November 23, 2024
ফিচার ২মুক্তমত

আমার ছোট্ট বোনের প্রশ্ন- ‘ধর্ষণ কী’? উত্তরটাও শুনে যান…

প্রিথুলা মারজান।। গতদিন ছোটবোনের জন্মদিন ছিল, ও আমার কাছে আর্ট বক্স চেয়েছে (যা আম্মু দিতে মানা করে)। মোটামুটি ওয়েলঅফ ফ্যামিলিতে বিলং করি। এক কথায় ক্লাসি ফ্যামিলি। কেক নিয়ে বসে আছি, সাথে টেলিভিশনও দেখতেছি। বাসার সবাই-ই উপস্থিত ছিল।

নিউজ হচ্ছে এমসি কলেজে ধর্ষণের ব্যাপারে। সবাই মনোযোগ দিয়ে দেখছে, ছোট বোনটাও। এবার দশম বসন্ত পার করবে। হঠাৎ করে সবাইকে অবাক করে দিয়ে আমায় জিজ্ঞাসা করে উঠছে, ‘‘ভাইয়া, ধর্ষণ কী?”

বিশ্বাস করেন, বুকটা দুমড়ে মুচড়ে গেল, কেমন যেন হিরোসিমা-নাগাসাকি আমার বুক। সেখানে কেউ পারমানবিক বোমা হামলা করতেছে, বলতে গেলে এর চেয়েও বেশি কিছু। জন্মদিনের  আনন্দঘন মূহুর্ত অতর্কিতভাবে গুরুগম্ভীর সঙ্কটের মূহুর্তে পরিণত হয়ে যায়।

কেউ কোন কথা বলছে না, ছোট বোনটা আমার মুখের দিকে তাকিয়ে আছে। আমি কোনো উত্তর দিতে পারছি না, আমার মাসল অব এক্সপ্রেশনে উত্তর খুঁজতেছে সে।আমি হতভম্ব, কী উত্তর দেব। এরকম পরিস্থিতিতে কে কী উত্তর দিত আমি ঠিক জানি না।

কতক্ষণ চুপ করে থেকে আমি বোনের কপালে চুমু দিয়ে বললাম, ‘‘তোমার ইচ্ছার বিরুদ্ধে কোনো কিছু করাটাই হলো ধর্ষণ।” আমার বোন কেন জানি না চুপ হয়ে গেছে। আর কোনো কথা বলে নাই।

ধর্ষণের জন্য কে দায়ী? আমরাই দায়ী। আমরা আমাদের সামজিক অঙ্গসংগঠনকে ধর্ষণের উপযোগী করেই ইনস্ট্রুমেন্ট করেছি। সব জায়গায় ধর্ষণের সিম্পটম বিরাজ করছে, ধর্ষণ এখন মহামারী। ডুর্খেইম এর সামাজিক সমস্যা ধর্ষণ। বাবার সামনে মা কথা বলতে পারবে না, মায়ের সামনে ছেলে, ছেলের সামনে মেয়ে, বড়’র সামনে ছোট, আমলা’র সামনে কামলা, পুলিশের সামনে জনগন, রাজনীতিবিদের সামনে পুলিশ, রাষ্ট্রের সামনে রাজনীতিবিদ। এগুলা ধর্ষণ। বিশ্ববিদ্যালয়গুলাতে ধর্ষণের শিক্ষা। সিনিয়র-জুনিয়র মেইনটেইন করা ধর্ষণ, শিক্ষককে সম্মানের নামে অতিরঞ্জন ধর্ষণ, রাজনৈতিক শক্তির সামনে শিক্ষকের চুপ থাকা ধর্ষণ, অধিকারের কথা বলতে গিয়ে নির্যাতন ধর্ষণ।

হিন্দুর মেয়ে ধর্ষিত হইছে, প্রতিবাদ করবে না সবাই। টাকাওয়ালার মেয়ে ধর্ষিত হইছে, সবাই প্রতিবাদ করবে। এটা ধর্ষণ। নগরীর কুকুর বিতাড়ন, হত্যা ধর্ষণ। ট্যাগিং ধর্ষণ। অপরাধীর জন্য আইনজীবী না থাকা ধর্ষণ।

সবজায়গায় ধর্ষণ। নগরীর দেওয়ালে গ্রাফিতি আঁকতে না দেওয়া ধর্ষণ। মিছিল মিটিং করতে না দেওয়া ধর্ষণ। দেশে গনতন্ত্রের নামে স্বৈরশাসন চালানো ধর্ষণ। নারী অধিকারের নামে নারী নির্যাতন ধর্ষণ। সবকিছু এখন ধর্ষণের পর্যায়ে গেছে।

কোনো দলের কেউ কোনো খারাপ কাজ করছে, দলের নেতা কর্মীরা অপরাধীকে দলের কেউ না বলে তো পাড় পেয়ে যাবে না। আর এরকম ভাবাটাও, করাটাও সুস্থ মস্তিষ্কের কারো কাজ না। বরঞ্চ সেখানে দৃঢ় সংকল্পে বলতে হবে হ্যাঁ, অপরাধী দলের আদর্শচ্যুত হয়ছে। তার কাজ খারাপ হলে, দল থেকেই আইনী পদক্ষেপ নেবে তার বিরুদ্ধে। তা না করে আমাদের দেশে কী করা হচ্ছে? বলা হচ্ছে, ও দলের কেউ না, ও আগে অমুক দল করত, ওখানে কোনো কমিটি নাই, ওরা অনুপ্রবেশকারী ইত্যাদি। এগুলাই ধর্ষণ, হ্যাঁ।

সতেরো কোটির দেশে একজনের ইচ্ছা শাষণ, তা নিয়ে আপনার মাথা-ব্যাথা নাই। মিডিয়ায় রাষ্ট্রপ্রধানের গুনগান না করলে ফায়ার, সমালোচনা করলে সাত বছরের কারাদণ্ড, ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন করে সব সুস্থ মস্তিষ্ককে অবদমিত করে রাখা ধর্ষণ।

বারো বছর একটা দল ক্ষমতায় আছে, কারো বাক স্বাধীনতা নাই, মিডিয়া থেকে শুরু করে কর্পোরেট লাইফ সবজায়গায় হিটলারিজম/ভালগারিজম জেঁকে বসছে।তারপরেও আপনি চুপ। এটা ধর্ষণ।

সংখ্যালঘু বলা, ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠী বলা, উপজাতি বলা ধর্ষণ। তাদেরকে নিরাপত্তার নামে শোষণ করা ধর্ষণ।

পোশাক নিয়ে বিতর্ক, ভার্সিটি-স্কুল পড়া নিয়ে বিতর্ক ধর্ষণ।

সব ধর্ষণ। মব লিঞ্চিং ধর্ষণ।

‘নারীর দিকে চোখ তুলে তাকানোর মত একটা কর্মীও নাই’- বলাটা ধর্ষণ।

‘একা রাষ্ট্রপ্রধান কী করবে’- বলাটা ধর্ষণ।

ক্ষুধা হবে নিরুদ্দেশ, অমুকের বাংলাদেশ- সবজয়গায় একক ব্যাক্তির অবদান, একক ব্যাক্তির পূজা করাটা ধর্ষণ।

‘আমরা কি কিছু বুঝি না, কোনটা অপরাধ আর কোনটা কী’ বলাটার সাথে চুপ থাকাটা ধর্ষণ।

মেয়েকে ঘরে থাকার শিক্ষা দেওয়াটা ধর্ষণ। মেয়েকে পোশাকের শিক্ষা দেওয়া ধর্ষণ, মেয়েকে আস্তে কথা বলতে বলাটা ধর্ষণ। স্বাধীনতাবিরোধী হলে ধর্ষণ করার সার্টিফিকেট দেওয়াটা ধর্ষণ।

নাস্তিক, ধার্মিক, ধনী, গরিব, স্ট্রাটিফিকেশন ধর্ষণ। আসলে কি আমাদের জন্মটাই ধর্ষণ।

যে বিরোধিতা করবে সে প্লিজ বলে যান আমার বোনের প্রশ্নের উত্তর কী হবে?

আমার বোন যার এখন কার্টুন দেখার,পুতুল খেলার বয়স সে কেন প্রশ্ন করবে ধর্ষণ কী?

আমার বোন যখন বড় হবে, এ বিষয়ে জানবে তখন আমাকে যে ঘৃণা করবে না তার গ্যারান্টি কী?

আমার বোনের নিরাপত্তা কে দেবে?

আমার বোনের জন্মদিনের হাসিটা আমি কোথায় পাবো?

প্লিজ বলে যান।

 

[ফেমিনিস্ট ফ্যাক্টরে প্রকাশিত মুক্তমত লেখকের নিজস্ব বক্তব্য]