November 1, 2024
সাহিত্যফিচার ২স্যাটায়ার

বাটপারি বাঈয়ের ওষ্ঠরঞ্জনি

মাসকাওয়াথ আহসান।। লীলাবতী গ্রেফতারের সংবাদে; সাতে পাঁচে থাকিনা দাদার মন খারাপ হয়ে গেছে। স্ট্যাটাসে ফুল-লতা-পাতা নান্দনিক পোস্ট ঝেড়ে দিয়ে এরপর লীলাবতীর ছবিগুলো নিয়ে কালচার করার সময়; সাতে পাঁচে থাকিনা দাদার বুকের হৃদস্পন্দন বেড়ে যায়। মনের মধ্যে গান বাজে, হলুদিয়া পাখি সোনারি বরণ; পাখিটি ধরিলো কে!

এই গ্রেফতারে সন্তোষ প্রকাশ করে সহমত ভাই ফেসবুকে #ধন্যবাদপ্রধানমন্ত্রী লিখে; তারপর লীলাবতীর ছবি নিয়ে পিসি কালচার করে; ফোনে ল্যাপটপে আর কাজ হচ্ছে না। এমন দেহবল্লরী; এমন অঙ্গসৌষ্ঠব; এতোটা প্রতিশ্রুতির আলো ছোট স্ক্রিণে হাঁসফাঁস করে; সে মুক্তি চায় ওয়াইড ওয়াইড ওপেন ক্যানভাসে।

খিলাফত ভাইয়া এই গ্রেফতারে মূল্যবোধের অবক্ষয় সম্পর্কে নাতিদীর্ঘ মাসলা-মাসায়েল হাজির করে ফেসবুকে। সে ফতোয়া দেয়, উন্মুক্ত বক্ষা এই নারী জাহান্নামি।

তার এক কমরেড জিজ্ঞেস করে, ভাই কি এক্সরে কইরা ফালাইলেন নাকি! আমি তো তার জামা-কাপড় দেখলাম।

– যাহা বোঝোনা তাহা লইয়া কথা বলিতে আসিও না গিফারি। তুমি বিপথগামী হইয়াছো ইহুদি-নাসারাদের তৈরি ফেসবুকের ক্ষপ্পরে পড়িয়া। আমি বলিতেছি, পর্দা-পুসিদার কথা।

কমরেড গিফারি তর্ক করে, ইহুদি নাসারাদের দেশে স্বাস্থ্যখাতের লীলাবতী তো দেখিলাম না; যদিও তাদের পর্দা-পুসিদা বেখাপ্পা। পর্দা-পুসিদা করিয়াও দুর্নীতিবাজ স্বামীর বেগামাত চালাইয়া গেলো বাবর-বদি-পাপলু-দুলু- বিশ্রামে ক্লান্ত আমলার স্ত্রী; কিছু সংরক্ষিত স্বর্ণালংকার আপা। পর্দা না করিয়াও, এমেরিকার কৃষ্ণাঙ্গ যুবক হত্যাকারী শ্বেতাঙ্গ পুলিশের বিবি তাকে ছাড়িয়া গেলো। অথচ পর্দা-পুসিদাস্তানের বেগামাতেরা সবাই স্বামীর দুর্নীতির সাফাই গাহিতেছে। চোখের পর্দা যাহাদের নাই; তাহাদের পোশাকের পর্দা লইয়া আমরা কোন দোজখে যাইবো।

– সত্যি করিয়া বলো গিফারি; তুমি কি আমাদের তোরাবোরার বাইতুল খিলাহ লইয়া অখুশি; একুন পাকা পায়খানার লোভে ইউরোপে এসাইলামে গিয়া “বিড়ালাক্ষী বিধুমুখী মুখে গন্ধ ছোটে” ইহুদি-নাসারা নারী হাসিল করিতে চাও।

– কথা দিতেছি খিলাফত ভাইয়া, এমন হইলে ‘লভ জিহাদ’ করবো; তাহাকে পর্দা-পুসিদা সহকারে পর্দা-পুসিদাস্তানের সায়াতলে নিয়ে আসবো। ইনকিলাব জিন্দাবাদ।

জিজ্ঞাসাবাদের জন্য লীলাবতী এসেছে; এই খবরে জিজ্ঞাসাবাদ দপ্তরে ঈদুল লীলাবতী ফেস্টিভ্যাল চলছে। যে প্রহরী লাঞ্চব্রেক বলে গিয়ে ব্যারাকে নাক ডেকে ঘুমায় প্রতিদিন; তার চোখে আজ সিয়েস্তা নাই। বেশি কিছু না; লীলাবতীর যাওয়া-আসার পথের ধারে; এক নজর দেখাই সই; এমন আইটেম নম্বর তো এই ভেজালের অফিসে কম আসে। আইটেম ডান্স দেখার কপাল তো আর গরিবের নাই। ঐগুলি দেখতে হাতির পদে বসতে হয়।

এক বাচ্চা হাতি; খানিকটা মেট্রোসেক্সুয়াল পুরুষ; জিম করে; ফেসিয়াল করায়; ফেসবুক প্রোপিকে সরকারি শোবিজ তারকার মতো দেখাতে এসব করতে হয়। আজ সে একটা চেক চেক টি-শার্ট পরে; যে টি-শার্ট পরে সে সহমত ভাইদের কফিশপের আড্ডায় যায়; মার্কেজের জাদুবাস্তবতা নিয়ে ইন্টেলেকচুয়াল খঞ্জনি শোনে মুগ্ধ চোখে। আজ সে খানিকটা ফরাসি সৌরভ মেখে; নিজেকে জিজ্ঞাসাবাদের জন্য প্রস্তুত করে।

জিজ্ঞাসাবাদ কক্ষে; লীলাবতী এমনভাবে বসে আছে; যেন এক্ষুণি গান গেয়ে উঠবে, ডার্লিং আঁখোছে আঁখো শেয়ার করনে দো।

সে তো জানেই গায়ক যতই আহলাদ করে বলুক না কেন, তুমি লুটপাট হয়ে যাবে; আসলে তো লুটপাট হয় গায়ক। লীলালতী নিজেই একটি পাওয়ার প্ল্যান্ট। এই বিজলির খাম্বায় তড়িতাহত হয়ে কতো হাতি-ঘোড়া গেলো তল; এখন মশা এসে বলে কতো জল!

– আপনি ফেইক টেস্ট রিপোর্ট কেন দিয়েছেন?
– আপনারা নিয়মিত ফেইক চার্জশিট দেন; তাই সবাইকেই এমন মনে করেন কেন?
– আপনি বলতে চান আপনি জ্যাক কিউ দানিয়েল কোম্পানির চেয়ারম্যান নন!
– আমি স্বপ্নের চেয়ারম্যান। যখন জ্যাক এবং দানিয়েল এরা দু’জনেই আমাকে প্রেম দিতে ব্যর্থ হয়েছে; আমার স্বপ্ন ভেঙ্গে গেছে।
– আপনি ফৌজদারি অপরাধ করেছেন।
– ফৌজদারি অপরাধে তো জমিদার বাড়ির বেগমরাও জড়িত; কৈ তাদের কাউকে দেখছি না যে। ন্যায়বিচারের আমের আচার খাওয়াতে আপনাদের ম্যাঙ্গো বাঈকে শুধু ধরে এনে নাচাতে হয়। নিয়মটা অদ্ভুত জানেন; শত শত বছর ধরে ম্যাঙ্গো বাঈ নাচে; আর পর্দার আড়ালে বসে বেগম সাহেবারা কুটুস কুটুস করে এলাচি খায়; তাদের হাতের নাচের মুদ্রা টেকাটুকা গোনার নাচেই সন্তুষ্ট।

সাহিত্য প’ড়ে লোক ঠেঙ্গাতে আসা এক কর্মকর্তা বলে, জেন্ডার সেনসিটিভিটির কারণে আপনি যদি ভাবেন যে, সেলফি জোকারের শাস্তি হবে আর আপনি বাটপারি বাঈ ওষ্ঠরঞ্জনি দেখিয়ে পার পেয়ে যাবেন; ওটি আর হচ্ছেনা মহাশয়া।

লীলাবতী বাঁকা চোখে তাকায়; ১৩০ ডিগ্রি এঙ্গেলে চোখের কর্নিয়া প্যান করে একটা প্যানোরোমিক ভিউ নেয়; ব্যর্থ মানুষের আসর; স্যার স্যার করে জীবন তেজপাতা করা লোকজন। এরা পাওয়ার প্ল্যান্টের কোহিনূর হতে চায়; বিপ্লব হতে চায়। তাই ন্যায় বিচারের আচার তৈরির কারখানা খুলে বসেছে।

লীলাবতী কটাক্ষ করে, কেমন মরদ যে, সেলফি জোকারকে এরেস্ট করতে পারলে না। সে কী ওসামা বিন সাহেদ; তাকে তোমরা এবোটাবাদ থেকে ধরে তার ছিন্ন মস্তক থালায় করে পরিবেশন করবে রঙ্গভবনে? নাকি! বাতাবি লেবু টেলিভিশনে লাইভ দেখাবে গ্রেফতার অভিযান।

আর দেখো লীলাবতীকে চট করে ধরে নিয়ে এসে এখানে জিজ্ঞাসাবাদের মুজরো বসিয়েছো। তোমাদের চোখে পাকিস্তানের খান সেনার নারী-লোলুপতা চোখে পড়েছে গো। ছিঃ এটা খুব খারাপ। তোমাদের কি ঘরে মা বোন নেই! এটা বলেই জানালার শার্সি ভেঙ্গে ফেলা হাসির রিনি রিনি তোলে লীলাবতী।

সাহিত্যের ছাত্ররা বোকা হয়; তাই চট করে আবার লীলাবতীর ফাঁদে পা দেয় সিনসিয়ার তরুণ অফিসার, দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে হিটলারের যে বান্ধবী তার রক্তগঙ্গার দিনগুলোতে খুশিজলের পোল ডান্স করতো; তার কি কোন অপরাধ নেই; কিংবা ধরুন একাত্তরের যুদ্ধে ইয়াহিয়া যখন গণহত্যার বিষাদসিন্ধু তৈরি করেছে; তখন যে ব্ল্যাক বিউটি খুশির সিন্ধুতে নাচতো; সে কি অপরাধী নয়!

লীলাবতী মুগ্ধ হয়ে তাকায়। এগিয়ে যায় এমন করে যেন এক্ষুণি ল্যাপড্যান্স করবে। তরুণটি ভয় পেয়ে জিজ্ঞাসাবাদ কক্ষ থেকে বেরিয়ে গিয়ে এক সিনিয়ার আপা বসকে পাঠায়। আপা ঢুকেই বলে, এই মেয়ে আমাকে ম্যাডাম বলে ডাকবে!

লীলাবতী চোখের অনলে ভস্ম করে দেয় ম্যাডামকে। চেয়ারে ম্যাডামের ছাই পড়ে থাকে।

একজন জিজ্ঞাসাবাদকারী বলে, আপনি তো যোগ্য মানুষ। অযথা পাওয়ার পোল ডান্সে গেলেন কেন!

– কারণ আমি পাওয়ার পোলের মেয়ে নই যে সেমিনার করে নিজেকে মাদার তেরেসার ব্র্যান্ডিং করবো; আমার বাবা বিরাট দেশপ্রেমিকের সার্টিফিকেট জোগাড় করতে পারেনি যে; আমি পাওয়ার পোলে ভরত-নাট্যমের মুদ্রায় নতুন প্রজন্মের দেশপ্রেমিকের ঠাপ্পা লাগিয়ে নেবো। তাই আমার হাতে পাওয়ার পোলের সঙ্গে সেলফি টপ্পা গাওয়া ছাড়া আর কোন অপশন নেই।

– আপনি ভুয়া সার্টিফিকেট দেয়ায় বিশ্বে দেশের দুর্নাম হলো; এটা কেন করলেন আপা?

লীলাবতীর চোখে অনুতাপের অশ্রু ধেয়ে আসতে চাইলে সে গেয়ে ওঠে, ডার্লিং আঁখোছে আঁখো শেয়ার করনে দো। ডার্লিং আঁখোছে আঁখো চিয়ার করনে দো; রোখনা রোখনা মুঝকো পেয়ার করনে দো।

ভোটের রাতে ইনসমনিয়ায় আক্রান্ত এক কর্মকর্তা বিরক্ত হয়ে বলে, স্টপ দিস ননসেন্স।

লীলাবতী ফেসবুকের মতো হাহাহাহাহা হেসে বলে, জমিদারের ছেলে-মেয়েদের সাত খুন মাফ হয়ে যায়। আমি নো বডি বলে খুব ক্ষ্যমতা দেখাছে গো বাবু; ও বাবু সাপ খেলা দেখবেন গো বাবু; নাগ-নাগিনীর খেলা।

মাসকাওয়াথ আহসান: শিক্ষক ও সাংবাদিক