May 16, 2024
জীবনের গল্পফিচার ২

পর্ব-৩: টাঙ্গাইলের পুণ্যভূমিতে পাপীষ্ঠাদের আর জায়গা হবে না

শাহাজাদী বেগম পেশাগত জীবনে একজন উন্নয়নকর্মী, ১৮ বছর ধরে প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর জীবনমান উন্নয়নে নিরলস কাজ করে যাচ্ছেন। উনি বাংলাদেশে যৌনকর্মী ও শিশুদের মানবাধিকার রক্ষা, এইচআইভি ও এইডসসহ অন্যান্য স্বাস্থ্যসেবা প্রদান, পাচারসহ বিভিন্ন ইস্যুতে গবেষনার কাজ করছেন। এই কাজগুলোর জন্য তাকে দেশের যৌনপল্লীগুলোতে অসংখ্যবার যেতে হয়েছে।  সেই অভিজ্ঞতাগুলোকেই গল্পে রূপান্তর করে লেখা  হয়েছে “গুহান্তরাল”। আজ থেকে ধারাবাহিক আকারে প্রকাশ হবে ফেমিনিস্ট ফ্যাক্টরে। আজ পড়ুন এর তৃতীয় পর্ব।।

 

– ঐ মা, কাস্টমার আইছে, বসবি না?

৭ বছরের ছেলে জীবনের ডাকে পাশ ফিরে তাকায় রঞ্জনা, দুয়ারের সামনে দাঁড়ানো কলিম মোল্লা। রঞ্জনা এক বদনা পানি দুয়ারের সামনে রেখে কলিম মোল্লাকে নিয়ে ভিতরে ঢোকে। দুয়ার আটকায় না, একটা ১০ টাকার নোট হাতে করে বেরিয়ে আসে। জীবনের হাতে টাকাটা দিয়ে বলে

– স্বপনের  দোকান থাইকা একটা হিরো বেলুনের প্যাকেট নিয়া আয়তো বাপ, যাবি আর আবি।

জীবন  টাকাটা হাতে নিয়েই দৌড়।

এনজিওদের সাথে কাজ করা রঞ্জনার সাথের মেয়েরা যাদের “পিয়ার এডুকেটর” বলে তারাই ঘরে ঘরে প্যাকেট দিয়ে যায় অল্প টাকা দামে, আবার ট্রেনিং দিয়ে শিখিয়েও যায় কেমন করে পরাতে হয়। ডেমন্সট্রেশন যখন শেখাত, রঞ্জনার খুব লজ্জা লাগত। সে বলতো, এইগুলান কি মাইনষের সামনে করন যায়, লজ্জা লাগে না!

প্রথম প্রথম এনজিওর আপা ভাইয়েরা হাসত তার কথা শুনে, ভাবত -যৌনকর্মীগো আবার লজ্জা কিসের! প্রত্যেকদিন কত অচেনা বেডাগো সামনে কাপড় খোলে! কিন্তু অহন তারা বোঝে। লজ্জা শরম তাগোর যেমন, আমাগোও তেমন।

কলিম মোল্লা রঞ্জনার বাধা খদ্দের, নিয়ম করে সপ্তাহে ২ দিন আসে। ছোটখাটো ব্যাবসায়ী মানুষ, আসে দিনের বেলায়। কলিম মোল্লা অনেকটা সময় থাকে, তার দুইবার চাই- তাই সে ডবল টাকা দেয়। কোনদিন এর নড়চড় হয়নি। মানুষটা ভালই, হিরোর দাম সব সময় সে-ই দেয়, আবার হাতে করে কিছু একটা নিয়েও আসে কখনো লাক্স সাবান, কখনো চুড়ি, পাউডার এইসব আর কি। অন্যরা যেমন কষ্ট দেয়, সে ততটা না বরং চলে যাওয়ার সময়  একটু সোহাগ করে যায়। এই সোহাগটুকুর জন্য রঞ্জনা অপেক্ষা করে থাকে। মাঝে মাঝে তার মন আনচান করে, ভাবে, এমুন একটা মাইনষের লগে ঘর করতে পারলে মন্দ হইতো না!

এক প্যাকেট হিরো কিনে ঘরে যাবার জন্য আরেকবার দৌড় দিতেই  সুরমার সাথে ধাক্কা লাগে জীবনের। সুরমা কোনভাবে শিশুটিকে ধরে ফেলে ঠিকই কিন্তু হাতের প্যাকেটটি ছিটকে পড়ে যায় মাটিতে। সাথে থাকা সহযোগি সংস্থার কোর্ডিনেটর রুনা প্যাকেটটি তুলে নেয়। সেদিকে তাকিয়ে সুরমা জিজ্ঞেস করে, এটা দিয়ে কি করবে?

– মায়রে দিমু, কাস্টমার আইছে।

জীবনের চটপট জবাব। সুরমার মনে হল তার গালে কেউ যেন কষে একটা থাপ্পড় দিলো। ছেলেটির হাত তখনো সে শক্ত করে ধরে আছে। ছেলেটি রুনার দিকে হাত বাড়িয়ে বলে, বেলুনের প্যাকেটডি দেন, মায় তাড়াতাড়ি যাইতে কইছে। আন্টি হাত ছাড়েন দেরী হইতাছে।

বলেই সুরমার দিকে তাকায়। ও জীবনের হাত ছেড়ে দেয়। জীবন আবারো ভোঁ দৌড়! ফর্সা টুকটুকে বছর সাতেকের একটা ছেলে অস্বাভাবিক ঢোলা বড় পকেটওয়ালা একটা  থ্রি কোয়ার্টার প্যান্ট পরা, গায়ে স্যান্ডো গেঞ্জি, সারা গায়ে ময়লা লাগানো।  সুরমার নিজেকে অবশ লাগে, তার পা চলতে চায় না। ৭ বছরের শিশু সন্তান মায়ের জন্য কনডম কিনে নিয়ে যাচ্ছে, এমনও হয়!

অবশ্যই হয়, তার চোখের সামনেই হল তো। ৭ বছরের শিশু  কত স্পষ্ট উচ্চারণ, কত দৃঢ় দায়িত্বজ্ঞান!

তার অস্থির লাগে, সারাজীবন শুনেছে শিশুরা ফেরেস্তা, স্বর্গের দূত! সেই শিশুকে এখানে কী করতে হচ্ছে!

সুরমা এসেছে মনিটরিং ভিজিটে, সে পল্লীর ভিতরে গিয়ে মেয়েদের সাথে কথা বলবে, দু’একজন খদ্দেরের সাথেও কথা বলবে স্বাস্থ্য সম্পর্কে তারা কিছু শিখেছে কি না, ভিতরে ছুকরিদের কী অবস্থা, সংগঠনের নেত্রীরা  খোঁজখবর নেয় কি না, সর্দার্নী আর বাবুদের অত্যাচার কিছুটা কমেছে কি না এইসব। কিন্তু সে আর সামনে এগোতে পারে না। সুরমা শিশুটি সম্পর্কে জানতে চায়। নেত্রী বলে, আমার ঘরের পরের সারির শেষ ঘরে থাকে রঞ্জনা, এইডা রঞ্জনার পোলা। রঞ্জনার বয়স কম, দ্যাখতে খুবই সোন্দর কিন্তু শুরুর দিকেই  প্যাড বাদাইয়া ফেলছিল, সেইডাই এই পোলা।

সুরমা ছেলেটিকে অফিস রুমে নিয়ে আসতে বলে ফিরে আসার জন্য পা বাড়ায়।

জীবনের হাত থেকে হিরো’র প্যাকেট নিয়েই ঘরের দুয়ার লাগায় রঞ্জনা। জীবন খেলতে চলে যায়। যৌনপল্লীর শিশুরা জন্ম থেকেই দেখে মায়েরা পুরুষের সাথে বসে। পুরুষরা আসে, মায়েদের, মাসিদের সাথে দরদাম হয়, তারপর ঘরে ঢুকে দরজা লাগায়। এর বিনিময়ে মায়েরা টাকা পায়। সেই টাকায় তারা খেয়ে পরে বাঁচে। কেউ কেউ দেশবাড়িতেও টাকা পাঠায় বাবা-মা, বাড়িতে রেখে আসা ছেলে মেয়ে অথবা আত্মীয়দের জন্য। শিশুরা এসব দেখেই বড় হয়। এটাই ওদের কাছে স্বাভাবিক জীবন, স্বাভাবিক উপার্জন।

টাঙ্গাইলের কান্দাপাড়া যৌনপল্লীর গেটের বাইরে তিন রুমের প্রকল্প অফিস সহযোগি সংস্থার। এক রুমে শিশুদের প্রি স্কুল ও ডে কেয়ার, এক রুমে প্রশিক্ষন ও যৌনকর্মী সংগঠনের মিটিং হয় আর অন্য রুমে পার্টিশান দিয়ে দুই ভাগ করা হয়েছে। এক ভাগে অফিসের কাজকর্ম আর অন্যভাগে স্যাটেলাইট ক্লিনিক, সপ্তাহে দুই দিন প্যারামেডিকসহ একজন ডাক্তার আসে। পিয়ার এডুকেটররা আগে থেকে খোঁজ নিয়ে রাখে যাদের ডাক্তার দেখানো দরকার। নির্দিষ্ট  দিনে কাজের ফাঁকে ফাঁকে ডেকে নিয়ে এসে ডাক্তারকে দেখিয়ে যায়।

সুরমা অফিসে ঢোকে, তখনো ওর অস্থির লাগছে। একটা চেয়ারে ধপ করে বসে পরে ঢকঢক করে পানি খায়। কিছুটা স্থিতু হয়ে খেয়াল করে ডাক্তার এসেছে, আজ ক্লিনিক ডে। নেত্রী কিছুক্ষণের মধ্যে জীবনের হাত ধরে টানতে টানতে এনে প্রি স্কুলের রুমে বসায়। সুরমা উঠে ছেলেটির কাছে গিয়ে বসে। আরো ৮ জন ছেলেমেয়ে আছে, তারা খাতায় রঙ করছে। ও জিজ্ঞেস করে

– তোমার নাম কী?

– জীবন। মায় কয় আমি তার জীবন

– তুমি এই স্কুলে এসেছ এর আগে?

– আসছি কয়বার

– প্রতিদিন আসো না কেন? দেখ এখানে কত কিছু খেলার আছে, পড়ার আছে…

– এখানে আসতে আমার ভাল লাগে না

জীবনের সোজা উত্তর।

– সে কি? কেন? সারাদিন তুমি  কি কর?

– আমি রুবেল ভাইয়ের সাথে সাথে ঘুরি

– রুবেল ভাই কে? তার সাথে ঘোরো কেন?

– রুবেল ভাই হইল ওই যে এইদিক দিয়ে এইরহম কইরা চুল কাটা যে, চুলে রঙ করা আছে। তার সাথে থাকলে আমারে একটা ২ টেকার নোট দেয়। আর মাঝে মইধ্যে মুড়ি খাওয়ায়।

হেসে হেসে উত্তর দেয়।

– দুই টাকা দিয়ে কী কর?

– সিঙ্গারা খাই, না হলে মায়রে দেই

হঠাৎ গাড়ি আর হুইসেলের শব্দে সকলে একসাথে দরজা দিয়ে বাইরে তাকায়।  জীবনে বলে ওঠে, পুলিশ আইছে, আন্টি আমি যাইগা।

বলেই এক দৌড়ে পাড়ার ভিতরে চলে যায়। সুরমা দেখল একটা পুলিসের গাড়ি থেকে অনেকগুলো পুলিশ নেমে দৌড়ে ভিতরে যাচ্ছে।

মনে হয় কোন মিশনে এসেছে। আজকাল প্রায়ই আসে। বেশিরভাগ সময় সুনির্দিষ্ট তথ্য পেয়েই আসে, রুনা সুরমাকে বলে।

ভিতরে যাই আপা- বলে নেত্রীও চলে গেল।

জীবন দৌড়ে একটি নির্দিষ্ট পেয়ারা গাছের নিচে এসে দাঁড়ায়। যথারীতি রুবেল এসে একটা ছোট প্যাকেট তার হাতে দিয়েই চলে যায়। জীবন প্যাকেটটা নিজে ঢোলা প্যান্টের পকেটে রেখে সামনে হাঁটতে থাকে। পুলিশগুলো তার সামনে দিয়েই দৌড়ে চলে যায়, কিছু টের পায় না। এই কাজ সে আরো এক বছর আগে থেকে করে, তার অভ্যাস হয়ে গেছে। ঘণ্টা খানেক এদিক ওদিক ঘোরাঘুরি করে। সে দেখে পুলিশ ডালিম ভাই আর রুম্মান ভাইরে ধরে নিয়ে গাড়িতে তোলে, পিছন পিছন নেত্রী নানীও চিৎকার করতে থাকে। রুবেল এসে জীবনের হাত থেকে প্যাকেটটি নিয়ে ২০ টাকার একটা নোট ওর হাতে গুঁজে দেয়। জীবন টাকাটা নিয়ে মায়ের কাছে দিয়ে আসে।

সুরমার মনের ভেতরটা খুঁতখুঁত করতে থাকে।

রুনা, পুলিশের গাড়ী দেখে জীবন ওভাবে দৌড়ে ভিতরে গেল কেন?

সে জানতে চায়।

ছেলেটা  খুবই চঞ্চল আপা, রুনার স্বাভাবিক উত্তর।

সুরমা এই সময় ক্লিনিকের ডাক্তারের সাথে কথা বলতে যায়।

ডাক্তার ইশরাত তখন একজন রোগির চেক আপ কেবল শেষ করেছেন। কথা প্রসঙ্গে তিনি জানালেন, কমন ভ্যাজাইনিটিস প্রায় সবারই আছে। কিছুক্ষন আগে একজন লোয়ার অ্যাবডোমিনাল পেইন নিয়ে এসেছিল। আর কয়েকজনের এসটিআই ঔষধ খেয়ে বেশ কিছুদিন ভালো ছিল। এখন আবার দেখা যাচ্ছে কিছু কিছু মেয়েদের ক্ষেত্রে। পার্টনারের ট্রিটমেন্ট করাটাও খুব জরুরি। এখন যে আপনার পাশে বসে আছে এই মহিলার ইলেক্ট্রো কটারী লাগবে। আমাদের তো এসব প্যাকেজে নাই। বেশির ভাগই সিনড্রোমিক এপ্রোচে ট্রিট্মেন্ট করে থাকি।

এই রোগীকে জেলা সদর হাসপাতালে রেফার করে দেন। ভালো হয় আপনার পরিচিত কেউ থাকলে প্রয়োজনে বলে রাখলেন। সুরমার পরামর্শ।

– প্রেগন্যান্সি এবং এবোর্শন এর সংখ্যা কেমন?

– এ মাসে ৪ জন এবর্শনের জন্য এসেছিল

– তার মানে এরা প্রতিটা কাজে কনডম ব্যবহার করছে না, এসটিআই ফিরছে, অ্যাবরশনের জন্য মেয়েরা আসছে।

– বার্থ কন্ট্রোল পিল খায়। তবে ডিপো ইঞ্জেকশনের প্রতি আগ্রহ বেশী , তাতে করে অন্তত তিন মাসের জন্য নিশ্চিন্ত থাকতে পারে।

– বার্থ কন্ট্রোল হবে কিন্তু এসটিআই কিংবা এইচাইভির সংক্রমণ ঠেকানো যাবে না।

– সেটা মানানো অনেক কঠিন

সুরমা রুনাকে ওদের রেজিস্ট্রেশন দেখে ফলো আপ করতে বলে বেরিয়ে আসে।

অফিস রুমে ঢুকেই দেখতে পায় জীবন ডে কেয়ারে বসে আছে। সুরমাকে দেখেই  বলে ওঠে, আন্টি আইসা পড়ছি।

– তখন পুলিশ দেখে ওভাবে কোথায় গিয়েছিলে?

– রুবেল ভাইয়ের কাছে।

– কেন?

– পুলিশ আসলেই আমি পেয়ারা গাছের নিচে গিয়া দাঁড়াই। আর রুবেল ভাই লুকায়া আইসা আমার প্যান্টের পকেটে একটা প্যাকেট ঢুকায়া দিয়া চইলা যায়। পুলিশ চইলা গেলে আবার নিয়া যায়। সেইজন্য রুবেল ভাই আমারে ২০ টাকা দেয়।

– এইজন্য তুমি তাকে এত পছন্দ কর?

-হ

জীবনের সোজা জবাব। সুরমা স্তব্ধ হয়ে বসে থাকে। সে জানে এখানে মাদকের ব্যবসা চলে। কিছু কিছু বাবু-বাড়ীওয়ালী-সর্দারনী নিজেরাই এই ব্যাবসার সাথে জড়িত। আন্ডারগ্রাউন্ডের অপরাধীরা মাঝেমধ্যেই এখানে গা ঢাকা দিতে আসে। অনেক চোরাকারবারীর ডিলিংস এখানেই হয়। কিন্তু এতটুকু একটা শিশু!

উহ! আর ভাবতে পারে না সে। চোখের সামনে তার ভাইয়ের সাত বছরের ছেলেটার মুখ ভেসে ওঠে। সুরমার বুকের মধ্যে মোচড় দেয়।

রঞ্জনা জীবনকে খুঁজতে খুঁজতে অফিসে এসে হাজির। সুরমাকে দেখে সালাম দেয়। বলে, পোলাডারে গোসল করাবো, তাই ডাকতে আসছি আপা।

– আপনি রঞ্জনা?

– জি, আপা

– সময় থাকলে বসেন, কথা বলি

– বলেন আপা, জীবন দুষ্টামী করছে?

– না না, আপনার ছেলেটা অনেক সুন্দর

– জি আপা, আমার জান

– ছেলেকে নিয়ে কী ভাবেন? এই স্কুলে আসে না কেন?

– পোলাডারে মানুষ করতে চাই। এইখানে আসতে চায় না।

– কীভাবে মানুষ করতে চান?

– জানিনা আপা

– আপনার বয়স কত?

– ২৩ বছর

– নিজেকে নিয়ে কী ভাবেন? আর কত বছর এই কাজ করবেন? সারা জীবন তো পারবেন না। তখন কী করবেন?

– আরো দুই তিন বছর করার ইচ্ছা আছে। এইখানে সমিতিতে টাকা জমা করি। আরো তিন বছর কাজ করলে ভাল টাকা জমবে। তখন যদি একটা ভালো মনের মানুষ পাই, তারে বিয়া কইরা সমাজে উইঠা যাবো। সেইজন্যই টাকা জমাইতেছি।

সুরমা আকাশ থেকে পড়ে, এই মহিলা বলে কী!  এমন মানুষ কি পাওয়া যাবে আর সমাজ কি মেনে নেবে?

– হ, আপা। রেওয়াজ আছে। ৬০ হাজার টাকা লাগবে। যে বিয়া করবে তারে দেওন লাগে, সমাজের মাতুব্বরগো দেওন লাগে আর সমাজের লোকজনরে খাওয়া দেওন লাগে। তাইলেই সমাজে ওঠা যায়, থাকন যায়। যতই যা কন, এই কামডাতো ভালা না। কেউ ভালা চোখে দেখে না গো আপা।

সুরমা অবাক হয়ে তাকিয়ে থাকে রঞ্জনার দিকে। তার দ ‘চোখ ভরা স্বপ্ন, সংসারী হওয়ার স্বপ্ন, সমাজে সম্মান নিয়ে বেঁচে থাকার স্বপ্ন!  ডিগনিটির জন্য হাহাকার বড় কঠিন জিনিস!

– এমন কাউকে দেখেছেন যে সমাজে উঠে গেছে আর সুখে শান্তিতে আছে?

সুরমা জানতে চায়

– অনেকেই যায় গো আপা। দুই মাস আগে ববিতা গেলো, ভালোই আছে শুনি।

রঞ্জনা ছেলেকে  সাথে নিয়ে পাড়ার ভিতরে চলে গেল।

সুরমা রুনাকে সাথে নিয়ে পাড়ার ভিতরে মেয়েদের সাথে কথা বলতে যায়। পিয়ার এডুকেটর আর নেত্রীদের সহযোগিতায় কিছু মেয়ের সাথে কথা বলে।  ভিতরে গিজগিজ করছে মেয়েরা, তাদের ছেলেমেয়ে, খদ্দের সব মিলে। মাঝে মাঝে ছোট ছোট দোকান, সামনে কয়েকজন করে জটলা, চা-পুরি, সিগারেট, পান, গাঁজা সবই চলছে। মেয়েরা যার যার ঘরের সমনে অথবা পাশে  দাঁড়িয়ে আছে খদ্দের ধরার আশায়। চারিদিকে চিৎকার, চেঁচামেচি, গালাগালি, হাসাহাসি। কিছুক্ষণ আগেই যে পুলিশ এসেছিল তার কোন চিহ্ন নেই।  এমন ঘটনায় তারা অভ্যস্ত।

২.১৩ একর জায়গা নিয়ে গড়ে ওঠা এই যৌনপল্লীতে প্রায় সাতশো ঘরে আটশো নারী  যৌনর্মীর বাস, আগে হাজার খানেক ছিল। এই নারীদের প্রায় অর্ধেকই এই দেশের ভোটার। এটিদুইশ বছরের পুরোনো দেশের দ্বিতীয় বৃহত্তম যৌনপল্লী। এই পল্লীতে দীর্ঘ সময় ধরে বিভিন্ন উন্নয়ন সংগঠন কাজ করার সুবাদে কিছু গুনগত পরিবর্তন হয়েছে। এখানে যৌনকর্মীদের একটি সংগঠন আছে। সংগঠনটি নিবন্ধনকৃত। তারা প্রত্যেক বছর এজিএম করে এবং ২ বছর পরপর নমিনেশন নিয়ে নির্বাচনের মাধ্যমে নির্বাহী কমিটি তৈরি হয়। এইসব নির্বাচনে সরকারি অধিদপ্তরের প্রতিনিধি, স্থানীয় গন্যমান্য ব্যাক্তি ও এনজিওদের প্রতিনিধিরা উপস্থিত থাকে। এখানকার নারীদের বেশি অংশই তাদের সন্তানকে গ্রামের বাড়িতে বা যৌনপল্লীর বাইরে রেখে পড়াশোনা করায়। বাইরে রেখে পড়াশোনা করার  এমন  সন্তানের সংখ্যা প্রায় দেড়শ (২০১৪ সালের তথ্য অনুসারে)। তারা কলেজ, হাইস্কুলে পড়ে। অল্প সংখ্যক ভোকেশনাল স্কুল ও মাদ্রাসায় পড়ে। তবুও প্রায় ১০০ শিশু পল্লীর ভিতরে মায়ের সাথেই থাকে। তাদের মধ্যে অনেকেই সরকারি প্রাইমারি স্কুলে যায় এবং এনজিওদের শেল্টার হোমেও থাকে অনেকে। একটি আন্তর্জাতিক সংস্থার  সহযোগিতায় পল্লীর পাশেই শেল্টারহোম তৈরি করা হরা হয়েছে আর্লি চাইল্ডহুড ডেভেলপমেন্ট প্রোগ্রামের আওতায়। তবে যৌনকর্মীর মেয়ে যৌনকর্মীই হয়েছে, এমন প্রায় ৭০ জন মেয়ে আছে এখানে।

উচ্ছেদ আতংক যৌনপল্লীর সবচেয়ে বড় থ্রেট। বিশেষ বিশেষ সময় এটি মাথাচাড়া দিয়ে ওঠে। যেমন রমজান মাস শুরুর আগে কিছু মানুষের পূন্য কামানোর ইচ্ছে হয়। তখন তারা জোট বেঁধে এদেরকে তাড়ানোর চেষ্টা করে। স্থানীয় বা জাতীয় নির্বাচনের আগে, নিজের ইমেজ তৈরি করার জন্য উচ্ছেদকে ইস্যু বানায়। তবে সবচেয়ে বড় যে কারনটি বের হয়ে এসেছে তা হল এই ২.১৩ একর জমিটির আনুমানিক স্থানীয় মুল্য ১৮ কোটি টাকা। কাজেই জমিটির প্রতি অনেকেরই নজর রয়েছে। সুরমা টাঙ্গাইল থেকে ফেরার কয়েকমাস পরে আবারো উচ্ছেদের হুমকিতে পড়ে ব্রোথেলটি। সংহতির মিটিংয়ে সিদ্ধান্ত হয় স্থানীয় পর্যায়ে নেত্রীরা প্রেস কনফারেন্স করবে, মানববন্ধন করবে, ঢাকায় কেন্দ্রীয় পর্যায়ের নেত্রীরা আইনজীবী ও অন্যান্য মানবাধিকার সঙ্গগঠনের প্রতিনিধিসহ একটি টিম টাঙ্গাইলের সংসদ সদস্যের সাথে দেখা করবে।

একটা হাই প্রোফাইল টিম গঠন করা হল, সুরমা যোগাযোগ, লজিস্টিক ও যাতায়াত সাপোর্টের দায়িত্ব নিল। সুরমার অফিসের একজন ডিরেকটর তানিয়া আপাসহ তারা দেখা করতে দেখা করতে গেল মাননীয় সংসদ সদস্যের বনানীর বাসভবনে।  ওনার অফিস রুমে বসল, উনি আগে থেকেই অফিসে এসে ছিলেন। অনেক আলোচনা হল। তপতী দিদি ব্যাখ্যা করলেন এই নারীদের বর্তমান অবস্থা, এর পিছনের কারন, কেন যৌনপল্লীটি রাখা দরকার এইসব। ব্যারিস্টার রাশিদা আপা আইনের জায়গাগুলো ব্যাখ্যা করলেন। সংসদ সদস্য সবকিছু শুনলেন মনোযোগ দিয়ে এবং আশ্বাস দিলেন সহযোগিতা করার।

ফেরার পথে সুরমার কাছে ফোন এলো টাঙ্গাইল থেকে, প্রেস কনফারেন্সের সময় এলাকার লোকজনরা হামলা করেছে। পুলিশ-যৌনকর্মী-এলাকার লোকজন ত্রিমুখী সংঘর্ষে  ৫ জন যৌনকর্মী, ২ জন এনজিও প্রতিনিধি, ২ জন আন্দোলনকারী ও একজন পুলিশ সদস্য গুরুতর আহত। তাদেরকে স্থানীয় হাসপাতালে ভর্তি করা হয়েছে।

পরিস্থিতি প্রচণ্ড উত্তপ্ত। এলাকাবাসী রাতের মধ্যেই ব্রোথেল উচ্ছেদ করে ফেলবে মাইকে ঘোষণা একদফা এক দাবির।  টাঙ্গাইলে ডিসি ও এসপিকে ঢাকা থেকে বিভিন্ন মহলের ফোন দেওয়ানোর ব্যবস্থা করানো হল- সেই সংসদ সদস্য, হিউম্যান রাইটস কমিশনের চেয়ারম্যান, নারী ও শিশু বিষয়ক মন্ত্রনালয় ইত্যাদি। ঢাকা থেকে জাতিসংঘসহ বিভিন্ন আন্তর্জাতিক ও জাতীয় সংস্থার প্রতিনিধিরা, মিডিয়ার লোকজনসহ কমিটি গঠন করে টাঙ্গাইল ভিজিট, মানববন্ধন, অ্যাডভোকেসি কার্যক্রম চালানো হল স্থানীয় ও জাতীয় পর্যায়ে, পক্ষেবিপক্ষে তুমুল ঝড় উঠলো। পুলিশি পাহারা জোরদার হল। তার ভিতরেই সেই রাতে ব্রোথেলে হামলা হল- মরলে শহীদ, বাঁচলে গাজী, এই পাপীষ্ঠাদের আর এখানে জায়গা হবে না, এই পাপাচার টাঙ্গাইলের এই পুণ্যভূমিতে চলতে দেওয়া যাবে না!

জানের ভয়ে রাতের অন্ধকারে অনেক যৌনকর্মী চলে গেল অন্য ব্রোথেলে, কেউ কেউ নতুন ফাঁদে পড়ে গেল-নিরাপত্তার আশায় অন্যকে বিশ্বাস করে পাচার হয়ে গেল ইন্ডিয়ায়, কেউ আবার দালালের খপ্পরে পড়ে রাস্তায় আশ্রয় নিলো।

আরো দুইজন মেয়ের সাথে জীবনকে নিয়ে রঞ্জনা রওনা দিলো দৌলতদিয়া ব্রোথেলের উদ্দেশ্যে, ফেলে গেলো কলিম মোল্লার স্মৃতি- বুকের ভিতরটায় কেমন এক চিনচিনে অনুভূতি মানুষটার জন্য, সপ্তাহে দুটো দিন তো তার কাছেই  আসত, হাতে করে নিয়ে আসত এক টুকরো মায়া, যাবার আগের এক চিলতে সোহাগ! ঘৃনিত যৌনর্মীর জীবনে এটাই ছিল আশীর্বাদ তার কাছে!  রঞ্জনা ওড়নায় চোখ মোছে।

স্বরাষ্ট্র মন্ত্রনালয়ের হস্তক্ষেপে তাণ্ডব থামলো বটে কিন্তু এর একটা সুরাহা হওয়া দরকার। দু’দিন পরপরই একই ইস্যু আবার হবে। টাঙ্গাইল ব্রোথেলের মেয়েদের পক্ষে হাইকোর্টে রিট দেশের নামকরা আইনজীবীরা লড়লেন। সেই সাথে সামাজিক প্রচারণা, মিটিং মিছিল, লবিং, মানববন্ধন। দীর্ঘ আইনী লড়াইয়ের পর হাইকোর্ট ব্রোথেল রাখার পক্ষে যুগান্তকারী রায় দিলেন।

(বিঃ দ্রঃ টাঙ্গাইল ব্রোথেলের মেয়েদের পক্ষে হাইকোর্টে রিট করেছিল বাংলাদেশ মহিলা আইনজীবী সমিতি নামে মহিলা আইনজীবীদের সংগঠন এবং রায়ে জিতেছিল। জাতীয় ও আন্তর্জাতিক পরিসরে এটি খুবই গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা। এর পরে ব্রোথেলটি প্রাচীর দিয়ে ঘিরে ফেলা হয়)

(চলবে…)

পড়ুন দ্বিতীয় পর্ব- পর্ব-২: খানকিগো আবার দাফন কীসের?

পর্ব-৩: টাঙ্গাইলের পুণ্যভূমিতে পাপীষ্ঠাদের আর জায়গা হবে না

পর্ব-৪: ‘ভালো হইতে চাইছিলাম, দিলেন কই?’

পর্ব-৫: ‘আমরা তো খারাপ কাজ করি, তাই দোয়া চাই আল্লাহর কাছে’

পর্ব-৬: ‘পিন্দনের কাপড় খুইলা টাকা কামাই, পিন্দনেরই কাপড় কেনার লাইগা’

পর্ব-৭: ‘সমাজে যেমুন ব্যাডারা বউরে পিডায়, আমাগোও বাবুরা মারে’

পর্ব-৮: ‘সারাদিন ভালবাসলো, সন্ধ্যায় যৌনপল্লীতে নিয়া বেইচা দিয়া গেল’

পর্ব-৯: ‘‘এই যৌনপল্লীর মাইয়াগো উন্নতি করতে চাই”

পর্ব-১০: “একজন খদ্দের না পাইলে ভাত পাবো কোম্মে”

পর্ব-১১: ‘আমি ভালোবাসি মাইয়াগো, ব্যাডাগো সাথে শুইলে আমার গা গোলায়!’

পর্ব-১২: “এসএসসি’র নিবন্ধনের সময় মাইয়ারে নিজের বইলা স্বীকৃতি দিলো”

পর্ব-১৩: “যৌনপল্লী না থাকলে সমাজে কোন পরকীয়া, সুইসাইড থাকবে না”

পর্ব-১৪: টিকে থাকাই জীবন, বেঁচে থাকাই জীবন

পর্ব-১৫: যুদ্ধ, দুর্ভিক্ষ, বঙ্গবন্ধুরে মারল; এইসবের মইধ্যেও ওগো মাইয়া মাইনষের শরিল লাগে

শেষ পর্ব: আমার আকাশে পাখি হয়ে উড়বেন?