টু উইমেন
সৈয়দ ইশতিয়াক রেজা।। সেই ছোট বেলায় সোফিয়া লরেনের ‘টু উইমেন’ ছবিটি দেখেছিলাম। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পটভূমিতে একজন মা (সোফিয়া লরেন) তার ১২ বছরের মেয়েসহ গণধর্ষণের শিকার হয়েছিল। মাত্র ১২ বছরের শিশু মেয়েটি রাতারাতি নারী হয়ে উঠল পুরুষের দুনিয়ায়। আমার মনে হল এই বাংলাদেশে আমি আবার সেই ‘টু উইমেন’ ছবির মঞ্চায়ন দেখলাম।
কক্সবাজারের চকরিয়ায় গরুচোর সন্দেহে মা-মেয়েসহ পরিবারের চারজনকে রশি বেঁধে পুরো গ্রামে ঘুরিয়ে মারপিট নির্যাতন করা হয়েছে। সামাজিক মাধ্যম আর গণমাধ্যমে ব্যাপক প্রচারের পর পুলিশ ঘটনাস্থল থেকে মা-মেয়েসহ একই পরিবারের চার জনকে উদ্ধার করে স্থানীয় একটি হাসপাতালে এনে প্রাথমিক চিকিৎসা দেয়। চকরিয়া উপজেলার হারবাং ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান ও ইউনিয়ন আওয়ামী লীগের সভাপতি মিরানুল ইসলাম পুরো কাজটি করে এখন নানা ধরণের বক্তব্য দিচ্ছেন।
অনেকে অবাক হয়েছেন, অনেকেই বলছেন ‘এ কেমন বিচার’? কিন্তু আমি একটুও অবাক হয়নি। রাতে দেখলাম এক চ্যানেলে স্থানীয় উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তার সাক্ষাৎকার নেয়া হচ্ছে। তাকে প্রশ্ন করা হল, অপরাধ কোনটা? দুই নারীকে তাদের শিশু সন্তানসহ রশি বেঁধে ঘুরানো না গরু চুরি? তিনি বললেন, ‘বিষয়টা দেখতে হবে’।
হ্যাঁ, দেখতে হবে। দেখার অনেক মজা। সমাজের দরিদ্র নারীর ওপর সংঘবদ্ধ এই আদিম অত্যাচারগুলো আমাদের মনের ভেতরের আদিমতার সঙ্গে মিলেমিশে এমন এক অবস্থার সৃষ্টি হয়েছে, যা দেখতেই ভাল লাগে।
জ্বি, ঘটনাটা গণধর্ষণের নয়, কিন্তু এটি যে তার চেয়েও অনেক বেশি সেই পার্থক্যটা অনেকেরই বোধগম্য নয়। মা আর মেয়ে, তাদের সন্তান আর স্বজনরা যে অভিজ্ঞতার ভেতর দিয়ে গেলেন, তার জ্বালা তারা সারা জীবন বইবেন। সেটাও নিশ্চয়ই ইউনিয়ন আওয়ামী লীগের সভাপতি মিরানুল ইসলামসহ জড়িত সবাই এক আদিম আনন্দ উপকরণ হিসেবে উদযাপন করবেন আজীবন।
এটি অপরাধ, যদি শেষ পর্যন্ত অপরাধ হিসেবে প্রশাসন বা এই সমাজ মেনে নেয়। আমরা যারা তথাকথিত নাগরিক সমাজের মানুষ, তারা এখন বলছি কোন নারীর প্রতি এমনটা করা যায় তা নাকি দুঃস্বপ্নেও ভাবা যায় না। কি অসম্ভব কপট নাগরিক আমরা!
এ সমাজ নারীর উপর চিরকালই নিপীড়ন করে এসেছে। কিন্তু এই ঘটনাকে বলা যায় দুই নারীর ওপর শেয়াল-কুকুরের ঝাঁপিয়ে পড়া। কিন্তু এটাও এক ভুল। শেয়াল বা কুকুর আসলে এতটা নিচে নামে না। এটাই বাস্তবতা। আমরা চোখ-কান বন্ধ করে আছি এবং আমরা এও জানি যে, আজ যেটা কক্সবাজারে ঘটেছে, কাল সেটা আরেক জায়গায় ঘটতে পারে। সামাজিক সমাজকে বিদায় করে যে বিস্তীর্ণ দলীয় রাজনৈতিক সমাজ আমরা সৃষ্টি করেছি, সেখানে যে কোন জায়গাতেই এমনটা হতে পারে। যে সব মূল্যবোধ আমাদের সমাজে গড়ে উঠেছিল, রাজনৈতিক দুর্বৃত্তায়নে সেগুলো বদলে যাচ্ছে, ভেঙে যাচ্ছে।
একথা আমি বলতে চাইনা যে, আমাদের আগের সমাজ খুব বিশুদ্ধ ছিল এবং সেটা রক্ষা করা আজকের দিনে আর সম্ভব হচ্ছে না। রাজনীতি, প্রভাব আর ক্ষমতার দম্ভের কারণে ব্যক্তির সঙ্গে সমাজের সম্পর্ক আর থাকছে কিনা সেই বিষয়টা পরিষ্কার হওয়া দরকার। দেশের রাজনীতির হাত ধরে শহুরে বা গ্রামীণ সমাজের ভেতরে ব্যাপক বদল ঘটেছে আর সেটা হল দখল সংস্কৃতি। আমরা জ্ঞান বিজ্ঞান থেকে দূরে আছি আর মানুষের জমি, সম্পদ আর নারী দখলের অধিকার ফলানোয় আদিম হয়ে উঠছি।
একটা কুসংস্কারমুক্ত, আধুনিক শিক্ষা ও স্বাস্থ্য ব্যবস্থার আওতায় আর কখনো আসতে পারব কিনা জানিনা। এই আশাহীনতা থেকে এক দিকে যেমন জন্ম নিচ্ছে এমন নতুন নতুন আদিম নির্যাতন কৌশল, তেমনই আবার প্রকট হয়ে উঠছে অপরাধীদের সাথে ক্ষমতার কেন্দ্রে থাকা শক্তির পরম্পরা।
আজকের বাংলাদেশের আধুনিক সমাজে এই দুই নারীর সাথে যা ঘটল তাকে কী বলা যাবে? আদিম অত্যাচার? নাকি সমাজের আদিমতা? প্রশ্নটা রেখে শুধু এটুকুই বলব, ক্ষমতাবানদের কাছে দরিদ্র, অসহায় নারী বা যেকোন নারী কেবলই ভক্ষণের বস্তু। সেটা ধর্ষণ করেও হয়, না করেও হয়। যে আধুনিকতার কথা বলে চিৎকার করি আমরা, সেই সমাজে নারীরা এই মা আর তার মেয়ের মত লাঞ্চিত, অপমানিত, নিষ্পেষিত।
[ফেমিনিস্ট ফ্যাক্টরে প্রকাশিত কলাম লেখকের নিজস্ব বক্তব্য]