November 2, 2024
ফিচার ৩সাক্ষাৎকার

মানবতার জন্য নিজেকে সঁপে দিয়েছি: এলিস ওয়াকার

এলিস ওয়াকার মার্কিন ঔপন্যাসিক, নারীবাদী অ্যাক্টিভিস্ট ও সমাজকর্মী। তিনিই প্রথম কৃষ্ণাঙ্গ লেখক যিনি তার উপন্যাস দ্য কালার পার্পলের জন্য পুলিৎসার পুরস্কার জয় করেছিলেন। এলিস ওয়াকারের এই সাক্ষাৎকারটি প্রকাশ হয় দ্য গার্ডিয়ান পত্রিকায় ২০১৩ সালে। ফেমিনিস্ট ফ্যাক্টরের পাঠকদের জন্য সাক্ষাৎকারটি বাংলায় অনুবাদ করে দেয়া হলো।

 

আপনার জীবন এবং কর্মের উপর প্রতিভা পারমা বিউটি ইন ট্রুথ চলচ্চিত্রটি তৈরি করেছেন, যেখানে দেখানো হয় আপনি কত বিভিন্ন রকম স্থানে নানান রকম মানুষের সাথে কত ধরণের কাজ করেছেন। বিষয়টা কেমন লাগে আপনার?

আমি এখনও অন্তত পাঁচটা সমান্তরাল জীবন যাপন করি, সত্যি বলছি। অবাক লাগে আসলেই। আমার কোন ধারণাই নেই কীভাবে এটা সম্ভব হয়। কিন্তু হ্যাঁ, আমি মেক্সিকোতে থাকি, হাওয়াইতে থাকি আবার উত্তর ক্যালিফোর্নিয়াতেও বাস করি এবং আমার পুরো জীবনটাই এমন, যেন আমি আমার সব এনার্জি আমার পূর্বপুরুষদের কাছ থেকে পেয়েছি, যারা ৪০০ বছর ধরে এই পৃথিবীতে বীজ বুনে যাবার কাজ করছেন, আর তাদের সব ইচ্ছেগুলো এই পৃথিবীর অংশ হয়ে রয়েছে।

সিনেমাটা শুরু হয়েছে আপনার ছেলেবেলা দিয়ে, জর্জিয়াতে জিম ক্রো নীতির ভেতরে একজন বর্গাচাষীর আট সন্তানের একজন হিসেবে আপনার বেড়ে ওঠা দিয়ে। আপনার পরিবারের আয় ছিল খুব সামান্য, কিন্তু আপনি একজন সত্যিকার দৃঢ়চেতা মা পেয়েছিলেন।

আমার কমিউনিটিতে সব মায়েরা এক একজন আলাদা আলাদা রকমের ছিলেন। বেশিরভাগ মায়েরা পুরুষের তৈরি সিস্টেম এবং শ্বেতাঙ্গ আধিপত্যবাদের নিয়ন্ত্রণ- এসব অবলম্বন করে বেঁচে ছিলেন। কিন্তু আমার মা এসব মেনে নেননি। সে আসলে এটা মানতেই পারেনি। এটা তার ভেতরে ছিলই না।

আপনি শৈশবেই লিখতে শুরু করেছিলেন। মনে করতে পারেন কি, আপনি তখন আসলে কী বলতে চাইতেন?

আমি আমার নিজের জন্য একটা ঘর চাইতাম। এটা ভার্জিনিয়া উলফকে পড়বারও অনেক আগের ঘটনা, আমি জানতাম আমার কী প্রয়োজন। আমার মা বলেন, আমি যখন হামাগুড়ি দিতাম তখন আমি বাড়ির পেছনে চলে যেতাম আর তিনি আমাকে আবিস্কার করতেন একটা কাঠি নিয়ে আমি ময়লা ধুলাবালির ভেতরে হিজিবিজি কাটছি।

আপনার বাবা মায়ের গড়ে তোলা একটি স্কুলে আপনি যেতে শুরু করেন এবং কলেজে বৃত্তিও পান। কিন্তু এরপর আপনি আবার সাউথে ফিরে আসেন। কেন?

আমাদের প্রত্যেকের ভেতরে একটা কণ্ঠ থাকে, যেটি জানে ঠিক কোন পথে যেতে হবে। আর আমি খুব অল্প বয়সেই সেই কণ্ঠটিকে অনুসরণ করতে শিখেছিলাম। যদিও এর ফলে অনেক সমস্যা হয়েছে, অনেক পস্তাতে হয়েছে। তবু আমি মনে করি এটাই একমাত্র সঠিক উত্তর। প্যারিস থেকে আমি একটি বৃত্তি পেয়েছিলাম, কিন্তু আমি এটি ফিরিয়ে দিই। কারণ আমি উপলব্ধি করেছিলাম, আমার কর্তব্য হল ফিরে যাওয়া এবং সেইসব মানুষকে সাহায্য করা, যারা ঠিক আমার পরিবারের মতই। তাই প্লেনের ভেতরে যখন আমি সেই কণ্ঠটিকে আমার ভেতর থেকে শুনতে পেলাম, আমি মিসিসিপিতে ফিরে গেলাম।

আপনার লেখায় আপনি আপনার পরিবার এবং তাদের মত আরো পরিবারকে একটি নিজস্ব কণ্ঠ দিতে চেয়েছেন।

হ্যাঁ আমি দিয়েছি। কারণ আমি তাদের নিজেদের তেজে, মানবিকতায়, সংগ্রামে এবং পরিশ্রমের আলোয় জ্বলে উঠতে দেখতে চেয়েছি, যেটি প্রায় সবার ভেতরেই আছে। এমন না যে আমি আমার পরিবারের লোকেদের ভেতর এমন কিছু পেয়েছি যা অন্যদের ভেতরে নেই।

তাহলে কি এটা বলা যায়, এই লুকিয়ে থাকা জীবনগুলোকে আলোর সামনে আনার কাজটি করার তাগিদই আপনাকে লেখক হতে অনুপ্রাণিত করেছে?

আমার যখন ১৩ বছর বয়স, আমার বোন তখন একজন কসমেটোলজিস্ট। শবযাত্রার জন্য মৃতদেহগুলো সাজিয়ে দেবার কাজও করত সে। একদিন সে আমাকে একটা মেয়ের মৃতদেহ দেখালো যাকে খুন করা হয়েছে। তার স্বামী তার মুখে গুলি করেছিল। এখন অনেক লোক এই কাহিনীটা শুনে নানারকম কথা বলতে শুরু করলো এবং ঘটনাটাকে একদিকে সরিয়ে রাখতে চাইছিল। কিন্তু নারীর প্রতি এ ধরণের সহিংসতা তো জাতিগত এবং ক্রমশই এই বিষয়গুলো সবার সামনে আসতে শুরু করেছে।

আপনি ১৩ বছর বয়সে এমন একটি ঘটনা দেখেছিলেন…

আমার উপর এটা অনেক বড় প্রভাব ফেলেছিল। খুন হয়ে যাওয়া নারীটির মেয়ে আমার সাথে একই ক্লাসে পড়তো এবং আমার দাদীর নামে নাম ছিল তার, এবং তাকেও গুলি করে হত্যা করা হয়েছিল। আমার মনে হয়, যখন তুমি লেখা শুরু করবে, তোমাকে thread of Ariadne অনুসরণ করতে হবে। তুমি জানো না কোন মাইনেটোরকে তুমি খুঁজছো বা কতজনকে তুমি খুঁজে পাবে শেষ পর্যন্ত।

আপনি নাগরিক অধিকার আন্দোলন এবং নারীবাদী আন্দোলনের সাথে আছেন। পরে আপনি নিউইয়র্কে গেলেন এবং ১৯৭০ সালে গ্লোরিয়া স্টিনেমের সাথে মিজ.ম্যাগাজিনে কাজ করা শুরু করলেন।

আমি নারীদের আন্দোলনটিকে ভালবাসি এবং আমি মনে করি না এটা শুধু নির্দিষ্ট কিছু মানুষের জন্য। মিজ ম্যাগাজিনে কাজ করতে আমার দারুন লেগেছে, বিশেষ করে সেটা গ্লোরিয়ার কারণেই হয়েছে। কারণ গ্লোরিয়া জানতো যে আসলেই আমার নিজের একটা ঘর দরকার এবং সেটা সেই অফিসেও।

সমকালীন নারীবাদ নিয়ে আপনার অনুভূতি কী?

একটু ধাঁধার মত লাগে, কিছু ক্ষেত্রে, এত সংগ্রাম, শিক্ষা- সবকিছুর পর। শিক্ষাটা খুব জরুরি। আমরা একজন আরেকজনকে শিখিয়েছি। আমরা অন্য নারী এবং অল্পবয়সী মেয়েদের শিখিয়েছি। নারী- এখন অনেকেই নিজেদের পুরুষ বলে পরিচয় দিচ্ছে, যে কোন সুযোগে নিজের নারীত্বকে মুছে দিতে চাইছে- আমি এই ব্যাপারটা বুঝতে পারি না।

দ্য কালার পার্পল প্রকাশ হবার পর প্রায় ৩০ বছর পেরিয়ে গেল। সময়টাকে কি এতটা দীর্ঘ মনে হয়?

না, সময় সবসময় বর্তমান। কিছু মানুষ ইদানিং এই উপন্যাটিকে আবিস্কার করছে। এবং তারা আমাকে লিখছে তাদের অনুভূতি ঠিক যেমন ৩০ বছর আগে লিখতো। সুতরাং গল্পটি এখনও কোনো না কোনোভাবে জীবন্ত। এমনকি আমিও এরপর আরো অনেক বই লিখেছি এবং এটার কথা কখনো সখনো মনে করেছি, কিন্তু একজন তাৎক্ষনিক পাঠকের যে অনুভূতি সেটি এখনও বর্তমান।

দ্য কালার পার্পল নিয়ে স্টিভেন স্পিলবার্গের সিনেমার উপর যে আক্রমণ হয়েছে তা রীতিমত বিদ্বেষপূর্ণ। এটা তোমার জন্য কেমন ছিল?

লোকজন আমাকে প্রকাশ্যে অপমান করেতে চেয়েছে। ওরা কথা শুরু করে এইভাবে- “আমি তো এই বইটা পড়িনি। আমি তো এই সিনেমাটা দেখিনি। কিন্তু…” অন্যদিকে কিন্তু আমাকে সেন্সর করা হয়েছে। তারা বছরের পর বছর আরো বছর ধরে স্কুলগুলো থেকে আমার বই সরিয়ে নিয়েছে। আমি শক্ত ছিলাম এবং এখনও আছি এবং আমার পূর্বপুরুষদের কাছে ফিরে গিয়েছি, যারা সেই কণ্ঠটিকে ধারণ করেন- “আমরা জানি আমরা কী করছি”। আমি Wild Trees Press নামে একটা প্রকাশনা সংস্থা খুলেছি এবং অজনপ্রিয় লেখকদের লেখা প্রকাশ করতে শুরু করেছি।

আপনার উপন্যাসে  আপনি সত্যি কথাটা বলতে সবসময় দৃঢ়প্রতিজ্ঞ থাকেন। এই একই ব্যাপার কি অ্যাক্টিভিজমের ক্ষেত্রেও ঘটে?

এটাই আশার কথা। সত্যই একমাত্র তোমাকে নেতৃত্ব দিতে পারে। যদি তুমি মিথ্যের পিছে যাও, অবশ্যই তোমাকে ধ্বসে পড়তে হবে।

আপনি একজন প্রতিবাদী অ্যাক্টিভিস্ট হিসেবে পৃথিবী ঘুরেছেন। আবার একই সাথে আপনি নির্জনতা পছন্দ করেন। এটা কীভাবে করেন?

এটার জন্য একটু চেষ্টা করতে হয় বৈকি। সামনের বছর আমার বয়স ৭০ হবে। ৫০ বছর হয়ে গেল লেখালেখি এবং অ্যাক্টিভিজমের, বলতে গেছে পাহাড়ের মাথায় দাঁড়িয়ে আছি অথবা অনেক প্রতিবাদী লোকের ভিড়ে কেটে গেল। আমার পথ বহু দিকে গেছে। যা আমাকে টানে না, আমি সেই দিকে যাই না।

ব্যক্তিগত সম্পর্কগুলোর জন্য আপনাকে কতটা দাম দিতে হয়েছে জীবনে এই বিষয়গুলো নিয়ে আপনি খোলাখুলি কথা বলেছেন। যেমন আপনার সঙ্গী এবং আপনার কন্যা রেবেকার সাথে আপনার বিচ্ছেদ, দূরত্ব।

আমি এটা মেনে নিয়েছি। আমি কী করতে পারি বল? আমি সেই মানুষটি, যেকোন কারণেই হোক, যে পুরো মানবতার জন্য নিজেকে সঁপে দিয়েছি। হ্যাঁ আমি এটা করেছি। আমার কোনো ব্যবহারে কেউ যদি কষ্ট পায় বা কারু যদি কোনো ক্ষতি হয়, আমি গভীরভাবে অনুশোচনা প্রকাশ করি। আমার ভেতরের যে শক্তিটা আছে তাই দিয়ে আমার পক্ষে যা করা সম্ভব তার সবটুকু করতে আমি সর্বোচ্চ চেষ্টাটা জারি রাখি।

এখন কী নিয়ে কাজ করছেন?

দুটো বই লিখছি। একটা হল The Cushion in the Road। এটি একজন ধ্যানস্থ বা নির্জনতাপ্রিয় মানুষকে নিয়ে যে বাড়িতে থাকতে পছন্দ করে। বাড়িতে আমার একটা কুশন আছে, যেটাতে আমি বসি। তারপর আবার পৃথিবী আমাকে ডাকে, আমি চলে যাই।

আরেকটা?

এটা একটা কবিতার বই, নাম- The World Will Follow Joy। বইটা শুরু হচ্ছে দালাই লামাকে নিয়ে লেখা একটা কবিতা দিয়ে, নাম- “What Makes the Dalai Lama Lovable?” (হাসি)

আপনি কি এখনও লিখে অনেক আনন্দ পান?

যদি তা নাই হত, তবে কেন আমি লিখতাম? এটা শুধুই আনন্দ, আর কিছুই না। মানুষ এটাই ভুলে গেছে যে এই দুনিয়াটা আসলে আনন্দের জন্য।

আপনার কথা শুনে আপনাকে একজন ভীষণ আনন্দময় মানুষ মনে হচ্ছে।

হ্যাঁ, তাই তো। কেন নয়?