বুদ্ধিবৃত্তিক উন্নয়ন না হলে নারীর মুক্তি আসবে কি?
দুর্দানা চৌধুরী।। স্কুল গেইটে বাবা মায়ের জন্য অপেক্ষা করার সময় আমি অযাচিতভাবে অভিভাবকদের আলাপ শুনতাম। একসময় খেয়াল করলাম মা আর বাবাদের কথা বলার বিষয়বস্তুতে বিস্তর ফারাক। মায়েদের কথাবার্তা ওই ঘুরেফিরে ঘর-বর, শাড়ি আর চুড়ির মাঝে সীমাবদ্ধ। কোন দোকানের শাড়ি সুন্দর। কোথায় কম দামে ভালো বাসন পাওয়া যায় কিংবা সোনার ভরি কত হলে একজোড়া বালা বানানো যায় এ নিয়ে তাদের নিত্যদিনের আলাপ। কখনো বা কথা বলছেন কার বাচ্চা কী করছে কিংবা কোন প্রাইভেট টিউটর ভালো পড়ান। কখনো আবার হা হুতাশ করছেন বুয়া আসতে লেইট করছে এ নিয়ে। জা, ননদ, ভাসুর, বোন, দুলাভাই অর্থাৎ আত্মীয়স্বজন পাড়া প্রতিবেশির সমস্যা নিয়েই তাদের সকল আলাপচারিতা।
ঠিক উল্টোদিকে বাবাদের আলোচনার প্রধান বিষয়বস্তু ছিল দেশের রাজনীতি কোন পথে এগুচ্ছে, কে এবার ক্ষমতায় আসছেন আর কে আসলে কতটুকু সুফল সাধারন জনগন পাবেন। দেশের গণ্ডি পেরিয়ে আন্তর্জাতিক সমস্যা নিয়েও দেখেছি তাদের বিস্তর আলাপ। এর বাইরেও যার যার পেশাগত জায়গা থেকে সমাজের সমস্যা আর সম্ভাবনা নিয়ে নিজেদের দৃষ্টিকোণ থেকে ব্যাখ্যা করার চেষ্টা করছেন সবাই। চাকরির বাজার, বেকার সমস্যা, এতো বিশাল জনগোষ্ঠী নিয়ে কোথায় যাওয়া যায় এসব হয়ে উঠেছে নিত্যদিনের আলাপ। বড়জোর শুনতাম কোথায় কম দামে ভাল ফ্ল্যাট-প্লট বিক্রি হচ্ছে কিংবা ইন্সটলমেন্টে গাড়ি কোথায় পাওয়া যায় এ বিষয়ে!
স্কুল গেইটে দাঁড়ানো বিভিন্ন শ্রেণি পেশার এসব অভিভাবকদের আলোচনার বিষয়বস্তু থেকে এটাই স্পষ্ট যে নারীরা বড্ড ঠুনকো বিষয় নিয়ে মাথা ঘামাচ্ছেন যুগ যুগ ধরে। অথচ এই বিষয়গুলো আলোচনার দাবি পর্যন্ত রাখে বলে আমার মনে হয় না! এসব অভিভাবকদের অনেকেই শিক্ষিত। কিন্তু তারপরও সমাজ নিয়ে তাদের ভাবনা কোন মেয়ে ওড়না পরলো না আর তাতে কার ছেলে নষ্ট হয়ে গেল সেই পর্যন্তই। মেয়ে হয়ে মেয়েদের প্রতি আমার সবচেয়ে বড় অভিযোগের জায়গা হচ্ছে মেয়েরা ভাবনার জায়গায়, জ্ঞানের পরিধিতে তার চেয়েও বড় কথা জানার আগ্রহে অনেক অনেক পিছিয়ে আছেন পুরুষের চেয়ে। দেশ সমাজ চারিপাশের চেয়ে শাড়ির পাড়ে লাগানো জরির প্রতি তাদের আগ্রহ বেশি। বেসন মুখে মাখলে কী হয় তারা জানেন কিন্তু ডালের বাজার হুট করে এতো চড়া কোন সিন্ডিকেটের কারসাজিতে, সে নিয়ে ভাবার মত জ্ঞান কিংবা ইচ্ছা তারা রাখেন না। নারীদের মানসিকতাই এমনভাবে তৈরি হয়েছে। নিউজপেপার সক্কাল বেলা এলেই বাবা’রা ভাজ খোলেন। মায়েো দিনশেষে সুযোগ পেলে খবরের কাগজের হয়তো পাতা উল্টান। কিন্তু বেশিরভাগ সময় সাথে থাকা ম্যাগাজিনই বেশি প্রাধান্য পায়। চাকরি কিংবা ঘর সামলিয়ে কজন বই পড়েন সে নিয়ে আমার ঘোর সন্দেহ আছে। দু’একজন বইয়ের সংস্পর্শে এলেও তা চোখের জল একাকার করে ফেলা ঘর বর নিয়ে লেখা উপন্যাসেই সীমাবদ্ধ। সিনেমা দেখলেও কাস্টিং, স্টোরি কিংবা সিনেমাটোগ্রাফি বাদ দিয়ে নায়িকা কী পোশাক পরল তা নিয়ে হইচই হয়। আমি খুব কম মেয়ে দেখেছি যারা একটা সিনেমার প্রশংসা করতে গিয়ে এর শৈল্পিক দিকে আলোকপাত করেছে। খুব কম মেয়ে দেখেছি যারা শিল্প সাহিত্যের প্রতি সত্যিই আগ্রহী! স্টারি নাইট দিয়ে শাড়ি ব্লাউজ পরা নারীর চেয়ে ভ্যান গগের অসাধারন পেইন্টিং সম্পর্কে জানা আর উপলব্ধি করা নারীর সংখ্যা নেহাত কম। মাঝরাতে আবুল হাসান কিংবা রুদ্র নিয়ে আলোচনা করার জন্য আমি আগ্রহী অনেক পুরুষ পেয়েছি কিন্তু আফসোস কোনোদিনই কোনো নারীর সাথে কমলা রঙের রোদ কিংবা আট বছর আগের একদিন নিয়ে আলোচনার সুযোগ হয়নি আমার!
চা বাগানে গিয়ে মুগ্ধ হওয়া আমরা ক’জন নারীই বা ভেবেছি চা বাগানের মানুষের উপর শত বছর ধরে চলে আসা নিপীড়নের কথা। ক’জন বা জানি এদের বিহার উড়িষ্যা থেকে যে স্রেফ ভয় দেখিয়ে আর ভুল বুঝিয়ে এই দাসত্বের জীবনে আনা হয়েছে তার কথা। পতিতা শব্দ শুনে নাক সিঁটকানো আমরা ক’জন এর নেপথ্যের প্রকৃত গল্প জানতে পেরেছি। ক’জন চেয়েছি তাদের সাহায্যে এগিয়ে আসতে। আগামী একশো বছর পর পৃথিবী বাসযোগ্য থাকবে কি না সে নিয়ে আমি কোনদিন নারীমহলে আলোচনা শুনিনি। আমি খুব কম নারীদের আগ্রহ দেখেছি রাজনীতিতে। পুঁজিবাদ নিয়ে আলোচনা মেয়েদের মুখে শুনিনি কখনো। সমাজতন্ত্র কী বা কেন এ নিয়ে আমার মনে হয় যতজন মাথা ঘামায় তার মাঝে দশ শতাংশও নারী নেই। সম্প্রতি মার্কিন নির্বাচন নিয়েও নারীদের মাথাব্যাথা দেখিনি আমি। তারা ওই শাড়ির কুচি ঠিক করতেই ব্যস্ত ছিলেন।
এসব কথা বলছি, কেন বলছি? তার একটাই উত্তর পুরুষতান্ত্রিক এই সমাজ আমাদের এই মূর্খতা এই অজ্ঞতার সুযোগ নিচ্ছে। পুরুষশাষিত এই সমাজে যথাযথ যোগ্যতা নিয়ে মাথা উঁচু করে দাঁড়ানোই যেখানে দায় সেখানে মেধায় মননে পিছিয়ে থেকে কীভাবে নিজেদের মর্যাদা প্রতিষ্ঠা হবে! বুদ্ধিভিত্তিক অগ্রগতি আমাদের খুব জরুরি। ভাবুন, চারপাশ দেখুন আর যতটা পারেন জ্ঞান অর্জন করুন। সভ্যতার শুরু থেকে কিন্তু জ্ঞানীরাই এগিয়ে আছেন। আপনার শাড়ি চুড়ি’তে আগ্রহ থাকতেই পারে কিন্তু সেটা যেন প্রকৃত সমস্যাগুলোর প্রতি আপনার আগ্রহকে ছাড়িয়ে না যায়। মনে রাখবেন, মেধায় মননে পাল্লা দিতে না পারলে শত আন্দোলন করলেও নারীমুক্তি কোন দিনই আসবে না।
[ফেমিনিস্ট ফ্যাক্টরে প্রকাশিত মুক্তমত লেখকের নিজস্ব বক্তব্য]