নিরন্ত্রিত, বিয়ে হলে স্বামী দ্বারা নিয়ন্ত্রিত এবং বৃদ্ধ বয়সে পুত্র দ্বারা নিয়ন্ত্রিত। এটা হলো খুবই স্বাভাবিক দৃশ্য। যে দৃশ্যের অবতারণা মূলত ধর্মীয় গোঁড়ামি থেকে শুরু হলেও এখন সমাজের রন্ধ্রে রন্ধ্রে তা ঢুকে গেছে, হয়ে গেছে প্রথা। যার ফলে, অনেকসময় বিবাহিত নারীকে তার স্বামীর কাছ থেকে শুনতে হয়, ‘আর কত স্বাধীনতা চাও? অনেক স্বাধীনতা তোমাকে দেয়া হয়েছে!’ এমন কথায় যে কোনো সচেতন, ব্যক্তিত্ববান নারীর মাথায় আগুন ধরে যাবে। একজন পুরুষ একজন নারীকে কীভাবে স্বাধীনতা দেয়? আমার মাথায় তা আসে না। স্বাধীনতা দেয়ার মালিক কেউ নয়। স্বাধীনতা যার যার এখতিয়ারভুক্ত। এখন কে কীভাবে স্বাধীনতা ভোগ করবে সেটা তার ব্যক্তিগত অভিরুচি। অবশ্যই এই অভিরুচি তৈরি হবে তার মেধা, শিক্ষা এবং মননের শক্তিমত্তা দিয়ে। একজন নারী যখন এসব অর্জন করে তখন কোন পুরুষের অধিকার নেই সেই নারীটিকে আটকিয়ে রাখে। ব্যক্তিত্ববান সুচিন্তিত নারী কখনই চাইবে না তার উপর কেউ কর্তৃত্ব করে। অথচ নারীর ক্ষেত্রে পুরো সমাজটাই অভিভাবকের দায়িত্ব পালন করে। হুকুমদারী করে সবকিছুতে। নজরদারী করে নারীর নাড়িনক্ষত্র, যা সত্যিই অনভিপ্রেত। অনেকক্ষেত্রে পৈশাচিক এবং অমানবিক।
একজন নারীর জন্ম থেকে মৃত্যু পর্যন্ত প্রতিটি ক্ষেত্রে গভীর দৃষ্টিতে চিন্তা করলে পরিষ্কারভাবে উঠে আসবে নারীর জীবন কতটা ভয়াবহ। এই ভয়াবহতার পেছনে যে কেবল পুরুষ সমাজ দায়ী তা নয়, বরং নারী ও পুরুষ সমানভাবে দায়ী। কারণ, নারীপুরুষ উভয়েই নারীকে বিশেষ আঙ্গিকে দেখতে অভ্যস্ত হয়ে ওঠে। যদিও পুরুষের মতো স্বভাবজাত, প্রকৃতিজাত এবং স্বতঃস্ফূর্ত নারীরও ইচ্ছে করে ইচ্ছে স্বাধীন ঘুরে বেড়াতে। মনখুশীতে জীবন গড়তে। অথচ সামাজিক বিধিব্যবস্থায় এবং ধর্মীয় প্রণোদনায় নারীর জীবন হয়ে উঠে অপাঙ্কতেয়, অথর্ব এবং হয়ে ওঠে এক অবলা প্রাণি। জন্মের পরেই একটি মেয়ে শিশুকে গড়ে তোলা হয় পুতুলের মতো। তার ভেতরে আত্মবিশ্বাস গড়ে উঠতে দেয়া হয় না। কারণ সমাজ জানেই যে এই শিশুটি বড় হয়ে কারো না কারোর অধীনে যাবে। কারণ নারীকে ধরেই নেয়া হয় মেধায়, মননে, শিক্ষায় দুর্বল। নারী যে দুর্বল না তা সভ্য সমাজে বেশ ভালোভাবেই প্রমাণ হয়েছে বটে তবে সমাজের বৃহদাংশের দিকে তাকালে এখনো অনেক নারী অন্ধকার নিপীড়নের মধ্যে দিন কাটাচ্ছে, যেখানে তাদের মানুষের মর্যাদাটুকুই নেই।
এখন সময় বদলে যাচ্ছে। নারী তার অধিকার বুঝে নিতে পারছে। স্বশিক্ষিত হয়ে নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করছে৷ যদিও সংখ্যায় খুবই কম এমন নারী। তবে নারী জেগে উঠছে। সচেতন হচ্ছে। এই সচেতনতা চারদিকে ছড়িয়ে গেলে নারী স্বশিক্ষায় উদ্ভাসিত হবে আরো বেশি, হবে আরো আত্মবিশ্বাসী। এমন দিন আর বেশিদূরে নয়। কিন্তু এখনো সেই সমস্ত শিক্ষিত, ব্যক্তিত্ববান,সচেতন নারী পুরুষ দ্বারা নিষ্পেষিত হচ্ছে। নারীর স্বাধীনতা খর্ব হচ্ছে।পুরুষের খড়্গ নারীর উপর ঝুলেই আছে। আমার প্রশ্ন, কিন্তু কেন?
কেন নারী পুরুষের অধীনস্ত হয়ে থাকবে? কেন নারী পুরুষের অনুমতি ছাড়া কোনোকিছুই করতে পারবে না? অবশ্যই যে কোনো বিষয় নারী পুরুষ একে অপরকে জানাবে। এই জানানোর অর্থ অনুমতি নেয়া নয়। পুরুষ অনেক কাজ না জানিয়েই করে ফেলে, অনুমতি নেয়ার প্রয়োজনই মনে করে না। অথচ নারীর বেলায় কেন? একবার আমার আম্মাকে বলেছিলাম, ‘আপনি সবসময় আব্বার অনুমতির জন্য অপেক্ষা করেন কেন? আপনার বাবার বাড়ি যেতে ইচ্ছে করছে, চলে যান। শুধু যাওয়ার সময়ে বলে যান, আপনি যাচ্ছেন। ব্যাস।’ আমার আম্মা আঁতকে উঠেছিলেন। আমি তখন ক্লাস এইটে পড়ি। পরে আম্মা খালা, ফুফু আরো অনেকের কাছে বলেছেন, ‘আমার মেয়েটাকে নিয়ে ভয় হচ্ছে। এখুনিই এভাবে কথা বলে!’ আম্মা কলেজে ভর্তি হয়ে বেশিদিন ক্লাস করতে পারেননি। কারণ, আমার জন্ম হয়েছিল বলে। অথচ আম্মার খুব আক্ষেপ ছিল লেখাপড়া করতে পারেননি বলে। সবসময় প্রচুর বই পড়তেন ঠিকই কিন্তু পুরুষশাসিত সমাজটাকে খুব ভয় পেতেন। সবসময় লক্ষ্য করেছি, সব বিষয়ে আব্বার কাছ থেকে অনুমতি নিতেন। যা আমাকে পরবর্তীতে প্রতিবাদী করে তোলে।
অনেক নারী উচ্চশিক্ষিত এবং উচ্চপদমর্যাদায় আছেন। তারা তাদের জব কেরিয়ার নিয়ে ব্যস্ত থাকেন। কিন্তু বিয়ের পর এসব নারীর কেরিয়ারের উপর প্রচণ্ড চাপ আসে। পুরুষ তার ক্যারিয়ার রক্ষার্থে কিংবা আরো উপরে ওঠার সবরকম প্রচেষ্টা চালিয়ে যাবে কিন্তু নারীর বেলায় তা গৌণ হয়ে আসে। এমনকি নারীকে কর্মক্ষেত্রে যেতেই দিতে চায় না এই পুরুষতান্ত্রিক সমাজ। অবশ্যই সন্তানধারণ করার যোগ্যতা আছে একমাত্র নারীর। সন্তান গর্ভে নেয়ার জন্য নারীর শারীরিক, মানসিক প্রস্তুতি আছে কিনা নারীই তা বুঝবে। তার উপর চাকরি, ক্যারিয়ার সবকিছু ঠিক রেখে বাচ্চা নেয়া সম্ভব কিনা, এ ব্যাপারে নারীই সিদ্ধান্ত নেবে। স্বামী-স্ত্রী আলোচনা করতে পারে, পরামর্শ করতে পারে কিন্তু সিদ্ধান্ত নেয়ার এখতিয়ার একমাত্র নারীর। অথচ বাচ্চা নেয়ার ক্ষেত্রে আমাদের দেশে নারীর কোন ভূমিকাই থাকেনা। স্বামী আর শ্বশুরবাড়ির ইচ্ছায় শিক্ষা, ক্যারিয়ার সবকিছু ত্যাগ করতে হয়; যারা ত্যাগ করতে পারছে না, নিজ ব্যক্তিত্বকে ছোট করে কারো অধীনস্ত থাকার মানসিকতা রাখতে পারছে না, তারাই এগিয়ে যায় নিজ মহিমায়। তারপরও পুরুষ তার পুরুষালি মানসকিতার পরিবর্তন করবে না।
একজন পুরুষ যখন নিজ স্বাধীন ইচ্ছায় চলতে চায়, একজন নারীও চায় তার স্বাধীন ইচ্ছায় চলতে। একই ছাদের নিচে বসবাসকারী স্বামী স্ত্রী যে কোন বিষয়ে আলোচনা করতে পারে, পরামর্শ করে যে কোনো কাজের সিদ্ধান্ত নেয়া যেতে পারে। তাই বলে একে অপরের সিদ্ধান্ত চাপিয়ে দেয়ার কোনো অধিকার কারোর নেই। বেশিরভাগ সংসারই ভাঙ্গে স্বামী স্ত্রীর ব্যক্তিত্বের সংঘাতে। কেউ একজন কর্তৃত্বপরায়ণ হলেই সমস্যা। আর এই সমস্যাটা বেশি করে পুরুষ। পুরুষের এই মানসিকতা যতদিন চলবে ততদিন সংঘাতও চলবে, ভাঙ্গনও চলবে। আমরা অনেক সময় পুরুষের অনেক ব্যাপার দেখেও না দেখার ভান করি অর্থাৎ পাত্তা দেই না, ধরেই নেই এটা পুরুষের কাজ। পুরুষের অনেক কুকর্মের কাজেরও প্রশ্রয় দেয়া হয়। কারণ, সমাজ মনে করে পুরুষমাত্রই এমন। যেন পুরুষের স্বভাবচরিত্র প্রকৃত প্রদত্ত। তাই পুরুষ যত অন্যায়ই করুক না কেন তাকে স্বাভাবিকভাবে নিতে হবে। ঠিক এই মানসিকতাটা নারীর ক্ষেত্রেও শতভাগ প্রযোজ্য। নারীকেও প্রকৃতির সন্তান মনে করে ছেড়ে দেয়া হোক। তাকেও তার প্রাপ্য স্বাধীনতা দেয়া হোক। একটি প্রচলিত পঙতি আছে-
‘স্বাধীনতাহীনতায় কে বাঁচিতে চায়
দাসত্ব শৃঙ্খল বল কে পরিবে পায়’
কেউ না। নারীও না, পুরুষও না। কারোর মধ্যেই পরাধীনতার মানসিকতা থাকে না।
সর্বোপরি বলতে চাই নারী পুরুষ কারোর উপর অনাধিকার চর্চা অমানবিক পর্যায়ে পড়ে। নারীর স্বাধীনতা নারীর কাছে। পুরুষের স্বাধীনতা পুরুষের কাছে। কে কীভাবে স্বাধীনতা ভোগ করবে সেটা যার যার ব্যক্তিগত অভিব্যক্তি। অনাধিকার চর্চাই হলো এই সমাজ সংসারের সব নষ্টের মূল। একজন শিক্ষীত, সচেতন, বুদ্ধিদীপ্ত, স্বাধীনচেতা নারীর এমন কোন পুরুষের দরকার নেই, যে পুরুষ কর্তৃত্বপরায়ণ হয়। সময় এসেছে, পুরুষকেও ভাবতে হবে যে নারীও এক স্বাধীনসত্তার নাম।
[ফেমিনিস্ট ফ্যাক্টরে প্রকাশিত কলাম লেখকের নিজস্ব বক্তব্য]