May 21, 2024
জীবনের গল্পফিচার ৩

পর্ব-১২: “এসএসসি’র নিবন্ধনের সময় মাইয়ারে নিজের বইলা স্বীকৃতি দিলো”

শাহাজাদী বেগম পেশাগত জীবনে একজন উন্নয়নকর্মী, ১৮ বছর ধরে প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর জীবনমান উন্নয়নে নিরলস কাজ করে যাচ্ছেন। উনি বাংলাদেশে যৌনকর্মী ও শিশুদের মানবাধিকার রক্ষা, এইচআইভি ও এইডসসহ অন্যান্য স্বাস্থ্যসেবা প্রদান, পাচারসহ বিভিন্ন ইস্যুতে গবেষনার কাজ করছেন। এই কাজগুলোর জন্য তাকে দেশের যৌনপল্লীগুলোতে অসংখ্যবার যেতে হয়েছে।  সেই অভিজ্ঞতাগুলোকেই গল্পে রূপান্তর করে লেখা  হয়েছে “গুহান্তরাল”, ফেমিনিস্ট ফ্যাক্টরে ধারাবাহিক আকারে প্রকাশ হচ্ছে। আজ পড়ুন এর দ্বাদশ পর্ব।।

ফুলতলা থেকে ফিরে সুরমা ব্যাগ গুছিয়ে রাখে। হোটেলের রিসিপশনে বলে বিল রেডি করে রাখতে, সকালে একবারে হোটেল থেকে চেক-আউট করে বের হবে, যাবে যশোরে, ব্রোথেলে কাজ, পার্টনার অফিসে মিটিং আর সিভিল সার্জন অফিসে যাওয়া। সারাদিনের কাজ শেষ করে সন্ধ্যার ফ্লাইটে ঢাকা ফিরবে। ইন্টারকমে স্টেফি জানতে চাইলো সকালে কখন বের হবে।  সকাল আটটায় নাস্তা সেরেই বের হবে শুনে সে বললো ডিনারের পরে নিজেরা একটু আলোচনা করে নেবে।

সুরমা স্টেফিকে একটা ছোট্ট ব্রিফিং দিয়ে দিলো যশোর ব্রোথেল নিয়ে।

“যশোর জেলা স্থলবন্দর হিসাবে বিখ্যাত। দেশের বিভিন্ন জেলা থেকে এবং পাশের দেশ ভারত থেকে অনেক লোকজনের যাতায়াত এখানে। তার উপর ভারতের সাথে বিশাল বর্ডার থাকার কারনে যশোর ও সংলগ্ন জেলাগুলো মানব পাচারের রুট/পথ হিসাবে বহুল ব্যবহৃত। শহরের হাটখোলা বাণিজ্যিক এলাকা হিসাবে এখানকার প্রাণকেন্দ্র। আর এই হাটখোলাতেই একসময় মারোয়াড়ি মন্দির, বাবুবাজার এবং ঝালাইপট্টি নামে তিনটি যৌনপল্লী গড়ে উঠেছিল। অনুমান করা হয়ে থাকে যে বৃটিশ সময়ে গড়ে ওঠা এই যৌনপল্লীগুলিই বাংলাদেশের সবচেয়ে পুরাতন যৌনপল্লী। পুরোনো অনেক বইপত্রে এই পল্লীগুলোর রেফারেন্স পাওয়া যায়, অনেক ধরনের মিথ, গল্প ও পুস্তিকায় উল্লেখ আছে। বাবুবাজার যৌনপল্লীটি বন্ধ হয়ে গেছে অনেক আগেই। এখন মারোয়াড়ি মন্দির ও ঝালাইপট্টি একসাথে হয়ে একটি পল্লীতে পরিনত হয়েছে এবং একটি যৌনকর্মী সংগঠনই এটা নিয়ন্ত্রণ করে। প্রায় ২.৫ বিঘা এলাকা জুড়ে এই পল্লীটির জমির আনুমানিক মূল্য ৯ কোটি টাকা। জমিটি বিভিন্ন ব্যাক্তিমালিকানাধীন। মোট ২৫০জন যৌনকর্মী আছে, স্বাধীন, ছুকরীও বাবুর অধীনে থেকেই মেয়েরা ব্যাবসা করে। ১৫০ জনের জাতীয় পরিচয়পত্র আছে, তারা জাতীয় নির্বাচনে ভোট দিতে পারে। এখানে ভারত থেকে আসা কিছু যৌনকর্মী আছে এবং কয়েকজন আছে যারা বাংলাদেশি কিন্তু পাচার হয়ে একসময় ভারতের ব্রোথেলে ছিল। গবেষনায় বলে যশোর ব্রোথেলে যৌনকর্মীরা দেশের বিভিন্ন স্থান থেকে ইন্টারনাল মাইগ্রেশনের মাধ্যমে  এসেছে। যেমন-

খুলনা থেকে সরাসরি যশোরে

রংপুর থেকে লালমনির হাট (ভায়া) হয়ে যশোরে

নড়াইল থেকে ঢাকা (ভায়া) হয়ে যশোরে

ঝিনেদাহ থেকে ঢাকা (ভায়া) হয়ে যশোরে

ফরিদপুর থেকে সরাসরি যশোরে

পাবনা থেকে রাজশাহী (ভায়া) হয়ে যশোরে

বরিশাল থেকে সরাসরি যশোরে

এই যৌনপল্লীটি যৌনকর্মীনেত্রী, স্থানীয় পুলিশ প্রশাসন এবং এলাকার ক্ষমতাবান লোকজন মিলে চালায়। এখানকার যৌনকর্মীদের সংগঠনটি অনেক শক্তিশালী। তারা পুলিশ ও এলাকার লোকজনদেরকে মাসোহারা দিয়ে নিজেরাই মূল নিয়ন্ত্রন হাতে রেখেছে। তবে অদ্ভুত বিষয় হল যে যত বড় নেত্রীই হোক, বাবুর সাথে যারা থাকে তাদের সিদ্ধান্ত বাবুরাই দেয়। এইখানে একজন  মেয়ে একবার কাজে ২৩০-২৫০ টাকা পায়। একজন ছুকরী পায় ২৩০ টাকা, যার মধ্যে ২১০ টাকা সর্দার্নী রেখে দেয় আর মেয়েটা পায় ২০ টাকা। ছুকরীরা চেষ্টা করে কাস্টমারদের খুশি করে কিছু বকশিস পেতে যেটা অন্য কাউকে দিতে হয় না। মোট ৩২ জন সন্তানদের মধ্যে ২০ জন মায়ের সাথে থাকে।”

সুরমা থামে।  টুকটাক কথা কথা শেষে যে যার রুমে ফিরে যায়।

পরদিন সকালে সুরমারা আগে সহযোগী সংস্থার অফিসে গেল। সেখানকার প্রথমিক আলোচনা শেষে স্টেফি নির্বাহী পরিচালকের সাথে আলাদাভাবে কথা বলে। একজন ডিরেকটর ও প্রজেক্ট কোর্ডিনেটরসহ পুরো টিম সিভিল সার্জনের অফিসে যায়। মিটিং শেষ করে যশোর ব্রোথেলে পৌঁছতে ১২টা বেজে যায়। পূর্ব পরিকল্পনা অনুসারে দলীয় আলোচনায় ঢুকতে যাবে স্টেফি আর রুবেল, তখন যৌনকর্মীদের সংগঠনের সভানেত্রী রোজী এসে ঢোকে। সালাম দিয়ে হাসিমুখে বলে, “আপা আজ দুপুরে আমি আপনাদের খাওয়াবো।” সুরমা কিছু বলার আগেই প্রজেক্ট কোর্ডিনেটর বলে, “খাবারের ব্যবস্থা আমরা করবো, আপনি  মেয়েদের দিকটা দেখেন।” রোজী আবারও বলে, “আমার খুশির খবর আছে ভাইয়া, আজ আমি খাওয়াবো। আপারা ঢাকা থেকে আসছেন, আজ আমার অনেক খুশির দিন।”

সুরমা এবার মুখ খোলে, “কিসের খুশির খবর রোজী আপা?”

– আপা, আমার মেয়ে ঢাকায় বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হইছে

– বলেন কি এতো সত্যি খুবই খুশির খবর। আজ আপনি আমাদের সাথে খাবেন। কোন্ বিষয়ে? ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে?

– না, আপা। নামকরা বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে, সাংবাদিকতা বিষয়ে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ইতিহাস বিষয়ে হইছিলো। কিন্তু মেয়ের বাবা সাংবাদিক তো তাই সেও বাবার বিষয়ে পড়বে।

“মেয়ের বাবা সাংবাদিক?” স্টেফি আগ্রহী হয়ে প্রশ্ন করে। রুবেল বাংলায় বলে।

“জি , উনি প্রেস ক্লাবের ……” রোজীর বিনীত উত্তর।

“আপনার স্বামী?” সুরমা জিজ্ঞেস করে।

– বিয়ে হয়নি আপা, কিন্তু স্বামীর মত, ভালোবাসার মানুষ। প্রায় বিশ বছরের সম্পর্ক।

সুরমা আর স্টেফি একটু অবাক হয়। সুরমা আবার বলে, “আপা যদি আপনার আপত্তি না থাকে তাহলে কি একটু খুলে বলবেন?”

রোজী সলজ্জ হেসে বলে, “আপত্তি থাকবে কেন? এইটা সকলেই জানে- এই পল্লীতে, এই শহরে। এইটা তো আমার গর্বের বিষয়। মেয়ের বাবা আমার বান্ধা কাস্টমার আছিল। আস্তে আস্তে ভাব-ভালোবাসা হয়। তার পরিবার আছে শহরে। তখন সে নিয়ম কইরা আসতো। আমার গর্ভে তার সন্তান- আমাগো মাইয়া। সে সবই জানতো, পোয়াতি হওয়া থাইকা শুরু কইরা মাইয়ারে জন্মদেওয়া সব কিছুর খোঁজ খবর রাখতো। আস্তে আস্তে মাইয়া বড় হয়, তারও মায়া বাড়ে। এদিকে পল্লীতে মাইয়া ভালো রাখাও দায়। এর মইধ্যে এনজিওরা যৌনকর্মী ও তাদের সন্তানদের অধিকার নিয়া বিভিন্ন সচেতনতামূলক কাজকর্ম করে। উনি সেগুলোতে যোগ দেয়, পত্রিকায় লেখালেখি করে। মেয়ের জন্যে তার অনেক চিন্তা। পরে বলে শহরে একট বাসা ভাড়া নিয়া মানুষ রাইখা মাইয়ারে পড়ালেখা করাইতে। আমিও সেই ব্যবস্থাই করি। দেখাশোনা করি, আবার চলে আসি। খরচাপাতি সবই ওনার। এসএসসি’র নিবন্ধনের সময় নিজের নাম দিয়া সবাইরে জানাইয়া মাইয়ারে নিজের বইলা স্বীকৃতি দিলো।”

– আপনারা বিয়ে করেননি? আপনিও শহরে মেয়ের কাছে থাকেন না কেন?

– আপা, শহরে ওনার পরিবার আছে, সমাজে মানসন্মান আছে। আমি একজীবনে কত ব্যাডাগো লগে শুইছি। এখন সর্দার্নী হইছি। উনি এখনও স্বামীর মত দেখে। নির্দিষ্ট দিনে আসে। আমি এতেই অনেক খুশী। আমি পল্লীর বাইরে গিয়া থাকতে পারবো না আপা। সবচেয়ে বড় বিষয় হইলো উনি মাইয়ারে স্বীকৃতি দিছে, মাইয়ারে সাথে নিয়া সবখানে যায়। এইটাই আমার সবচেয়ে বড় পাওয়া।

– আপনার নিজের স্বীকৃতির কি হবে?

– আমিতো স্বীকৃতি চাইনি। আমি কেন চাইবো?  আমি যৌনকর্মীর জীবনেই অভ্যস্ত আপা। বাপে মাইয়ারে নিছে, আমার আর কিছু চাওয়ার নাই। মাইয়ার জীবনটা তো বদলাইছে। আমার কাছে থাকলে হয়তো আমার মতই হইতো। একসাথে সব চাইলে হবে না। একটু একটু করে বদলাচ্ছে, একজনরে দেখে হয়তো আরো অনেকে এগিয়ে আসবে সন্তানের দায়িত্ব নিতে। আজ মেয়েকে স্বীকার করছে, কোন একদিন হয়তো যৌনকর্মীকে বিয়া কইরা ঘরে তোলবে। কিন্তু বিয়াই যদি সমাধান হইতো তাইলে বিয়ার পরে জামাই তার বউরে এইখানে নিয়া বিক্রি করতো না। ঐ বিষয়গুলা আমি বুঝি না। আমি এনজিওদের কাছে কৃতজ্ঞ। তবে আমি বলবো, আপনাদের আরো কাজগুলো চালিয়া যাওয়া দরকার।

– কোন কাজগুলো চালিয়ে যাওয়া দরকার মনে করেন আপনি?

– আপা, শহরে ২টা এনজিও’র শেল্টারহোম আছে। সেইখানে যৌনকর্মীদের ছেলেমেয়েদের এসএসসি পর্যন্ত রাখে। এদের একটা কাজের ব্যবস্থা করা আর পড়া চালানোর কাজ বন্ধ করা যাবে না। একটা একটা ছেলেমেয়ে ধইরা ধইরা যদি প্রজেক্ট বানানো যাইতো! কিন্তু সেগুলার অনেক খরচ। প্রজেক্ট না থাকলে তারাও পারে না। তারপর সচেতনতা, স্বাস্থ্য, এইচ আই ভি এইডস এইসব কাজ। ধরেন এইডস এর কাজ ২ বছর বন্ধ, কনডম নেওয়া কইমা গেছে। এখন আমরা যারা বুঝি আমরাও বাধ্য করি না। সাপ্লাই আমাগো কাছেও থাকে। তয় কাস্টমাররা নিতে চায় না। কী করলে নিবে, না থাকলে নিজেরা কিইনা নিবে সেই বুদ্ধিগুলো দরকার। এখন অনেক মেয়ে ব্যাংকে টাকা জমায় সেইডা ভালো। এমন কোন নিয়ম করা যাতে সমাজের আর দশজন নারী যে সন্মান ও সুবিধা পায় আমরাও যেন সেটা পাই। সমাজের আর দশজন ছেলেমেয়েরা যে সম্মান ও সুযোগ সুবিধা পায়, আমাদের ছেলেমেয়েরাও যেন সেই একই সম্মান ও সুযোগ সুবিধা পাইতে পারে। এই নিয়মটা চালু করতে পারলে আর বিদেশি প্রজেক্টের জন্য বসে থাকতে হবে না।

“এই যে নতুন নতুন মেয়েরা যে ব্রোথেলে বিক্রি হচ্ছে তার জন্য কী করা উচিত?” সুরমার প্রশ্ন।

– আপা আমিই তো ছুকরী কিনি। এইটাই এত বছর ধইরা দেইখা আসছি, আমাগো কাছে এইডাই স্বাভাবিক। ছুকরী খাটাইয়া বেশি টাকা পাওয়া যায়। কিন্তু কেন মাইয়াগো বেচতে আনে? এইখানে মাইয়াগো যেন বেচতে না আনে আপনেরা সেইখানে কাজ করেন মানে মাইয়াগো বাড়িতে, এলাকায় কাজ করন দরকার।

“আপনারা মেয়ে না কিনলেই তো পারেন”, সুরমার সরাসরি বলে।

– আপা, এইটা আমাগো ব্যবসার অংশ। ছুকরী না হয় কিনলাম না। কিন্তু তাইলেই তো আর যৌনব্যবসা বন্ধ হইবো না। ১৮ বছরের যে কেউ নিজের ইচ্ছায় আসতে পারে। ঐ ১৮ বছরের কারণ দেখাইয়া অল্প বয়সীদের ১৮ বছর বানানো হবে। কিন্তু কেউই তো নিজের ইচ্ছায় আসে নাই এখানে। সকলেরই কোন না কোন কারণ আছে। আপনেরা সেই কারণগুলো নিয়া কাজ করেন। আর পল্লীর পোলা মাইয়াগো লেখাপড়া শিখানোর কাজ করেন।

– কজন যৌনকর্মী কি চায় যে তার মেয়ে যৌনকর্মী হোক?

“আমি একজন যৌনকর্মী কিন্তু আমি চাইনা আমার মাইয়া যৌনকর্মী হোক”, রোজীর দৃঢ় গলায় উত্তর।

[চলবে]

পড়ুন দ্বিতীয় পর্ব- পর্ব-২: খানকিগো আবার দাফন কীসের?

পর্ব-৩: টাঙ্গাইলের পুণ্যভূমিতে পাপীষ্ঠাদের আর জায়গা হবে না

পর্ব-৪: ‘ভালো হইতে চাইছিলাম, দিলেন কই?’

পর্ব-৫: ‘আমরা তো খারাপ কাজ করি, তাই দোয়া চাই আল্লাহর কাছে’

পর্ব-৬: ‘পিন্দনের কাপড় খুইলা টাকা কামাই, পিন্দনেরই কাপড় কেনার লাইগা’

পর্ব-৭: ‘সমাজে যেমুন ব্যাডারা বউরে পিডায়, আমাগোও বাবুরা মারে’

পর্ব-৮: ‘সারাদিন ভালবাসলো, সন্ধ্যায় যৌনপল্লীতে নিয়া বেইচা দিয়া গেল’

পর্ব-৯: ‘‘এই যৌনপল্লীর মাইয়াগো উন্নতি করতে চাই”

পর্ব-১০: “একজন খদ্দের না পাইলে ভাত পাবো কোম্মে”

পর্ব-১১: ‘আমি ভালোবাসি মাইয়াগো, ব্যাডাগো সাথে শুইলে আমার গা গোলায়!’

পর্ব-১২: “এসএসসি’র নিবন্ধনের সময় মাইয়ারে নিজের বইলা স্বীকৃতি দিলো”

পর্ব-১৩: “যৌনপল্লী না থাকলে সমাজে কোন পরকীয়া, সুইসাইড থাকবে না”

পর্ব-১৪: টিকে থাকাই জীবন, বেঁচে থাকাই জীবন

পর্ব-১৫: যুদ্ধ, দুর্ভিক্ষ, বঙ্গবন্ধুরে মারল; এইসবের মইধ্যেও ওগো মাইয়া মাইনষের শরিল লাগে

শেষ পর্ব: আমার আকাশে পাখি হয়ে উড়বেন?