December 23, 2024
কলামফিচার ২

এক যে ছিল স্বামী…

ইকরাম কবীর।। শিরিন আখতারের (আসল নাম নয়) গায়ের রঙ ইয়োরোপিয়ানদের মত সাদা, চোখ নীল এবং চুল কটা। জন্ম থেকেই। এ নিয়ে তার বাবা-মা, ভাই-বোনের গর্বের সীমা ছিল না। একই সাথে তাকে নিয়ে সবার যন্ত্রনারও সীমা ছিল না। সারাক্ষণ তাকে আগলে রাখতে হয়েছে। ছেলে-পুরুষদের নজর থেকে বাঁচিয়ে রাখতে হয়েছে।

গায়ের রঙ ও রূপ এক সমস্যা হয়ে দেখা দেয় শিরিনের জীবনে। বড় হয়ে উঠতে উঠতে সে আবিস্কার করে যে দেশের প্রায় সব পুরুষই তাকে পছন্দ করে তার গায়ের রঙের জন্য। বন্ধুত্ব চায়, কাছে পেতে চায়, অনেকে বিয়েও করতে চায়।

শিরিনের এই রূপের কারণে তার বাবা-মা তাকে বেশিদিন অবিবাহিত রাখতে পারেননি। তার বিয়ে হয়ে যায়। তবে তার স্বামীর ও স্বামীর বাড়ির মানুষের দুর্ব্যবহারের কারণে তাকে সে বাড়ি থেকে চলে আসতে হয় এক বছরের মাথায়ই। ততদিনে সে মেয়ের মা হয়েছে। মেয়েকে নিয়েই চলে আসে।

বাবা-মার কাছে থেকেই পড়াশোনা করে; চাকরি পায়; চাকরি করে।

তবে পুরুষদের জ্বালাতন চলতেই থাকে। পুরুষদের যা হয়। তাদের মস্তিষ্কে সারাক্ষণ যৌন-চিন্তার আনাগোনা। যারা শিরিনকে কাছে চায় তারা যে যৌনাক্রান্ত হয়েই কাছে চাইছে তা সে বোঝে। এমনিতেই বিয়ে-বিচ্ছেদ হয়েছে এবং সে এখন একা। স্বামীহীন। স্বামী থাকলে অন্যান্য পুরুষের কাছ থেকে কিছুটা হলেও নিরাপত্তা পাওয়া যায়। এ সমাজ এমনই।

কিন্তু শিরিন সংসার করার স্বপ্ন দেখে। স্বামী-সন্তান নিয়ে ঘরের স্বপ্ন।

তার আপিসের কয়েকজন সহকর্মী তাকে প্রেম নিবেদন করে চলেছে অনেকদিন ধরে। সে সাড়া দেয় না; এড়িয়ে চলে নানা ভাবে। সে বিয়ে আর করবে না।

তবে তার এক বন্ধুর বিয়ে তার চিন্তা-ভাবনায় কিছু পরিবর্তন আনে। তার বন্ধু ভালবেসে বিয়ে করে একটি মেয়েকে যার আগেও একবার বিয়ে হয়েছিল। মেয়েটির একটি মেয়ে আছে। সবকিছু জেনে-বুঝেই তার বন্ধু মেয়েটির সঙ্গে সংসার শুরু করে। শিরিনের মতই পরিস্থিতি।

সে তার বন্ধুকে দেখে সমাজের বিরুদ্ধে লড়াই করতে; লড়াই ক’রে ভালবাসার মানুষটিকে সবার কাছে গ্রহণযোগ্য করে তোলে। তার সন্তানকেও। গ্রহণযোগ্য না হওয়া পর্যন্ত শিরিনের বন্ধু একচুলও নড়ে না।

শিরিনের মনে হয়, তার বন্ধু যদি এমন ক’রে একটি মেয়ের পাশে দাঁড়াতে পারে, তার জন্যেও এমন পুরুষ নিশ্চয়ই আছে। তার সহকর্মী আলতাফ রহমান (আসল নাম নয়) অনেকদিন ধরেই শিরিনিকে প্রেমের সম্পর্ক গড়ার কথা বলে আসছিল। আলতাফ তাকে বাড়ি পৌঁছে দিতে চায়, তার মেয়েকে এটা-ওটা কিনে দিতে চায়, মেয়েকে পেলেই আদর করে।

এসব দেখে শিরিনের মন কিছুটা গলে। আলতাফ তাকে বিয়েও করতে চায় বলে জানায়। শিরিন তার বাবা-মা-ভাইদের বলে। তারা রাজি হয় না। শিরিন তাদের চাপ দেয়। তারা আলতাফের সাথে কথা বলেন। তারা জানতে চান আলতাফ যা করতে চাইছে তা ভেবেচিন্তে করতে চাইছে কিনা, বুঝে করছে কিনা। শিরিনের মেয়েটিকে সে নিজের করে নেয়ার চেষ্টা করবে কিনা- এমন আরও অনেক কথা হয়। আলতাফ সবাইকে বোঝাতে পারে যে সে শিরিনকে ভালবাসে এবং শিরিনের জন্যে যা ভাল সে তাই-ই করতে চাইছে।

বাবা-মা-ভাই অবশেষে শিরিনের কারণেই রাজী হন। আলতাফের তর সয় না। সে তাড়াহুড়ো করে।

বিয়ে হয়। চুপচাপ একটি বিয়ে। একদিন বিকেলে।  কোন অনুষ্ঠান ছাড়াই কাজী ডেকে বিয়ে পড়ানো হয়।

শিরিন তার মেয়ে সাথীকে নিয়ে আলতাফের বাড়ি চলে যায়- সংসার করার স্বপ্ন বুকে নিয়ে। গিয়েই বুঝতে পারে সে এক অশুভ পরিবেশের মধ্যে এসে ভিড়েছে। তার অবস্থান হয় হেঁসেলঘরে। সকালে আপিসে যাওয়ার আগে রান্না, ফিরে এসে রান্না। আলতাফ তাকে চাকরি ছেড়ে দিতে বলে, কারণ তার মা’কে দেখাশোনা শিরিনকেই করতে হবে। শিরিন রাজি। কিন্তু আলতাফের মা তাকে সারাদিন তার আগের বিয়ে নিয়ে কথা শোনাতে থাকেন। শিরিন বোঝে যে এসব কথা তাকে কিছুদিন শুনতেই হবে। শাশুড়ি মা ক’দিন পর হয়তো এসব বলবেন না। সময় যায়। শাশুড়ি মা’র বিরতি নেই; তিনি বলতেই থাকেন এবং সাথীর সাথে দুর্ব্যবহার করা শুরু করেন।

আলতাফ এসব চুপচাপ শুনে যায়। শিরিন আশা করে তার স্বামী তার হয়ে কিছু কথা বলবে। স্বামী বলে না। স্বামী চুপ। তার পক্ষে দাঁড়ানো তো দূরের কথা, তাকে সান্তনা পর্যন্ত দেয় না।

আলতাফ সাফ বলে দেয় শিরিন চাকরি করতে পারবে না, কোন বন্ধুবান্ধবের সাথে যোগাযোগ রাখতে পারবে না, ফেইসবুকে কোন অ্যাকাউন্ট থাকতে পারবে না। আলতাফ শিরিনের মোবাইল ফোনেও নজরদারি শুরু করে। যেন তার বৌ অন্য কারও সাথে কথা বলছে।

শিরিন এসব মেনেও নিচ্ছিল। সংসার করার স্বপ্নে।

অন্তঃসত্বা হয় সে। তখন থেকেই চাপাচাপিতে চাকরি ছাড়তে হয়। বাবা-মা-ভাইরা মানা করেন কিন্তু ছাড়তে হয়।

পুত্রসন্তান চেয়েছিল আলতাফ। আশা পূরন হয় না। কন্যাসন্তান আসে। আলতাফের শিরিনের প্রতি যৌনাকাঙ্ক্ষা ধীরে ধীরে ম্রিয়মান হতে থাকে। শিরিনের প্রতি তার দুর্ব্যবহারের মাত্রাও বাড়তে থাকে। কেন এই দুর্ব্যবহার তা বোঝা যায় না। এক পর্যায়ে সে শিরিনের গায়ে হাত তোলে। প্রায়ই এমন হচ্ছে। সে গায়ে হাত তুলছে। শিরিনের বাবা জানতে পেরে সে বাড়িতে পুলিশ পাঠিয়ে তার মেয়েকে নিয়ে আসেন। কিছুদিন পর আলতাফ এসে ক্ষমা চেয়ে আবার শিরিনকে ফিরিয়ে নিয়ে যায়। কিন্তু শিরিনের সমস্যার সমাধান হয় না। আলতাফ এবার সাথীর সাথে দুর্ব্যবহার শুরু করে। সে শিরিনের কাছে পুত্রসন্তান দাবি করে। যেন শিরিন জানে কখন সে কন্যা প্রসব করবে এবং কখন পুত্র। আবারও সন্তান ধারণ করে শিরিন। এবারও কন্যাসন্তান। শিরিন এখন তিন কন্যার মা।

এর পর যখন আবার আলতাফ শিরিনের গায়ে হাত তোলে, তার ভাই আলতাফের কাছে জানতে চায় সে আসলে কী চায়। আলতাফ কিছু বলতে পারে না। শুধু বলে ‘আপনার বোন ভাল না’। এই ‘ভাল না’ বলতে কী সে বোঝায় তা শিরিনের ভাই বোঝে না। কী? শিরিনকে যা করতে বলা হচ্ছে, সে তাই-ই করছে। চাকরি ছেড়েছে, দাসীগিরি করছে, সবাইকে রান্না করে খাওয়াচ্ছে, দুইজন (কন্যা) সন্তানের জন্ম দিয়েছে, আলতাফের যৌন চাহিদাকে তৃপ্ত করছে। আর কী চাই আলতাফের? শিরিন অনেক চিন্তা করেও বুঝতে পারে না তার স্বামী তার সাথে কেন এমন ব্যবহার করে।

ইতিমধ্যে আলতাফ সাথীর পড়াশোনার বা অন্য কোন খরচপাতি দেবে না ব’লে দিয়েছে। সাথী বাবার দুর্ব্যবহার সহ্য করতে না পেরে বেশিরভাগ সময় তার নানিবাড়িতেই থাকে। নানা-নানি-মামারা তার খরচ চালিয়ে নেয়। অসুবিধে হয় না।

শিরিনের মা এক দুর্ঘটনায় মারা যান। বাবা জুবুথবু। প্রায় আশি বছর হয়েছে। শিরিনের শাশুড়ি মা উচ্চস্বরে সারাক্ষণ বলতে থাকেন যে “ঐ বুড়া (শিরিনের বাবা) মরে না ক্যান?”

মা গেছেন; এখন বাবা চলে গেলে শিরিনের আর কোথাও যাওয়ার জায়গা থাকবে না মনে ক’রেই তিনি এসব ‘দোয়া’ করেন এবং শিরিন ও তার মেয়েদেরকে শোনান। প্রায় দু’বছর পর শিরিনের বাবাও চলে যান। এবার তার স্বামী ও শাশুড়ি খুশি হন। শিরিনের বাবা-মা যে বাড়িতে থাকতেন তা ছিল ভাড়া-বাড়ি। শাশুড়ি ভাবলেন এবার শিরিনের ভাইরা বাড়িটি ছেড়ে দেবে এবং শিরিনের যাওয়ার জায়গা শেষ। কিন্তু তার ভাইরা বাড়িটি ছাড়ে না- শিরিন ও সাথীর কথা ভেবে বাড়িটি থাকে। তা দেখে শিরিনের স্বামী ও শ্বাশুড়ি গেল ক্ষেপে। পরিস্থিতি সহ্যের বাইরে চলে গেলে শিরিন ও’বাড়ি থেকে চলে এসে কিছুদিন নিঃশ্বাস নিয়ে তারপর আবার স্বামীর কাছে যায়। না গেলে সে নানা রকমের নাটক-থিয়েটার করে। মেয়েদেরকে ইমোশনাল ব্ল্যাকমেইল করে। মা খারাপ- এসব বোঝাতে থাকে।

মেয়েরা বড় হয়েছে। মায়ের সাথে বাবার দুর্ব্যবহার তারা পছন্দ করে না এবং বাবার কাছে তেমন একটা থাকতেও চায় না। বাবার প্রতি তাদের একটা অনীহা জন্মেছে। আলতাফ তা নিতে পারে না। সে অনেক ফন্দি-ফিকির করে তাদেরকে কাছে টানার জন্য কিন্তু কাজ হয় না। সে এবার কাউকে বাড়ির বাইরে যেতে দেবে না বলে নির্দেশ দেয়। সাথীর সাথে তার দুর্ব্যবহার চরমে পৌঁছায়।

অবশেষে একদিন সুযোগ পেয়ে শিরিন স্বামীর বাড়ি ছেড়ে চলে আসে।

শিরিনের গল্প এখানেই শেষ।

লেখকের কথা:

আমি নিজে একজন পুরুষ এবং পুরুষ-শাসিত সমাজে বেড়ে ওঠা একজন মানুষ। আমার কথায় পুরুষতন্ত্রের ছাপ থাকবেই পারে। সে কারণে ক্ষমা চেয়ে নিচ্ছি। করবেন আশা করি।

যে কথাটি বলতে চাইছি, তা হচ্ছে, শিরিনের মত পরিস্থিতিতে পড়েছেন এমন লক্ষ নারী আমাদের সমাজে আছেন। এবং এমন পরিস্থিতির শিকার এমন নারীর সাথে সংসার পাততে চান এমন পুরুষের সংখ্যাও সমাজে অনেক। তবে, পুরুষদের উদ্দেশ্যে বলি- যদি বুকের ছাতি অনেক বড় হয়, যদি সমাজের সাথে যুদ্ধ করে শিরিনের মত মেয়ের পাশে দাঁড়াতে পারেন, যদি আপনার মনোবল দৃঢ় হয়, যদি শুধু যৌনাবেদনকে প্রাধান্য না দিয়ে তাকে জীবনের অংশীদার হিসেবে ভালবাসতে পারেন, যদি তাকে সুন্দর জীবন উপহার দিতে পারেন- তবেই এমন পরিস্থিতিতে পড়া কোন নারীকে জীবনসঙ্গী করার কথা ভাববেন।

রূপ দেখে মুগ্ধ হওয়া দোষের নয়, সুন্দর যৌনজীবন কামনা করাও দোষের নয়। যৌনচাহিদা নারী-পুরুষ সবারই আছে। আমাদের এসব চাহিদা থাকাটাই স্বাভাবিক। কিন্তু তার অর্থ এই নয় যে রূপে মুগ্ধ হওয়ার সময়টিতে আমাদের অন্যান্য চিন্তাশক্তি লোপ পাবে। শিরিনের মত নারীর জীবনে অতীত ইতিহাস থাকে। হয়তো তা আপনার পছন্দ নাও হতে পারে, কিন্তু সেই বিষয়টিই আপনার ভাল করে জানা প্রয়োজন। তার অতীত গ্রহণ করতে পারলেই বোঝা যাবে আপনি পুরুষ হয়েছেন। গায়ের জোরে কেউ পুরুষ হয় না। বিয়ে করুন, কিন্তু শুধুই রূপের জন্যে নয়। এটি নিশ্চিত করুন যে আপনি তার অতীত সাথে নিয়ে পথ চলতে পারবেন। আপনার স্ত্রী আপনাকে কেন পছন্দ করবে বা ভালবাসবে? বা আপনি আপনার স্ত্রীকে কেন পছন্দ করবেন বা ভালবাসবেন? পছন্দ করার বা ভালবাসার কিছু কারণ তো একে-অপরকে দিতে হবে। তাহলেই তো সম্পর্কটি সম্পর্ক হবে! না হলে এক ছাদের নিচে দু’জন পুতুলের সংসার হবে অথবা ক’দিন পর একে অন্যের পথে চলে যাবে।

ভাবুন দেখি, আপনি আপনার স্ত্রীকে মারধোর করলেন। আবার সেই স্ত্রীর সাথেই আপনি সহবাস করতে চান। কেমন পুরুষ আপনি? আপনার গায়ে তার চেয়ে বেশি জোর ব’লে তাকে মারলেন। ধরুন, আপনার স্ত্রী আপনাকে একদিন মারধোর করলো। আপনি তার সাথে আর সহবাস করতে চাইবেন?

মনে হয় না।

সে কারণেই বলছিঃ বুকের ছাতি বড় করুন। পুরুষ হন। পুরুষ হতে অর্থ খরচ হয় না।

 

[ফেমিনিস্ট ফ্যাক্টরে প্রকাশিত কলাম লেখকের নিজস্ব  বক্তব্য ]