যে চোখে সমুদ্দুরের হাতছানি…
আলীয়া তামজিদা কান্তি।।
রেলগাড়ির প্রচণ্ড শব্দ আর গতি যেমনি করে কাঁপন জাগায় মাটির বুকে, তেমনি করে অস্থিরতার কাঁপন জাগায় রাশেদের বুকে। ছোট বেলা থেকেই রেলগাড়ির শব্দে অস্থির হয় তার মন। সেই শৈশবেই তার মনে হতো, রেলগাড়ি তাকে তার গ্রাম থেকে নিয়ে যেতে পারে দূরের দেশে, অজানা এক রাজ্যে। সেই অজানা রাজ্যের আকর্ষণ এখনো মুছে যায়নি তার মন থেকে। তার মন ভরা শুধু স্বপ্ন আর স্বপ্ন! এখন তো সে আর ছোট নয়; কৈশোর পেরিয়ে রীতিমত যুবক। তাই ট্রেনের শব্দ ছাড়া আরও কিছু বিষয় আছে যা সে অগ্রাহ্য করতে পারে না। দুপুরের রোদ্দুরে পুকুর পাড়ে বসে থাকা শিউলি নামের মেয়েটির নিষ্পাপ চোখ, আধ ভেজা এলোমেলো চুল আর না-বলা কথার নিস্তব্ধতা। বৈশাখের দমকা হাওয়া ঢেউ তোলে শিউলির শুকাতে দেয়া চুলে আর রাশেদের উত্তাল মনে। দুপুরে তপ্ততায় শুকায় শিউলির আধভেজা চুল আর তপ্ত হয় রাশেদের মন। দূর থেকে পুকুরের অপর পাড়ে দেখা মেয়েটির নির্বাক চাহনিতে রাশেদের দৃষ্টিতে লাগে ঘোর, উচাটন হয় মন। কিন্তু, এতটুকুই। অনুভূতি আছে কিন্তু তা যেন প্রকাশ করতে নেই। দুজনের মাঝে এক পুকুরের দূরত্ব। রাশেদ বুঝতে পারে শিউলির মনের কথা। শিউলিও বোঝে তার মন। কিন্তু অনুভব করার গন্ডি পেরিয়ে অনুভূতি প্রকাশ করার সাহস দুজনের একজনও করতে পারেনি এখনো। কারণ রাশেদ জানে সে এখনো সেরকম রোজগার করার মত সক্ষম হয়নি। সে জানে শিউলির বাবা কখনোই তাকে তুলে দেবে না একজন রোজগারহীন আবেগে উত্তাল, স্বপ্নে বিভোর পাত্রের হাতে। বাস্তবতার এই বোধ তাকে আরও বড় স্বপ্ন দেখায় আর স্বপ্নকে সত্যি করার সাহস দেয়, শক্তি দেয়।
নির্ভেজাল গ্রামের ছেলে সে। গ্রামের আট দশটা ছেলে এ-কাজ সে-কাজের ফাঁকে ফাঁকে যতটুকু সুযোগ পায়, সেও তাই পেয়েছে। হয়তো পড়াশোনার ক্লাসের চেয়ে বয়সটাই বেড়েছে তার বেশি। যখন তার এস.এস.সি পরীক্ষা দেবার কথা ঠিক তার আগে আগে জন্ডিস জেঁকে বসে তার শরীরে। দুর্বল শরীর যেন শুকনো ঝরাপাতা আর বাস্তবতার ঝড় সেই ঝরা পাতাকে উড়িয়ে নিয়ে যায় স্বপ্ন থেকে অনেক দূরে। পরীক্ষা দেয়ার প্রশ্নই উঠল না। নিয়তির খেলায় বেশ কিছুদিন হতাশায় দিন কাটল তার। তবু সে শক্তি খোঁজে স্বপ্নপূরনের। একদিন বড় মামা আসেন বাড়িতে। বড় মামার পরামর্শ আর প্রেরণা, শিউলিকে জয় করার প্রবল আকর্ষণ, সংসারের গরীব হাল থেকে মুক্তির আকাঙ্ক্ষা আর অজানা রাজ্যের হাতছানি সব মিলিয়ে আবারো আশায় বুক বাঁধে রাশেদ। বড় মামার সাথে নরসিংদী জেলায় গিয়ে প্রাইভেটে এস.এস.সি দেয় রাশেদ। মোটামুটি ভাল হয় রেজাল্ট। কিন্তু পড়াশোনা চালিয়ে যাওয়াটা আর সম্ভব হচ্ছে না। বাবার দোকানদারির অবস্থা সুবিধার না। বড় ভাইও একা সংসারের ঘানি টানতে পারবে না। সংসারের হাল এবার রাশেদকে ধরতেই হবে! ছোট বোনটার বিয়ে দেয়াও বাকি। ছোট ভাইয়ের পড়াশোনা তো আছেই।
কি করা যায় আকাশ পাতাল ভাবতে থাকে রাশেদ। বাবা পরামর্শ দেয় নরসিংদী গিয়ে বড় মামা যে মিলে কাজ করে ওখানে কাজ নিতে। রাশেদের মন টানে আরও দূরে, রাজধানী ঢাকায়। ঢাকায় তাদের আত্মীয় স্বজন কিছু আছে কিন্তু কারও সাথে রাশেদের তেমন যোগাযোগ নেই। তার চাচাতো ভাই জামানের আবার ভালই যোগাযোগ আছে সবার সাথে। আত্মীয়দের কেউ কেউ হয়তো খাতির করে গেলে, আবার কেউ কেউ হয়তো চেনেইনা এমন ভাব দেখায়। এই তো দুনিয়া! রাশেদের ইচ্ছা করে না কারও গলগ্রহ হতে। ঢাকার কথা ভাবতে গিয়ে হঠাৎ একটা ঘটনা মনে হয়ে গেল তার। একবার নরসিংদী থেকে ট্রেনে বাড়ি ফিরছিল রাশেদ। নরসিংদী থেকে এক মহিলা ও তার মেয়ে উঠেছিল ট্রেনে। ভুল বগিতে উঠে বসার জায়গা খুঁজে পাচ্ছিল না। এদিকে ট্রেন ছেড়ে দেয়ায় দাঁড়িয়ে থাকতে ও অসুবিধা হচ্ছিল ওদের। রাশেদ সাথে সাথে জায়গা ছেড়ে দিল। মহিলার মালামাল জায়গা মত রাখল নিজেরটা সরিয়ে। উটকো ছেলের অশোভন আচরণ টের পেয়ে ছায়ার মতো পাহারা দিল ওদের। পরে ওদের টিকিট নিয়ে সিট খুঁজে দিল। রাশেদের উপকারের প্রবণতা দেখে রাশেদের প্রতি মায়া পড়ে মহিলার। রাশেদ বিদায় নেয়ার সময় মহিলা তাকে একটা কার্ড দিল। কখনো ঢাকায় গেলে প্রয়োজন পড়লে ও যেন যোগাযোগ করতে পারে। মহিলা একটা এনজিওতে আছেন। নাম রিনা জাফর। নরসিংদীতে ট্যুরে গিয়েছিলেন। ওখান থেকে আরও কিছু জায়গায় যাবেন। গাড়িতে হঠাৎ সমস্যা হওয়ায় ট্রেনে যাচ্ছেন।
ঘটনাটা মনে পড়তেই সোজা হয়ে বসল আধ-শোয়া রাশেদ। ঐ মহিলা তো শিক্ষিত মানুষ; চাকরির ব্যাপারে কিছু পরামর্শ তো অন্তত দিতে পারেন। রাশেদ জামানের সাথে পরামর্শ করল। জামান তার চেয়ে বয়সে বড় হলেও তার প্রাণের বন্ধু। জামানের খালাতো ভাই খালেক ঢাকার জিগাতলায় একটা মেসে থাকে। পেশায় ড্রাইভার। খালেকের মেসেই প্রথম উঠল রাশেদ।
রাশেদ ভয়ে ভয়ে ফোন করল রিনা জাফরকে । মহিলা ভালোভাবেই সাড়া দিলেন। পশ্চিম ধানমন্ডিতে স্টার কাবাবের পেছনে এপার্টমেন্ট। অনেক্ষণ কথাবার্তা হলো। স্বামী-স্ত্রী দুজনেই অনেক ভাল পরামর্শ দিলেন রাশেদকে। তারা বিভিন্ন রকম ট্রেনিং এর কথা বললেন যা কাজে লাগিয়ে উপার্জন করা যাবে। ওয়ার্কশপের কাজ, ইলেকট্রেশিয়ানের কাজ, ড্রাইভিং, নার্সিং, হোটেলের কাজ, গার্মেন্টসের কাজ, সিকিউরিটি সার্ভিসের কাজসহ আরও বিভিন্ন কারিগরী প্রশিক্ষনের কথা বললেন দুজনে যা রাশেদকে আয় করতে সাহায্য করতে পারে। তার সাথে পড়া চালিয়ে যাওয়ার উপায়ও বললেন। সব কিছুর মধ্যে সিকিউরিটি গার্ডের চাকরিটাকেই রাশেদ লক্ষ্য হিসেবে বেছে নিল। বিশেষ করে সে যদি নাইটগার্ডের চাকরি করতে পারে সেক্ষেত্রে দিনের বেলায় নিজে কোন ব্যবসা করার সময় পেতে পারে।
একটা সিকিউরিটি কোম্পানিতে টিকে গেল লম্বা, চওড়া, সুঠাম দেহের রাশেদ । ট্যানারির মোড়ের মেসে রুম নিল । সুখের দিন বুঝি শুরু হলো তার! মনে প্রাণে ধন্যবাদ দেয় সে রিনা জাফরকে, শিউলিকে জয়ের আকাঙ্ক্ষাকে আর সেই দুরন্ত গতির রেলগাড়িকে যার কারণে আজ সে স্বপ্নের রাজ্যে।
আনন্দবার্তা পৌঁছে যায় বাড়িতে আর শিউলির কাছে। শিউলিকে নিয়ে তার অনেক স্বপ্ন। শিউলিকে বিয়ে করে শহরে নিয়ে আসবে; শিউলিও একটা কাজ নিয়ে নেবে গার্মেন্টসে- স্বপ্নে বিভোর হয় রাশেদ। সামনে অনেক খরচ- বাড়ির খরচ, ঢাকার খরচ। চাকরির পাশাপাশি একটা ব্যবসার জন্য তিল তিল করে গড়তে হবে পুঁজি।
শিউলি-রাশেদের ব্যাপারটা আগেই কিছুটা জানাজানি হয়ে গিয়েছিল। যথারীতি শিউলির বাবা বাগড়া দিয়েছিলেন সম্পর্কে। কিন্তু রাশেদ যখন চাকরি পেয়ে যোগ্য হয়ে আনুষ্ঠানিকভাবে বিয়ের প্রস্তাব পাঠালো, তখন আর আপত্তি করেনি ।
কল্পনায় রঙীন হয় শিউলির মন। তার আবেগটাকে সে সামলে রাখে; কৃতজ্ঞ হয় খোদার ও মনের শক্তির কাছে । আবেগকে সামলে রাখার অভ্যেস তার আছে। এতদিনে অনেক চড়াই-উতড়াই পার হয়ে এসেছে সে। বাবার হৈচৈকে সে সামাল দিয়েছে তার সুস্থির মনের শক্তি দিয়ে; নীরবে সব কিছু মেনে নেবার ভান করে। তাইতো বাবাও তখন অন্য পাত্র খুঁজতে অস্থির হননি। খোদার দয়া তাদের পরিস্থিতিকে স্বাভাবিক করে দিয়েছে।
অপেক্ষায় অস্থির হয় রাশেদের মন। দুজনের বাবা-মার সাথে কথা হয়েছে প্রথমে আকদ হবে। অনুষ্ঠান হবে চার মাস পর। রাশেদ এর মধ্যে সব কিছু গুছিয়ে নিতে চায়।
আকদের দিন ঘনিয়ে আসে। বিয়ের শাড়ি, আংটি এসব কিনতে বের হয় রাশেদ খালেকের সাথে। সময়ের অভাবে রওনা দেয়ার আগ পর্যন্ত মার্কেটে ঘুরতে হয়েছে রাশেদকে। স্টেশনে পৌছাঁনো নিয়েই দুশ্চিন্তায় পড়ে রাশেদ। প্রাণপণে ট্যাক্সি চালালো খালেক। স্টেশনে যখন পৌঁছাল, ততক্ষনে ট্রেন ছেড়ে দিয়েছে। উপায়ন্তর না দেখে সে দৌঁড়ে লাফ দিয়ে একটা মালগাড়ির বগিতে উঠে পড়ল। কিন্তু তার সাথে সাথেই আরও দুজন চ্যাংড়া ধরণের ছেলে উঠে পড়ল মালগাড়িতে । তারপর আচমকা একজন রাশেদকে জাপটে ধরল আর আরেকজন তার গলার কাছে একটা ছুরি ধরে শাসাল রাশেদকে; রাশেদ কোন কিছু বলার আগেই তারা কেড়ে নিল সব টাকা, ব্যাগ আর মোবাইল। উত্তেজনায় কেঁপে কেঁপে রাশেদ বলল “আমার এলাকায় চল তোরা, তারপর দেখবি আমার ক্ষমতা।” বলার সাথে সাথে যে ঘটনাটি ঘটল তা মুহুর্তের মাঝেই চুরমার করে দিল রাশেদের সাজানো স্বপ্ন। এক ধাক্কায় রাশেদকে ফেলে দিল ট্রেন থেকে। ছিটকে রাশেদ পড়ল আরেকটা রেললাইনের উপর। নিয়তির জঘন্য খেলায় একটা চলন্ত ট্রেন এসে কেটে নিয়ে গেল রাশেদের ডান হাত আর ডান পায়ের গোড়ালি থেকে পাতা পর্যন্ত। সুঠাম দেহের সুদর্শন রাশেদকে চোখের পলকে জড়িয়ে ধরলো পঙ্গুত্বের অভিশাপ। কী ঘটে গেল কিছুই যেন বলতে পারে না রাশেদ। তার শুধু মনে আছে কান ফাটানো শব্দ, প্রাণ-কাঁপানো ভূমির কাঁপন, প্রকাণ্ড দানবের প্রচণ্ড গতি আর কাটা হাত পায়ের তীব্র যন্ত্রণা। যখন সে চোখ মেলল তখন সে পঙ্গু হাসপাতালে।
ভাগ্য ভাল যে খালেক এসেছিল স্টেশনে তাকে পৌঁছে দিতে। রাশেদ যখন ছুটে মালগাড়িতে ওঠার চেষ্টা করছিল, খালেক তখন চিৎকার করে নিষেধ করছিল। সেও দৌঁড়াচ্ছিল রাশেদের পিছু পিছু। ফলে চ্যাংড়া ছেলে দুটোকেও উঠতে দেখে খালেক। বাকি ঘটনা অবশ্য সে আর দেখতে পায়নি, কিন্তু কিছুক্ষণের মধ্যেই মানুষের হৈ-চৈ শুনে ভয়ঙ্কর ঘটনাটি আবিষ্কার করে। বাড়িতেও খবর পাঠিয়ে দেয় । ঢাকার আত্মীয় স্বজনদের কয়েকজন সহযোগিতার হাত বাড়ায়। রিনা জাফরও খবর পেয়ে দেখতে আসে; অনেক সাহস দেয় তাকে। হাসপাতালে দুটো মাস যেন এক ভয়ঙ্কর ঘুম যে ঘুম দুঃস্বপ্নের গ্রাস থেকে মুক্তিই দিতে চায় না। অনিশ্চিত ভবিষ্যতের আশঙ্কা আর নিয়তির নিষ্ঠুরতা কুড়ে কুড়ে খায় হাসপাতালের বেডে পড়ে থাকা পঙ্গু রাশেদকে। অসহায়ত্ব দখল করে নেয় রাশেদের মন আর দেহকে- কী করে ফিরে আসবে তার কাটা যাওয়া অঙ্গ, সম্ভাবনাময় জীবন, আর আকাঙিক্ষত স্বজনকে কাছে পাবার মধুক্ষণ।
রিনা জাফর বোঝেন পঙ্গু রাশেদের পক্ষে এখন শহরে টিকে থাকা অলীক স্বপ্ন। তাই নতুন করে বাঁচার জন্য তিনি ভরসা দেন রাশেদের গ্রামে তার এনজিওর পশুপালন প্রকল্প থেকে তাকে পশুপালনে জন্য ঋনের ব্যবস্থা করে দেয়া যাবে। রাশেদ আশায় বুক বাঁধে। তাকে বাঁচতে হবে নতুন করে। সে পঙ্গু, তাই বলে মৃত তো নয়। ফলে ভাল ভাবে বাঁচার চেষ্টা তাকে করতেই হবে। জয় করতেই হবে তার কঠিন সময়কে। কিন্তু শিউলিকে পাবার বিষয়টা ভাবতে গেলেই মন দুর্বল হয়ে যায় রাশেদের। শিউলির বাবা কঠোর রূপ নিয়েছে রাশেদের দুর্ঘটনার পর। রাশেদের যেন আগের প্রস্তাবের কথা ভাবাটাই অন্যায়। এখানেই দুর্বল হয় রাশেদের মন। তবুও সে শক্তি খুঁজে বেড়ায়। শক্তি খুঁজে বেড়ায় সে শিউলির ব্যক্তিত্বের মাঝে। শিউলির ধীরস্থির ব্যক্তিত্বই রাশেদের একমাত্র ভরসা এখন। কে জানে শিউলি হয়তো তার মনের সুস্থিররতা দিয়ে আবারো জয় করে নেবে তাদের কালো সময়। রাশেদ স্বপ্ন দেখতেই থাকে। স্বপ্ন আছে বলেই হয়তো বেঁচে থাকে রাশেদের মত জীবনে পোড় খাওয়া মানুষেরা, যদিও কীভাবে বেঁচে থাকে সে প্রশ্নের উত্তর খোঁজার অবসর হয় না কারও। তাদের জীবন যেন আঁকাবাঁকা স্রোত যা সময়ের বাঁকে বাঁকে নির্মম আঘাত পেয়েও ছুটে চলে সামনে; হয়তো বা চোখে থাকে সমুদ্দুরের হাতছানি।