আমার নারীবাদী হয়ে ওঠার কারণগুলো…
প্রিয়া দেব।। আজকাল নারীবাদ বিষয়টা কিছু পুরুষ ও নারীর কাছে বড় বেশি হাসি তামাশার বিষয়। যেকোনো বিষয়ের গভীরে না গিয়ে নারীবাদ এবং নারীবাদীকে গালাগালি করলে আমাদের সমাজে বিশাল রকমের জ্ঞানী হিসেবে নিজেকে জাহির করা যায়। মেয়েরা ভাবেন, নারীবাদী মেয়েগুলোকে গালিগালাজ করে, নারীবাদ কোনো কাজের বিষয় না এমন একটা মন্তব্য ছুড়ে দিলেই এই পুরুষকেন্দ্রিক সমাজে জাতে ওঠা যায়।
তো তাদের চিন্তা তাদের কাছে, আমি এমন চিন্তা দেখেই বড় হয়ে উঠেছি। জীবনের উনিশ বছর চলে গেছে এবং বয়সের তুলনায় অগনিত অভিজ্ঞতা নিয়ে আমি বেড়ে উঠেছি। তো বিষয় হচ্ছে আমি এমন এক সমাজ ব্যবস্থায় বড় হয়ে উঠেছি যেখানে নারীবাদ এবং নারীবাদী শব্দ দুটো মানেই গালাগালির অবাধ সুযোগসুবিধা। আগে নারীবাদী মাত্রই “বেশ্যা” গালিটা বড়ো বেশি পরিচিত ছিল, কিন্তু এ দেশে নারীবাদ সে গালির তোয়াক্কা না করেই এগিয়েছে বলে এখন “বেশ্যা” গালি দেওয়ার আগে সুশীলেরা কিছু নির্দিষ্ট গুণের অধিকারী নারীকে চিহ্নিত করেন, যেমন যে নারীবাদী মহিলা বিদেশে থাকেন, কানে বড়ো দুল পড়েন, কপালে মোটা টিপ দেন, স্বাধীন জীবনে বিশ্বাসী এমন নারী। আর কোনো পুরুষ নারীবাদী হলে তো কথাই নেই, তখন সে পুরুষ বিশেষ সুবিধা নেওয়ার স্বার্থে নারীবাদকে সমর্থন করছেন, এমন ধারনা করে সোস্যাল মিডিয়ায় বিপ্লব করে ফেলা হয়। আমি এরকম নর্দমাতেই বড়ো হয়েছি। এরকম নর্দমাতে বড়ো হওয়ার পরও আমি নারীবাদ সমর্থন করি। এখন প্রশ্ন আসতে পারে কেন করি?
নারীবাদকে সমর্থন করার জন্য আমাকে কোনো খ্যাতনামা নারীবাদী কিংবা সাহিত্যকে অনুসরন করতে হয়নি, বেগম রোকেয়ার রচনাবলী সম্পূর্ণ পড়তে হয়নি কিংবা বিশিষ্ট কোনো নারীবাদীর ব্লগ রেগুলার পড়তে হয়নি। আমাকে শুধু ছোটোবেলা থেকে দেখে আসা দৈনন্দিন জীবনকে নিয়ে গভীরভাবে ভাবতে হয়েছে। আমি শৈশব থেকে দেখে এসেছি ঘরে নারীরা রান্না করবে সেটাই নিয়ম। আমার দূরসম্পর্কের এক বোন এবং তার স্বামী দুজনেই স্কুল শিক্ষক, কিন্তু স্কুল শেষে বাড়ি ফিরে পশুর মতো পরিশ্রম করে রান্না করা, ঘর পরিষ্কার করা, বাচ্চাদের খাওয়ানো সব আমার বোনের দায়িত্ব আর তার স্বামী বাজারে বসে চা খেতে খেতে আড্ডা দিয়ে ঘরে এসে রাতের খাবার খেয়ে টিভি দেখতে দেখতে ঘুমিয়ে যাবে সেটা স্বামীর অধিকার। আমি আশেপাশের প্রতিটা সংসারে এমন দেখেছি, আমি বুঝতে পারিনি কখনো কেন নারীই একা এসব কাজ করবে? কেন পুরুষের জন্য রান্না এবং সংসারের কাজটা শুধু শৌখিনতা, কেন সেটাও তার দায়িত্ব নয়? যদি স্ত্রী শুধু গৃহবধূ হয় তবে তাকে বিয়ে করে আনাই হয় গৃহবধূ বনাম গৃহকর্মী হিসেবে, সেই ক্ষেত্রে তার বেগার খাটনির বিনিময়ে তাকে খেতে দেওয়া হয়, কাপড় দেওয়া হয়, সামাজিক সম্মান দেওয়া হয় এবং অদ্ভুত নিয়মে একজন বেকার পুরুষকে সেভাবে বিয়ে দিয়ে গৃহকর্মে নিয়োগ দেওয়া হয় না কারণ ঘরের কাজ তো নিম্নমানের, সুপিরিয়র পুরুষেরা সেসব করে হাত নষ্ট করেন না, কিন্তু একজন চাকুরিজীবী নারীর ক্ষেত্রেও বিষয়টা কী করে সমান হয়?
কেন একজন চাকুরিজীবী নারীকেও সেই পশুর মতো পরিশ্রম করে যেতে হয়? উত্তরটা সহজ “ঘরের কাজ, সন্তান পালনসহ সব সংসার সংক্রান্ত কাজ একমাত্র নারী করবে” এমনটাই নিয়ম। এবং এরকম অন্যায় নিয়মই আমাকে প্রথমে “নারীবাদ” সমর্থন করতে শেখায়।
যখন বান্ধবীরা চাকুরিজীবী, বিয়ে করতে না চাওয়া কিংবা নিজের পছন্দে বিয়ে করা মেয়েটিকে নিয়ে টিটকারি দিতো, চরিত্রে সমস্যা আছে বলতো, কিংবা বড় পোস্টে চাকরি করা মেয়েকে শরীর বিক্রি করে পোস্টিং পেয়েছে বলে মতামত দিতো কিংবা সন্তান পালনে একার ভূমিকা অস্বীকার করে স্বামীর সাহায্যে চাওয়া ক্যারিয়ার ফ্রিক মেয়েটাকে নিয়ে নোংরা কথা বলতো; অন্যদিকে নিজের পায়ে দাঁড়ায়ে যাওয়া, ভালো চাকরি করা কিংবা বিয়ে করতে না চাওয়া পুরুষকে মহাপুরুষের আসনে বসাতো, তখনই আমার মনে হয়েছিলো “নারীবাদ” নামক আদর্শের বড়ো বেশি দরকার।
রাস্তায় বের হলে পুরুষের ধাক্কা, যৌন নিপীড়ন সহ্য করতে করতে বড়ো হতে হয় আমাদের, এবং বলা হয় সেটাই স্বাভাবিক, নিজে সামলে চলো, আত্মীয় স্বজনের দ্বারা নিপীড়নের শিকার হলে বলা হয় তুমি নিজেকে লুকিয়ে চলতে শেখোনি, সমস্যাটা মেয়ে তোমার। ধর্মে বলা একাদশী, ব্রত, পুজো সব নারী তোমাকে করতে হবে, শিব চতুর্দশীতে শিবের মতো বর তোমাকেই চাইতে হবে, শিব তোমার মতো স্ত্রী পাওয়ার সাধনা কখনো করবে না। ধর্মের লেবাসে সতী তোমাকেই হতে হবে, ধর্মগ্রন্থ সতীর কোনো পুংলিঙ্গ রাখেনি কখনো। এরকম দেখে দেখে বড় হওয়া আমাকে কেউ শেখায়নি নারীবাদী হতে। আমি নিজেই বুঝতে পেরেছি এ সমাজ একপাক্ষিক, এ সমাজ নষ্ট, এ সমাজ মানুষের সম্মান নারীকে দেয়নি, আর যতদিন নারী আওয়াজ তুলবে না ততোদিন দেবেও না। আইনের ছাত্রী হিসেবে জুরিসপ্রুডেন্স পড়তে গিয়ে যখন “নারীবাদ” নিয়ে পড়ি, যখন দেখি সে সময়ে নারীকে পুড়িয়ে মারলেও কোনো বিচার হতো না, তখন মনে হয় আওয়াজ দরকার।
যে আওয়াজ দিয়ে একদিন নারী প্রমাণ করেছিলো সে পশু না, সে আওয়াজকে তীব্র করেই তাকে বোঝাতে হবে “নারী মানেই মানুষ”। যে সমাজ ভাবে নারীর চেহারা খারাপ হলেই, প্রেমিক ছেড়ে গেলেই নারী “নারীবাদী” হয়, সে মূর্খের সমাজে “নারীবাদ” কে তীব্র হতেই হবে।
পরবর্তীতে আমার পড়াশুনা বেড়েছে, নারীবাদকে ক্ষুদ্র হলেও জানা হয়েছে, ভাবনা বেড়েছে। বহু নারীবাদী নারী পুরুষের স্বাধীনতা অর্জনের গল্প অনুপ্রেরনা দিয়েছে কিন্তু “নারীবাদকে” সমর্থন করা আমার নিজের জীবন আমাকে শিখিয়েছে।
আমি আগে নিজেকে “মানুষবাদী” বলতাম, কিন্তু এখন মনে হয় যে সমাজে নারীকে মানুষই ভাবা হয়না সে সমাজে মানুষবাদী হওয়াটা বড় বেশি হাস্যেকর। একদিন নিজেকে সত্যি সত্যি “মানুষবাদী” ভাবার জন্য হলেও “নারীবাদ” দরকার। নিজেকে মানুষের দামটা দেওয়ার জন্য হলেও নারীবাদ দরকার।
[ফেমিনিস্ট ফ্যাক্টরে প্রকাশিত মুক্তমত লেখকের নিজস্ব বক্তব্য]