November 1, 2024
কলামফিচার ২

সূর্যমুখী বাগানে সাকিব কন্যা, আমাদের ঈর্ষা ও সামাজিক ‘ভাষা’ শিক্ষা

সেঁজুতি জাহান জিনাত।। আপনার বৃষ্টি ভেজা নারকেল গাছ ভাল্লাগে না।  সেজন্য আপনি নারকেলই খান না।  নারকেল যারা খায় তাদেরকেও আপনি পছন্দ করেন না।  এমনকি নারকেল তেলও চুলে দেন না, অলিভ ওয়েল মাখেন। যারা নারকেল খায়, ব্যবহার করে তাদের চৌদ্দ পুরুষ উদ্ধার করেন। পারলে মেরেও ফেলতে চান।

কারণ কী?

কারণ, আপনি বৃষ্টি ভেজা নারকেল গাছ দেখে ঘৃণায় ডুবে আছেন।

কী অবাক হচ্ছেন?

আজকাল শিক্ষিত সম্প্রদায়ের অনেক অংশেই এই অসুস্থতা বিরাজ করছে। ব্যাপারটা অনেকটা এরকম- আমি অপরের অসুস্থতা টের পাচ্ছি, নিজেরটা না।  কারণ, আমি আসলে নিজেকে সব অর্থেই শ্রেষ্ঠ সাব্যস্ত করে আছি।

এবার আসা যাক, ফেসবুকে ভাইরাল হওয়া বাংলাদেশের ক্রিকেটার সাকিব আল হাসানের কন্যা শিশুর সূর্যমুখী বাগানে তোলা একটি চমৎকার ছবিতে কতিপয় লোকের অশ্লীল মন্তব্য নিয়ে বয়ে যাওয়া ঝড় প্রসঙ্গে।

শিশুটির প্রতি যে অশ্লীল বাক্য ব্যয় করা হয়েছে বাংলাদেশসহ যেকোনো উন্নয়নশীল অধিকাংশ দেশেরই চেহারা এই। খাদ্য, বস্ত্র, বাসস্থান, শিক্ষা, চিকিৎসা সমানভাবে বন্টন না হলে এমন গণ ‘দরকাঁচা’ দশা হবারই কথা সমাজের। ধরেন খাদ্য,  বস্ত্র, বাসস্থান এবং চিকিৎসার সুবন্দোবস্তের ভেতরে বসবাসকারী কারো শিক্ষার দরকার না হলেও চলে এসব দেশে। সামাজিক ‘ভাষা’ আয়ত্ত করবার জন্য ন্যূনতম শিক্ষা তার না থাকলেও চলে, সে যেহেতু অন্য ব্যাপারগুলোতে প্রতিষ্ঠিত ফলে উল্টো সামাজিক ‘ভাষা’কে সে উচিৎ শিক্ষা তো দেবেই।

আচ্ছা শিক্ষা মানে কিন্তু কেবল সার্টিফিকেটকে বোঝাইনি। অনেক থার্ডক্লাস পাওয়া কিংবা সার্টিফিকেটহীন সামাজিক মানুষও কিন্তু মানুষের সঙ্গে তার ‘ভাষা’র যোগাযোগে যথাযথ  শিক্ষিতের প্রমাণ দিয়ে থাকেন।

অমুকের বিত্ত, অমুকের ফ্রেস চিত্ত, অমুকের যাপিত জীবন আমার চেয়ে যদি বেটার হয় তো আমি শুরু করে দিই অমুককে সামাজিকভাবে দাবানো। আর এর জন্য একমাত্র অস্ত্র হলো অশ্লীল বাক্য প্রয়োগ। কিছুতেই আমার থেকে কোনো দিক থেকে কেউ উন্নতি করতে পারে না- এই জাতীয় অসুস্থতার মধ্যে জাতি ডুবে আছে।

শিক্ষা মানুষের ভেতরে অপরকে পড়বার ভাষা তৈয়ার করে দেয়, তা দেওয়ায় যদি ব্যর্থ হয় তো তার শিক্ষাজীবন ব্যর্থ। আর সব ধরনের সামাজিক অবক্ষয়টা শুরু হয় ঠিক এখান থেকেই।

আপনি যদি সমাজে আপনার থেকে কোনো দিক থেকে বেটার পজিশনে থাকা কাউকে সহ্যই করতে না পারেন, তো আপনার শিক্ষা কী কাজে আসবে সমাজের? আমি ‘অহিংসা পরমব্রত’ কপচাতে চাইছি না। কিন্তু নিজের সঙ্গে একটু বোঝাপড়া তো করাই যায়। কতটুকু সহ্য করা যায় তার বোঝা পড়া। অসুস্থতাকে ধারণ, বহন, প্রতিপালন করে তো নিজেরই ক্ষতি।

সেদিন ‘বেসিক ইন্সটিংক্ট’ দেখলাম শ্যারন স্টোনের। স্কুলের বান্ধবি জেনি ট্রিপলেহানের শ্যারন স্টোনের প্রতি যে সহজাত হিংসা, তাকে সে পরিচর্যা করে করে বাড়তে দিতে দিতে একটা সময় সব হারিয়ে জীবনটাও হারিয়ে ফেলে।

ঠিক এই ব্যাপারটা আত্মবিধ্বংসী। সাকিবের কন্যাশিশুর ছবির কমেন্টকারীরা মূলত সাকিবের প্রতি ঈর্ষান্বিত ছিল সাকিবের বৈভবের জন্য। আমি নিশ্চিত এই কমেন্টকারীরা আত্মবিধ্বংসী হয়ে উঠবে বা উঠেছে এই পরশ্রীকাতরতাকে প্রতিপালন করে। অতি মানবীয় একটি মানসিক দশা হল হিংসা। হিংসা মনে জাগতেই পারে, কিন্তু তাকে অনবরত পাত্তা দিয়ে তার ওপরে ভিত্তি করে জীবন পরিচালনা করে গেলে তার পরিণতি কখনোই ভালো হয় না, অন্তত ইতিহাস তাই বলে।

হিংসার জন্য জাতিরাষ্ট্রই ধ্বংস হয়ে যেতে দেখা গেছে বহুবার।

হিংসার জন্য পারিবারিক, সামাজিক বহু সম্পর্ক নষ্ট হয়ে যায়।

কতটুকু শিখেছি তা যদি আমার সার্টিফিকেট বলে দেয় তাহলে সে সার্টিফিকেট এবং আমার শিক্ষা মূল্যহীন তো বটেই, বরং একটি সমাজে আমি সম্পদ নই বরং বোঝায় পরিণত হবো।

সঠিক সামাজিক ‘ভাষা’ শিক্ষার জন্য রাষ্ট্রের একজন ভিক্ষুকও আপনার শিক্ষক হয়ে উঠতে পারেন।

[ফেমিনিস্ট ফ্যাক্টরে প্রকাশিত কলাম লেখকের নিজস্ব বক্তব্য]