লড়তে হবে লক্ষ চিত্রাঙ্গদাকে একসঙ্গে
ইমতিয়াজ মাহমুদ।। যমুনা টিভির ওয়েবসাইটে এ মাসের একুশ তারিখ এসেছে খবরটা। নারায়ণগঞ্জের রূপগঞ্জ উপজেলার ভুলতায় কামাল নামে এক যুবক ওর ২৬ দিনের শিশু কন্যাকে আছড়ে হত্যা করেছে। কামাল বিয়ে করেছে বছর দুয়েক হবে, শিশু মীম ওদের প্রথম সন্তান। প্রথম সন্তান কন্যা হোক এটা কামাল চায়নি— তবুও মীম পিতার ইচ্ছার বিরুদ্ধে কন্যা হয়েই জন্মেছে। এটাই ছিল ওর অপরাধ, কন্যা হয়ে জন্মেছিস কেন? মীমের জন্ম থেকেই গজগজ করছিল কামাল, পুত্র হলো না কেন। সেদিন একটু বেশিই কাঁদছিল মীম— মীমের পিতা ওকে তুলে এমন আছাড় মেরেছে, মীমের ছাব্বিশ দিনের জীবন সেখানেই শেষ। নারী হয়ে জন্মের অপরাধে জীবন দিয়েছে শিশুটি।
মর্মান্তিক খবর বটে, কিন্তু অভিনব খবর কি? না। এটা কোনো অভিনব খবর নয় বা ব্যতিক্রমী ঘটনা নয় বা অপ্রত্যাশিত কোনো হত্যাকাণ্ডও নয়। তিনটা পুরনো খবর দিই। ২০১৭ সালের ৪ আগস্ট তারিখের ডেইলি স্টারে এসেছে খবরটা। নারায়ণগঞ্জে একজন পিতা তার ঘুমন্ত কন্যার গায়ে পেট্রোল ঢেলে আগুন জ্বেলে দিয়েছে, আগুন জ্বালিয়ে ঘরের ফ্যান চালিয়ে দিয়েছে যেন আগুনটা ঠিক মতো জ্বলে। মা বাঁচাতে চেয়েছিল বাচ্চাটাকে, পিতা তাকেও আটকে রেখেছে। কেন এই ঘটনা? বাচ্চার বাপ চায়নি তার সন্তানটি কন্যা হোক। একই বছর জুনের ৯ তারিখে ঢাকা ট্রিবিউনের খবর— খুলনার সাতক্ষিরায় পনের দিনের শিশু কন্যাকে পুকুরে ছুড়ে ফেলে হত্যা করেছে তার পিতা। কেন? সে একটি পুত্র চেয়েছিল, পুত্র না হয়ে জন্মেছে কন্যা। কন্যা সে চায়না, কন্যার জন্মে সে বিরক্ত, তাই তাকে জলে ছুড়ে ফেলে দিয়ে হত্যা করেছে। ২০১৬ সালের মার্চের ২ তারিখের ইন্ডিপেন্ডেন্টের খবর— তিন মাসের শিশু কন্যার মুখে বিষ ঢেলে দিয়ে তাকে হত্যা করেছে শিশুটির পিতা। হাতের কাছে ছিল বলে এই কয়টা তথ্যই দিচ্ছি এখানে। আপনি যদি চান তাইলে এই বছরের খবরের কাগজ ঘেঁটে দেখতে পারেন, বা তার আগের বছরেরগুলো বা তার আগের বছরের— আমি নিশ্চিত করে বলতে পারি, কন্যা শিশু হত্যার এরকম খবর অনেক পাবেন।
এরকম খবরে আমাদের প্রথম প্রতিক্রিয়া কী হয়? ক্রোধ হয়, শোক হয়, বিবমিষা হয়। আমাদের মনে হয় যে, এরকম পাষণ্ড মানুষ কী করে হয় ইত্যাদি। কিন্তু আপনি কি কখনো ভেবে দেখেছেন যে, এইসব হন্তারক পিতা যে চিন্তা থেকে বা যে মূল্যবোধ থেকে ওদের কন্যাকে শৈশবেই হত্যা করে আপনি বা আপনার আশেপাশের বেশিরভাগ মানুষই একই চিন্তা বা একই মূল্যবোধ ধারণ করে। আপনারা সকলেই হয়তো কন্যা শিশুকে হত্যা করেন না— কিন্তু কন্যা শিশুকে চাই না, পুত্র চাই এই প্রবণতা তো দুই একজন বাদ দিলে আপানদের সকলের মধ্যেই আছে। যে লোকটি তার কন্যা শিশুটিকে হত্যা করছে তার সাথে সেই পিতার কী পার্থক্য, যে পিতা সন্তানটি পুত্র না হয়ে কন্যা হয়েছে বলে মনের দুঃখে কাঁদে বা হতাশ হয়ে থাকে? পার্থক্যটা কেবল মাত্রাগত পার্থক্য— মৌলিক কোন পার্থক্য নেই। নারীর প্রতি বিদ্বেষ একজনের একটু কম আর আরেকজনের একটু বেশি, এই-ই হচ্ছে এই দু’জনের পার্থক্য।
এরকম লোক আপনি মাঝে মাঝেই দেখতে পাবেন। বিশেষ করে আপনার যদি পুত্রসন্তান না থাকে। দেখবেন যে, এইসব লোক এসে আপনাকে পরামর্শ দেবে, আরেকটা সন্তান নাও, পুত্র থাকতে হয় ইত্যাদি। কেউ কেউ কেউ আপনাকে তাবিজ দোয়া বা নানারকম টোটকা শেখাবে— কী করিলে পুত্রসন্তান লাভ হয়। আমাকে বলতে পারেন, এইসব লোকের সঙ্গে কন্যা সন্তান যারা হত্যা করে ওদের কী পার্থক্য? ওই যে আগে বলেছি, মৌলিক কোনো পার্থক্য নেই, পার্থক্যটা নিতান্ত মাত্রাগত। এটাই হচ্ছে পিতৃতন্ত্র বা পুরুষতন্ত্র বা পুরুষবাদ। পুরুষতন্ত্র নারীকে পুরোপুরি মানুষ মনে করে না। পুরুষতন্ত্রের চোখে নারী হচ্ছে অপূর্ণ মানুষ বা ঊনমানুষ। আপনার যদি পুত্র সন্তান না থাকে তাইলে পুরুষতন্ত্রের দৃষ্টিতে আপনার কোনো উত্তরাধিকারী নেই বা আপনার আসলে পূর্ণাঙ্গ কোনো সন্তানই নেই। কন্যা সন্তান তো পুরোপুরি মানুষ নয় ওদের চোখে।
এই সমস্যা নতুন কোনো সমস্যা নয়— এটা একটা অনেক পুরনো দৃষ্টিভঙ্গি। এটা শুরু হয়েছে সেদিন থেকে যেদিন নারীকে পুরুষ বন্দী করেছে ঘরে গৃহকর্মী হিসেবে। যখন থেকে ব্যক্তিগত সম্পত্তির শুরু হয়েছে, যখন থেকে মানুষ নিজেদেরকে রাষ্ট্র নামক সংঘ তৈরি করতে শুরু করেছে তখন থেকেই পুরুষতন্ত্রের সূচনা। তখন থেকেই নারীকে আমরা পরিণত করেছি পুরুষের অধীন একটি প্রাণী হিসেবে। তখন থেকেই নারীকে আমরা পরিণত করেছি আমাদের মালিকানার বস্তু হিসেবে, আমাদের ভোগের বস্তু হিসেবে। সমাজ বিকাশের ধারায় একদিন সেই আদিম রাষ্ট্র ব্যবস্থা সংগঠিত সামন্তবাদী রাষ্ট্র হয়েছে, সামন্তবাদের বিনাশ করে পুঁজিবাদের বিকাশ ঘটেছে। এই পরিক্রমায় নারীর মর্যাদা পুরুষের মালিকানাধীন গরু ছাগল বা পোষা পাখির অবস্থান থেকে উন্নত হয়ে আধুনিক পণ্য হয়েছে। পুরুষের সমান মানুষ আমরা নারীকে আর হতে দেইনি। নারী এখনো পুরুষের অধীন, নারী এখনো পুরুষের মালিকানাধীন।
কেউ কেউ এসে আপনাকে বলবে যে, না, এই যে দেখো আমাদের ধর্মে আমরা নারীকে দিয়েছি মহান মর্যাদা, নারীকে তুলনা করেছি আমরা মহা মূল্যবান মনি মাণিক্যের সঙ্গে। নারীর মর্যাদা রক্ষার জন্যেই আমরা নারীর জন্যে ঢাকনির ব্যবস্থা করেছি। এগুলো হচ্ছে ফালতু বাত। মানুষকে আপনি মনি মাণিক্য বা মহামূল্যবান পণ্যের সমান বলছেন, সেটাতে মর্যাদার কী আছে? সুস্বাদু খাবার মনে করে নারীকে আপনি ঢেকে রাখতে চান, সেটাতে মর্যাদার কী আছে? এরকম মর্যাদার কারণেই তো এসব পিতারা (এমন কী কখনো কখনো মায়েরাও) মহামূল্যবান মনি মাণিক্যরূপী কন্যা সন্তান চায় না। সন্তান হিসেবে ওরা চায় পূর্ণাঙ্গ মানুষ- ওদের চোখে কেবল ব্যাটাছেলেই হতে পারে যোগ্য সন্তান, পূর্ণাঙ্গ মানব সন্তান।
এই যে কন্যা সন্তানকে যারা হত্যা করছে ওদের অবশ্যই বিচার করতে হবে, শাস্তি দিতে হবে। আমাদের এখানে এরকম ঘটনা হরদম ঘটছে। ভারত সহ কিছু কিছু দেশে এইরকম ঘটনা আরও বেশি ঘটে। ভারতে তো একটা প্রবণতা আছে যে, ভ্রূণ অবস্থায়ই ওরা চেষ্টা করে ভ্রূণের লিঙ্গ নির্ধারণ করতে। আর যদি দেখে যে গর্ভের সন্তানটি নারী শিশু হবে, তাহলে চেষ্টা করে সেটাকে গর্ভেই শেষ করে দিতে। এদের তো বিচার করতে হবে, শাস্তি দিতে হবে। শিশু হত্যার জন্যে আমাদের দেশে আইন আছে, ভারতেও আছে, মোটামুটি সব দেশেই শিশু হত্যার জন্যে শাস্তি আছে। কিন্তু শাস্তি দিয়ে কি আপনি এই প্রবণতা বন্ধ করতে পারবেন? জ্বি না জনাব। পারবেন না। আর যদি মানুষকে কন্যা শিশু হত্যা থেকে নিবৃত্তও করতে পারেন, কন্যা শিশুর প্রতি ওদের দৃষ্টিভঙ্গি পালটাবেন কী করে? প্রচলিত আইন, প্রচলিত বিচার ব্যবস্থা এসব দিয়ে আপনি কন্যা সন্তানের মর্যাদা উদ্ধার করতে পারবেন না। কেননা কন্যা সন্তানের প্রতি এরকম বিদ্বেষ পিতৃতন্ত্র বা পুরুষতন্ত্র থেকে উদ্ভূত এবং বিদ্যমান সমাজ কাঠামো দ্বারা লালিত পালিত ও উদযাপিত, এই সমাজ ব্যবস্থা যতদিন থাকবে ততদিন পর্যন্ত নারীর প্রতি বৈষম্য, নারীকে ঊনমানুষ বিবেচনা করা, নারীকে পণ্য বিবেচনা করা এসবও ততদিন থাকবে।
পুরুষতন্ত্র বা পিতৃতন্ত্রের নারীর প্রতি এই বিদ্বেষ বা বৈষম্যের বহিঃপ্রকাশ হচ্ছে এসব, চূড়ান্ত মাত্রা হচ্ছে কন্যাশিশুকে একদম হত্যা করে ফেলা। আর মধ্যম বা ন্যূনতম মাত্রা হচ্ছে প্রতিদিনের জীবনে নারী সন্তানকে পুরুষ সন্তানের তুলনায় কম গুরুত্ব দেওয়া। আপনি যদি এসব দূর করতে চান তাহলে আপনাকে কী করতে হবে? ভেঙে ফেলতে হবে পুরুষতন্ত্র, বা পিতৃতন্ত্র উৎখাত করে ফেলতে হবে। পুরুষতন্ত্র কিভাবে উৎখাত করবেন? সমাজের যে মৌল কাঠামো, ব্যক্তিগত সম্পত্তিভিত্তিক সমাজ, সেটা ভেঙে একটা সমতাভিত্তিক বৈষম্যহীন সমাজ গঠন করতে হবে। এ ছাড়া কোনো বিকল্প নেই।
এমনিতে আপনি ব্যক্তিগত পর্যায়ে পুরুষতান্ত্রিক সংস্কৃতি থেকে বেরিয়ে আসার চেষ্টা করতে পারেন। সীমিত আকারে একজন নারী হয়তো পুরুষতন্ত্রকে অস্বীকার করে স্বাধীন জীবন যাপন করতে পারে। লক্ষ কোটি মানুষের মধ্যে একজন নারী বা একটি পরিবার হয়তো ব্যতিক্রম হিসেবে জীবনযাপনও করতে পারে— সেটাও সীমিত পরিসরে সম্ভব। রবীন্দ্রনাথের চিত্রাঙ্গদার উদাহরণ দিই। মনিপুর রাজের ভক্তি ও উপাসনায় মুগ্ধ হয়ে শিবঠাকুর বর দিয়েছিলেন যে তার বংশে কোনো নারীর জন্ম হবে না, কেবল পুরুষ সন্তানের জন্ম হবে। দেবতার সেই বর ভঙ্গ করে রাজকুমারী চিত্রাঙ্গদার জন্ম। রাজা কন্যা সন্তানের জন্ম সহজভাবে মেনে নেননি, রূপগঞ্জের ওই কামালের মতো রাজকন্যা চিত্রাঙ্গদাকে তিনি তাই বলে আছড়ে হত্যা করেননি। রাজা তার কন্যাকে পুত্রজ্ঞানে বড় করেছেন, যুদ্ধবিদ্যা শিখিয়েছেন, চিত্রাঙ্গদা পুরুষের পোশাক পরেছে, পুরুষের সঙ্গে সমান তালে পাল্লা দিয়ে তলোয়ার চালিয়েছে, তীর চালিয়েছে, যুদ্ধ করেছে। কিন্তু চিত্রাঙ্গদা কেবলই একটা ব্যতিক্রম হয়েই থেকেছেন। চিত্রাঙ্গদার সকল শৌর্যবীর্য তাকে মহিমান্বিত করেছে বটে, কিন্তু বাস্তব অবস্থার তাতে কোনো পরিবর্তন হয়নি।
চিত্রাঙ্গদার বাস্তব অবস্থা কী? শিব ঠাকুরের বরটি লক্ষ্য করুন— ‘তোমার বংশে কোনো কন্যা জন্ম নেবে না’ এটা হচ্ছে বর! কন্যা জন্ম নেবে না এটা হচ্ছে আশীর্বাদ! তাহলে কন্যা জন্ম নেওয়াটা কী দাঁড়ায়? কন্যা জন্ম নেওয়া যেন একটা অভিশাপ।
এটাই বাস্তবতা। এই বাস্তবতা একজন চিত্রাঙ্গদার বিদ্রোহে বদলে যায় না। এটা বদলানোর জন্যে লক্ষ চিত্রাঙ্গদাকে এক হয়ে লড়তে হয়, লড়তে হয় সমাজ বদলের জন্যে। সেই লড়াইয়ে যেদিন আমরা জিতব, কেবল সেইদিনই কামালরা আর কন্যার জন্মকে অভিশাপ মনে করবে না।
[ফেমিনিস্ট ফ্যাক্টরে প্রকাশিত কলাম লেখকের নিজস্ব বক্তব্য]