November 10, 2024
কলামফিচার ২

নারীর সমস্যাগুলো কি পুুরুষের সমস্যা নয়?

আঞ্জুমান রোজী।। পুরুষতান্ত্রিক সমাজ মনে করে, নারীর সমস্যা শুধু নারীর। নারীর সমস্যা নিয়ে পুরুষের কিছুই করার নেই। কারণ নারীর সমস্যাকে তারা সমস্যাই মনে করে না। এমন মানসিকতা অধিকাংশ পুরুষের মধ্যে যুগ যুগ ধরে পরিলক্ষিত। নারীর সমস্যা নিয়ে মাথা ঘামানো বা সমস্যা সমাধানের পথ বের করা দেওয়া তো দূরে থাক, পুরুষগুলো অনেকসময় সমস্যাসঙ্কুল নারীর কোনো কথা শুনতেও চায়না। অথচ নারীর সমস্যা মানে একটি পরিবার, সমাজ এবং রাষ্ট্রের সমস্যা। নারীর সমস্যাকে উপেক্ষা করা মানেই হলো পরিবার, সমাজ, রাষ্ট্রকে উচ্ছন্নে ঠেলে দেয়া। এই অনুধাবনটা অধিকাংশ পুরুষের মধ্যে কাজ করে না।

নারীর সমস্যাকে গুরুত্ব না দেয়ার কারণগুলো যদি দেখি, তারমধ্যে প্রধান হলো অধিকাংশ পুরুষ নারীকে বিবেক-বুদ্ধিহীন, বিবেচনাহীন প্রাণি মনে করে। নারীকে তারা বুঝতে পারেনা। তাই এই প্রাণিটির পেছনে পুরুষ অযথা কেন সময় নষ্ট করবে! তারচেয়ে বরং এভাবেই থাকুক, এক সময় আবার সবই এমনিতে ঠিক হয়ে যাবে।  এমন ভাবনা থেকে যুগ যুগ ধরে পুরুষতান্ত্রিক সমাজ নারীকে দেখে আসছে। যার কারণে পুরুষের স্বেচ্ছাচারিতা লক্ষ্যণীয় । সেইসাথে নারীর সমস্যাও দিন দিন জট পাকাতে পাকাতে এখন মহীরুহ রূপ ধারণ করেছে। তাই ধর্ষণ থেকে শুরু করে সবরকম অপমান, অপবাদ, নির্যাতনের শিকার হচ্ছে নারী।

যখনই নারীর সমস্যা নিয়ে কথা বলতে বা প্রতিবাদ করতে কোনো পুরুষকে বলা হয় তাদের স্পষ্টত একটিই কথা,”আপনারা প্রতিবাদ করেন। এটা তো আপনাদের সমস্যা।” আমি যখন বলি “এটি একটি সামাজিক সমস্যা।” তখন সে হয়তো রূঢ় চোখে তাকাবে নাহয় সম্পূর্ণ এড়িয়ে যাবে। নারীর সমস্যাকে তুচ্ছতাচ্ছিল্য করে ছুঁড়ে ফেলে দেয়া পুরুষের এই মানসিকতাকে কী বলা যেতে পারে? অনেকসময় কোনো নারী সাহায্যের জন্য পুরুষের দ্বারস্থ হলে সেই নারীকেও অপদস্ত করে ফিরিয়ে দেয় নাহয় ভুলভাল বলে সমস্যা সমাধানের কথা বলে। তারপরেও দেখা যায় মূল সমস্যার ধারেকাছে তো যায়ই না, সমস্যা যেখানে থাকার সেখানেই থেকে যায়।

পুরুষের আধিপত্য ঠিক রাখার জন্য অনেক সময় নারীতে নারীতে যে সমস্যা হয় সেখানেও পুরুষগুলো নীরব দর্শক হয়ে পড়ে থাকে। ঘরে ঘরেই মূলত এ ধরণের সমস্যাগুলোর অবতারণা হয়। অথচ দেখা যায় কান পেতে এসব পুরুষই নিজ নিজ নারীর কথা শোনে। কানকথা শুনে শুনে অনেকসময় ইন্ধনও দিয়ে থাকে। এদিকে শাশুড়ি, বউয়ে  জায়ে, ননদে কুরুক্ষেত্র বেঁধে যায়। পারিবারিক এই সমস্যাগুলো একসময় জটিল আকার ধারণ করে পরিবারকে যেমন ধ্বংস করে তেমনি সেটি সমাজের উপরও নেতিবাচক প্রভাব ফেলে। পুরুষগুলো যে নারীর সমস্যাকে শুধু নারীর সমস্যা বলে এড়িয়ে যায়, এর ফলাফল সুদূরপ্রসারী হয়। যখন সব শেষ হয়ে যায় তখন হয়তো অনেক পুরুষ অনুধাবন করেও আর ফিরে আসতে পারে না। একটি পরিবারে যে সমস্যাই হোক না কেন, বুঝতে হবে যে এটা সবার সমস্যা। সমাধানের পথও সেভাবে খুঁজতে হবে।

এ তো গেলো পরিবারের কথা, সামজিকভাবেও অনেক নারী হেনস্তা হচ্ছে । অবশ্যই হেনস্তাগুলো করছে কিছু পুরুষ। সেক্ষেত্রে অন্য পুরুষ চুপচাপই থাকে। ভাবে, নারীঘটিত বিষয়ের মধ্যে না জড়ানোই ভালো। অথচ যে পুরুষটির মাধ্যমে হেনস্তা হলো, সেটা যে কতবড় অন্যায়, অসামাজিক কাজ করলো সেইদিকটা পুরোই ভ্রূক্ষেপ করে। এমন নীরবতা পালন করে  যে সেই অন্যায়কারী পুরুষটিকেই পরোক্ষভাবে সমর্থন দিয়ে যায়। ‘#মিটু’ আন্দোলনের সময় অনেক প্রগতিশীল পুরুষের চোখা টেপাটিপি আর মুখ টিপে হাসাহাসি দেখেছি। কত যে জঘন্য এদের মানসিকতা ভাবাই যায় না। অথচ এই পুরুষগুলিই সুযোগ পেলে নারীর সঙ্গ পাওয়ার জন্য ব্যাকুল হয়ে নানা ছুলছুতায় কাছে আসার চেষ্টা করে, তা যেমন ন্যাক্কারজনক, তেমনই অমানবিক।

কোনো পুরুষ যদি তার বউকে পিটায়, সেক্ষেত্রেও অন্য পুরুষরা নীরব ভূমিকা পালন করে। বলে, এটা তাদের ব্যক্তিগত ব্যাপার। এমনভাবেই বিষয়টা দেখে যে, এখানে অন্য পুরুষের কিছুই করার নেই। অথচ কাজটি আইনের চোখে যতটা না অন্যায় তারচেয়ে বেশি অন্যায় হিসেবে পরিগণিত হবে অমানবিক কাজ বলে। এমন অন্যায়ের প্রতিবাদ করা তো দূরে থাক, বাস্তবে দেখা যায় সেই অত্যাচারী পুরুষটির সঙ্গেই অন্য পুরুষের ভালো বন্ধুত্ব থাকে। তাছাড়া, অন্য পুরুষগুলো বিষয়টাকে এমনভাবে ট্রিট করে যাতে তাদের সঙ্গী নারীগুলোও তা দেখে ভীতসন্ত্রস্ত থাকে। অধিকাংশ পুরুষই এমন মানসিকতা বহন করে। যার ফলে নারীর কোনো সমস্যাকেই সমস্যা মনে করে না।

বর্তমানে বাংলাদেশে ধর্মীয় মৌলবাদীর উত্থানের কারণে নারী স্বাধীনতায় হস্তক্ষেপ করা হচ্ছে। চেষ্টা করা হচ্ছে নারীকে অবরোধবাসিনী করে রাখার। সভ্যতার চরম শিখরে পৌঁছে আমাদের এমন দৃশ্য দেখতে হচ্ছে। আর এই প্রতিকূল পরিস্থিতির বিরুদ্ধে দাঁড়াচ্ছে শুধু নারীরা। নারীদের আন্দোলন চলছে চূড়ান্তভাবে। হাতেগোণা কয়টা পুরুষ ছাড়া অধিকাংশ পুরুষ নারীদের এমন আন্দোলনের পাশে নেই। সেখানেও পুরুষের আপত্তিকর কথা; বিষয়টা নারীর, অতএব নারীকেই তা হ্যান্ডেল করতে হবে। এমন যদি হয় পরিস্থিতি তাহলে সেসব পুরুষ কোন মানসিকতা নিয়ে প্রগতিশীলতার কথা বলে! বলে মুক্তমন, মুক্তচিন্তার কথা! খুবই আশ্চর্যের ব্যাপার।

সভা সমিতিতে নারীর সমস্যা নিয়ে আলোচনা হয়। সেই আলোচনা সেখানেই সীমাবদ্ধ থাকে। বাস্তবে সেই আলোচনার কোনো প্রতিফলন দেখা যায় না। না দেখা যায় পরিবারে, না দেখা যায় সমাজ কিংবা রাষ্ট্রে। একাডেমিক আলোচনা দিয়ে কিছুই হবে না, যতক্ষণ না তা বাস্তবায়িত হচ্ছে। নারীকে সামাজিকভাবে আলাদা অস্তিত্ব মনে না করে মানবিক মানুষ হিসেবে সব অবস্থায় মূল্যায়ন করার মানসিকতা তৈরি হোক। নারীর লড়াই, নিরাপত্তা ও বাস্তবতা সবই সমাজের অবিচ্ছেদ্য দিক। নারীর সমস্যাকে আলাদা করে না দেখে এটাকে সামাজিক সমস্যা হিসেবে চিহ্নিত করা হোক। সমস্যা সমস্যাই, সেটা নারীর হোক বা পুরুষের হোক। সব সমস্যাই সামাজিক সমস্যা এবং সমাধানের জন্যও নারীপুরুষের সম্মিলিত প্রয়াস চালাতে হবে। এই পৃথিবীর যা কিছু সুন্দর তার সবটুকুই যে নারীপুরুষের অবদান। অতএব, নারীর সমস্যা যে শুধু নারীরই সমস্যা,  এমন ভাবনা বন্ধ হোক।

 

[ফেমিনিস্ট ফ্যাক্টরে প্রকাশিত কলাম লেখকের নিজস্ব বক্তব্য]