September 20, 2024
ফিচার ৩মুক্তমত

“বিয়ের পরে ঘুরতে যাইস”

আফরোজ ন্যান্সি।। যেদিন থেকে একটু আধটু বানান করে করে গল্পের বই পড়া শুরু করছি সেই দিন থেকে বাইরের দুনিয়াটা দেখার, দেশ-বিদেশ ঘোরার এক দুর্নিবার আগ্রহ আমার শিশুমনকে আলোড়িত করতো। কিন্তু যে মেয়েকে একবেলা বান্ধবীর বাসায় বেড়াতে যেতে দেওয়া হয়না তার কী করে সাহস হয় দেশ-বিদেশে ঘুরতে যাওয়ার ইচ্ছের কথা বাবা-মাকে বলে? স্কুল-পিকনিক, স্টাডি ট্যুর এসব আমার দুঃস্বপ্নের মতো লাগতো।  বড় হয়ে যখন কোথাও ঘুরতে যেতে চাইতাম চিরাচরিত মায়ের মতো আমার মাও বলতেন, “বিয়ার পরে যাইস।”

আমাদের সমাজে মেয়েদেরকে বাবা-মায়ের কাছে অন্যের গচ্ছিত আমানত মনে করা হয় যতদিন না যার আমানত তাকে বুঝিয়ে দেওয়া যায় ততদিন অব্দি বাবা মায়ের মাথা ব্যাথা। বুঝিয়ে দেওয়ার পরে যার জিনিশ সে তা নিয়ে যা খুশি করতে পারেন, মারতে পারেন, গাইল্লাইতে পারেন, আবার ইচ্ছে হলে ঘুরতেও নিয়ে যেতে পারেন। আমার মনে হতে থাকে যেন আমি একটা শোকেসে সাজানো পুতুল। আমার নিজের কোনো ইচ্ছা-অনিচ্ছা নেই। আমার ঘুরতে যেতে ইচ্ছে করে এটা গুরুত্বপূর্ণ না বরং আমার মা চান না আমি কোথাও ঘুরতে যাই- সেটাই মূল কথা। বিয়ের পর আমার যিনি “স্বামী” হবেন তিনি যদি চান তো আমাকে নিয়ে যেতেও পারেন আবার নাও পারেন। সেটাও তার ইচ্ছা। একটা গোটা জীবন অন্যের ইচ্ছার দিকে তাকিয়ে কাটিয়ে দিতে হবে ভেবে আমার দমবন্ধ লাগতে থাকে।

ভার্সিটিতে ভর্তির পর প্রথম আমি কাউকে কিছু না বলে ঢাকা থেকে বরিশাল চলে গেছিলাম আব্বু-আম্মুর অ্যানিভার্সারিতে সারপ্রাইজ দিতে। আব্বু খুশি হলেও আম্মু খুশি তো হলোই না বরং চিল্লাপাল্লা শুরু করে দিলো। এই ঘটনা আমার মনে একটা ব্যাপক প্রভাব ফেলেছিলো সেদিন। শান্ত শিষ্ট ভালো মেয়ে হয়ে থাকা আমার মনের মধ্যে একটা প্রবল বিদ্রোহ টের পেতে শুরু করি। এর কিছুদিন পর থেকে আমার টুকটাক ঘোরাঘুরি শুরু। আজও আমার প্রতিটা ট্যুরের আগে আর ট্যুর থেকে আসার পরে আমার মায়ের সাথে ভীষণ বিশ্রী একটা মনোমালিন্য চলে বেশ কিছুদিন পর্যন্ত। যদিও আজ অব্দি আমার একা কোথাও ঘুরতে যাওয়া হয়ে ওঠে নাই। কখনো ফ্যামিলির সাথে, কখনো বন্ধুর সাথে যেতে হইছে। ছোটবেলার মতো আজও একা একা ট্রাভেল করাটা আমার কাছে কোনো এক থ্রিলার উপন্যাসের অ্যাডভেঞ্চারাস গল্পই থেকে গেছে। এমন না যে ফ্যামিলির সাথে কিংবা বন্ধুদের সাথে ঘুরতে যেতে আমার খারাপ লাগে। বরং একা ঘুরতে গেলেই বেশি বোরিং লাগার কথা। কিন্তু এই যে বাধ্যবাধকতা, একা যাওয়া যাবেনা, পরিচিত কোনো লোক ছাড়া যাওয়া যাবেনা, এই বাধ্যতামূলক ব্যাপারটা আমার হাঁসফাঁশ লাগে, অস্বাস্থ্যকর লাগে। এই হাঁসফাঁশ লাগা থেকে মুক্ত হতে জীবনে অন্তত একবার আমি একলা কোনো এক অচেনা শহরে ঘুরে বেড়াতে চাই, অন্তত একবার একটা বেলা একাকী সমুদ্রের তীরে ঝাউবনে বসে থাকতে চাই। নিঃসন্দেহে এটি আমার জীবনের সব থেকে সুন্দরতম অ্যাডভেঞ্চার হবে ।

বাংলাদেশের বেশিরভাগ মেয়ে এই অপেক্ষা নিয়েই বড় হয় যে বিয়ের পর জামাইর সাথে ঘুরতে যাবে। বিয়ের পর নিজের পছন্দের কাপড় পরবে। কিন্তু এই অপেক্ষাও অলীক অপেক্ষা। স্বপ্নপূরণ হতেও পারে, নাও হতে পারে। এক্ষেত্রেও  স্বামীটির ইচ্ছার উপর নির্ভর করতে হবে। অনেক মেয়ে ঘুরতে যেতে পছন্দ করে কিন্তু তার পার্টনার ঘোরাঘুরি পছন্দ করেনা, আবার স্ত্রী একা কোথাও ঘুরতে যাক সেটাও অ্যালাও করেন না।  সেক্ষেত্রে ওই নারী তার ইচ্ছেকে মনের মধ্যেই মাটিচাপা দিয়ে ফেলেন সাংসারিক সুখ শান্তির কথা ভেবে। আবার বিয়ে হলেই তো পারিপার্শ্বিক চাপ শেষ হয়ে যায় না। “বিয়ের পরে ঘুরতে যাইস” বলা লোকেরা তখন বলা শুরু করে, “বিয়ে করছো, এবার সংসারে মন দাও, বাচ্চা-কাচ্চা নাও, ঘুরতে অনেক পারবা।” এইভাবে সব লোকের সব আকাঙ্ক্ষার নিচে চাপা পরে যায় একটা উচ্ছল ট্রাভেলার হৃদয়।

আমার ছেলে বন্ধুদের দেখি মন চাইলে একা কিংবা দলবেঁধে চলে যাচ্ছে পাহাড়ে কিংবা সমুদ্রে কিংবা যেখানে খুশি। কেউ তাদের পথ আটকাচ্ছে না। অন্যদিকে বেশিরভাগ মেয়ে বন্ধুরাই বিয়ে-স্বামী-বাচ্চার মধ্যেই আটকে আছে জীবনভর। আর যারা ঘুরতে যাচ্ছে তারাও হয় পরিবার, প্রেমিক বা স্বামীর সাথে যাচ্ছে। কেননা তারা জানে ততটুকু স্বাধীনতাই তারা উপভোগ করতে পারবে যতটুকু স্বাধীনতা তাকে দেওয়া হবে। এর বাইরে চাইতে গেলেই আঙুল উঠবে তার দিকে, অশান্তি হবে ঘরে-বাইরে। এই অশান্তির ভয়ে সবকিছু মেনে নেওয়াটাই একমাত্র সমাধান হিসেবে বেছে নিয়েছে তারা। আজকাল নতুন ট্রেন্ড দেখি বিয়ের আগে ছেলেদের ব্যাচেলর ট্রিপ হয় কিন্তু আজ অব্দি কখনো বিয়ের আগে মেয়েদের ব্যাচেলর ট্রিপ হতে দেখিনি। সত্যি এটাই যে জীবনকে নিজের মতো করে উপভোগ করার চিন্তা মেয়েদের মাথায় যেন না আসে সমাজ তার সবরকম ব্যবস্থাই করে রেখেছে বহুকাল আগে থেকে।

এদেশে হাতে গোনা কয়েকটা মেয়ে আছে যারা সমস্ত গণ্ডি ভেঙে বেরিয়ে যেতে পেরেছে, সত্যিকারের ট্রাভেলার হতে পেরেছে কিন্তু যুদ্ধটা তাতে শেষ হয়ে যায়নি। প্রতিনিয়ত তাদের লড়তে হচ্ছে পরিবার আর সমাজের বিরুদ্ধে। অনেক প্রগতিশীল মানুষও ট্রাভেলার মেয়েদেরকে ভালো চোখে দেখেনা। কোনো গ্রুপের সাথে একা ঘুরতে আসা মেয়েদের দিকে অনেক শিক্ষিত নারী-পুরুষকেও বাজে মনোভাব নিয়ে তাকাতে দেখি, বাজে ইঙ্গিত করতে দেখি। ভাবটা এমন যে, একা একটা মেয়ে ঘুরতে আসছে মানে নিশ্চয়ই এই মেয়ের চরিত্র খারাপ। এখন দুই একটা এজেন্সি আছে যারা শুধু মাত্র মেয়েদেরকে নিয়ে ট্যুর দেন কিন্তু এখানেও পরিবার-পরিজনের কাছ থেকে আপত্তি ওঠে। শুধু মেয়েরা মিলে যাচ্ছে, বিপদ হলে কে উদ্ধার করবে? আরেহ বাবা, ত্রিশটা মেয়ে যেখানে যাচ্ছে সেখানে বিপদ উদ্ধারের জন্য একজন পুরুষ থাকা কি বাধ্যতামূলক? আমি বুঝতে পারিনা এই শহরে ঘরে-বাইরে যে যুদ্ধটা আমরা একলাই করি ঠিক সেই যুদ্ধটাই পাহাড় কিংবা সমুদ্র দেখতে গেলে করতে পারবো না, এটা ক্যামন যুক্তি? আসল কথা মেয়েরা ঘরের বাইরে যাবে, দুনিয়া দেখবে-চিনবে-জানবে এটা আমাদের সমাজ মেনে নিতে চায়না। “যদি তোর ডাক শুনে কেউ না আসে তবে একলা চলো রে” গানটা সম্ভবত শুধু পুরুষের জন্যেই লেখা হয়েছে। নতুবা মেয়েদের একলা চলার পথে এতো বাধা বিঘ্ন আসবে কেন!

কোনো মেয়ে চাইলে তার সঙ্গীর সঙ্গে ঘুরতে যাক, চাইলে বাবা-মায়ের সাথে ঘুরতে যাক কিন্তু এমন বাধ্যবাধকতা না থাকুক যে মেয়ে হয়ে জন্মেছে বলে সবসময় কারো না কারো সাথে পরগাছার মতো ঘুরতে যেতে হবে তার। ঘুরতে যাওয়ার ইচ্ছা মনে পুষে রেখে দিনের পর দিন অপেক্ষা করতে না হোক কবে বিয়ের পর জামাইর সাথে ঘুরতে যাবে, অথবা কবে স্বামীর অফিস থেকে ছুটি মিলবে, অথবা কবে বাচ্চারা বড় হবে! ভুলে গেলে চলবে কেন যেখানে অনুগত করার, বাধ্য করে রাখার চাপ বেশি সেখানে বন্ধন ভেঙে বেরিয়ে পরার তাগিদটাও প্রবল। শুধুমাত্র মেয়েদের জন্য পুরুষতন্ত্রের তৈরি করে দেওয়া সকল বাধ্যবাধকতার নিয়ম ভেঙে এবার থেকে মেয়েগুলি একলা বেরিয়ে পড়ুক বনে-জঙ্গলে-সমুদ্রে-পাহাড়ে।

 

[ফেমিনিস্ট ফ্যাক্টরে প্রকাশিত মুক্তমত লেখকের নিজস্ব বক্তব্য]