November 2, 2024
কলামফিচার ৩

ক্ষমতায়নে থাকা নারীর প্রতি আচরণ: যুদ্ধটা অবস্থান গড়ার

ক্যামেলিয়া আলম।। দি ওয়াইর অনলাইন পত্রিকার ২২শে ডিসেম্বরের এক খবরে চোখ আটকে গেল। কর্ণাটকের বিচারপতি বি. ভি. নাগারত্ন হাইকোর্টে জোড়ালোভাবে বললেন যে, ভারতীয় সমাজ জানে না ক্ষমতায় থাকা নারীর প্রতি কী আচরণ করা উচিৎ। তার ভাষাতেই জানাই। এক ডিভোর্সের মামলা শুনানি পর্বে তিনি বলেন, ‘‘ভারতীয় সমাজ সব সময়েই নারীকে অধস্তন হিসেবে দেখে। পুরুষতান্ত্রিক দৃষ্টিভঙ্গির সমাজ আমাদের। এদেশের জনগণ নারীর ক্ষমতায়নের কথা সবসময়ই বলে, অথচ ক্ষমতায়নে থাকা নারীর প্রতি আচরণ তারা করতে জানে না ।’’

ভারতীয় সমাজের থেকে খুব বেশি দূরে না বাংলাদেশের সমাজ। আর বলা ভুল হবে না যে, এই দেশের নারীরাও একই পরিস্থিতির শিকার। এ নিয়ে কথা বলতে গিয়ে উনবিংশ শতকের একজনের গল্প বলি আগে। গ্রামের এক সম্ভ্রান্ত মুসলিম পরিবারে জন্ম নেয় এক মেয়ে। সে যুগে মুসলিম সমাজের একজন মেয়েকে পড়াবার কথা কল্পনা করাও ছিলো ভয়ংকর। কিন্তু কোন এক অমোঘ টানে ভাইগুলোর ইংরেজি স্কুলে পড়ার সুবাদে বোনদের পড়াবার ব্যাপারে ভাইদের, বিশেষ করে বড় ভাইয়ের আগ্রহ ছিলো অসীম। বাবার আড়ালে লুকিয়ে পড়ানোর চেষ্টা করিয়েও লাভ হল না, ধরা পড়ে গেলে বড়বোনকে নানাবাড়ি পাঠিয়ে দিয়ে বিয়ের ব্যবস্থা করে। বিয়ে হয়ে গেলে বড়বোন এবার ছোটবোনকে নিয়ে কিছুদিন ইংরেজি শিক্ষার আয়োজনও করেন গভর্নেস রেখে। খুব বেশিদিন আর পড়তে পারলো না। এর মাঝে বিপত্নীক এক ব্যক্তির সাথে বিয়ে হয়ে গেলে তা একদিকে আশীর্বাদ হয়ে দেখা দেয় মেয়েটির জীবনে।

ধীরে ধীরে মেয়েটি সাহিত্য জগতে পা ফেলে, প্রচলিত সমাজের ঘুনে ধরা দৃষ্টিভঙ্গিগুলোর বিপরীতে লেখনী শুরু করে। একদিকে লেখাপড়া শিখেছে, এর উপর আবার সমাজের প্রচলিত চিন্তার মত পথের বিরুদ্ধে কথা বলছে- সমাজে একজন মেয়ের খারাপ/ মন্দ আখ্যা পেতে আর কী লাগে? যাই হোক, মেয়েটির ঘরে ফুটফুটে দুইটি মেয়ে হয়েই মারা গেলে শোকে পাগল প্রায় অবস্থায় স্বামীর সহায়তায় মেয়েদের এক স্কুল গড়ার প্রচেষ্টা চলতে না চলতে স্বামীও মারা যায়। একবার ভাবুন, একটা রক্ষণশীল সমাজে একজন মেয়ের এই লড়াইয়ের পথ কতটা ভয়ংকর হয়ে যায় তখন!

স্বামী মারা গেলে স্বামীর আগের পক্ষের মেয়ে আর মেয়ে জামাতার প্রবল দুর্ব্যবহারে চলে আসতে হয় কোলকাতায়। নতুনভাবে শুরু করেন স্কুল। ততদিনে নারীটি একটু একটু করে সমাজের এক শিক্ষিত শ্রেণির আস্থা অর্জন করতে পেরেছেন, যা বোঝা যায়, নতুন স্কুলটিতে এক ব্যক্তি ছাত্রীদের আসা যাওয়ার জন্য ঘোড়ার গাড়ি দান করায়। এদিকে আরেক দূর্যোগ দেখা দেয়। স্বামীর প্রায় দশ হাজার টাকা যে ব্যাংকে রাখা ছিলো, তা আচমকা দেউলিয়া ঘোষিত হলে পুরো টাকাই নাই হয়ে যায়।  এই অবস্থায় সমাজের দানশীল ও উদার মনোভাবাপন্ন ব্যক্তিদের একান্ত সহযোগিতায় স্কুলটি চালু রাখতে সক্ষম হয়। আর মুসলিম মেয়েদের ধর্ম আর সেলাই শিক্ষার বাইরে এসে মেইনস্ট্রিমের শিক্ষার প্রথম সূচনা ঘটে এই স্কুলেরই মধ্য দিয়ে। এই যে এতক্ষণ যাকে নিয়ে কথা বললাম, আশা করি, এর মাঝেই বোঝা গেছে, মানুষটি বেগম রোকেয়া।

বেগম রোকেয়ার যুগ থেকে এই যুগ। সময়ের এক বিশাল ব্যবধান। কিন্তু বেগম রোকেয়া ঠিক যে জীবন পেয়েছিলেন, তার থেকে চুল পরিমাণ সরতে দেখিনি সমাজের মানসিকতা। তবে নারীদের অবস্থার পরিবর্তন যে হয়নি, তা কিন্তু না। ব্যাপক পাল্টেছে। মেয়েরা এখন কেবল সেলাই কর্ম আর ধর্ম শিক্ষা দিয়ে শিক্ষার সমাপ্তি ঘটায় না। উচ্চশিক্ষায় আসছে, অর্থনৈতিকভাবে স্বাবলম্বী হচ্ছে, হাট বাজারে, পথে প্রান্তরে তাদের চলাচলও বেড়েছে। কিন্তু বাড়েনি তাদের পদমর্যাদা। এখনও একজন নারীর প্রতি সম্মানের জন্য তাকে ‘মা’ হতে হয় বা কোন ক্ষমতাবানের ‘স্ত্রী’ হতে হয়। আর ক্ষমতায়নের জন্য তার হওয়া লাগে ক্ষমতাবান কোন ব্যক্তির কন্যা, স্ত্রী বা বোন। এ নিয়ে বিস্তারিত কথায় যাবার আগে মনে আসতে থাকা আরেক খটকা নিয়ে কথা বলি। বেগম রোকেয়া নারীর জীবন পরিবর্তনে যে ভূমিকা রেখেছিলেন তা পুরুষতান্ত্রিক কাঠামোকে চ্যালেঞ্জ করতে পেরেছিলো নাকি পুরুষতন্ত্রকে সহবস্থানে রেখে নারীর কিছুমাত্র অবস্থা পাল্টানোতে ভূমিকা রাখতে পেরেছিলো? তার মতাদর্শ নিয়ে দ্বৈতমান কেন তৈরি হচ্ছে দুই একটা উদাহরণ দিয়ে বলি।

‘‘ কোনো ভগ্নী মস্তক উত্তোলন করিয়াছেন, অমনি ধর্মের দোহাই বা শাস্ত্রের বচন-রূপ অস্ত্রাঘাতে তাঁহার মস্তক চূর্ণ হইয়াছে। … আমাদিগকে অন্ধকারে রাখিবার জন্যে পুরুষগণ এই ধর্মগ্রন্থগুলি ঈশ্বরের আদেশ বলিয়া প্রচার করিয়াছেন। … এই ধর্মগ্রন্থগুলি পুরুষরচিত বিধিব্যবস্থা ভিন্ন কিছুই নহে। মুনিদের বিধানে যে কথা শুনিতে পান, কোনো স্ত্রী মুনির বিধানে হয়ত তাঁহার বিপরীত নিয়ম দেখিতে পাইতেন।… ধর্ম আমাদের দাসত্বের বন্ধন দৃঢ় হইতে দৃঢ়তর করিয়াছে, ধর্মের দোহাই দিয়া পুরুষ এখন রমনীর উপর প্রভুত্ব করিতেছেন।” (১৯০৪)

আবার বঙ্গীয় নারী শিক্ষা সমিতির ভাষণ দেয়ার সময় বেগম রোকেয়া বলেন, ‘ … প্রাথমিক শিক্ষা বলিতে যাহা কিছু শিক্ষা দেওয়া হয়, সে সমস্ত ব্যবস্থাই কোরানে পাওয়া যায়। …ফলকথা উপরোক্ত দুরবস্থার একমাত্র ঔষধ একটি আদর্শ মুসলিম বালিকা বিদ্যালয়… আদর্শ মুসলিম বালিকা বিদ্যালয়ে আদর্শ মুসলিম নারী গঠিত হবে- যাদের সন্তান সন্ততি হবে হযরত ওমর ফারুক, হযরত ফাতেমা জোহরার মতো।”

এখন এই দ্বৈতসত্তার বিষয়গুলো স্বাভাবিক ভাবেই বেগম রোকেয়াকে ঘিরে নারীর অসম অধিকারের মতাদর্শিক জায়গাকে দ্বিধায় ফেলে দেয়। যার জন্য ড. আকিমুন রহমান তীব্রভাবে বেগম রোকেয়ার এই দ্বৈতমানকে আক্রমণ করে বলেন,

‘‘সীমাহীন স্ববিরোধ ও পুরুষতন্ত্রের প্রথা মান্য করার অন্য নামই হচ্ছে রোকেয়া। নারীর জীবন গড়ে তোলার কাজে নিবেদিত এক ব্রতী বলে মান্য হন রোকেয়া, তবে তাঁর নিজের জীবনকে নিজের ইচ্ছেমতো কাঠামো দেবার শক্তি ও ইচ্ছেই তাঁর মধ্যে লক্ষ্য করা যায় না। তাঁর নিজের জীবনই তাঁর নিজের তৈরি নয়। রোকেয়া নারীপ্রতিভা হিসেবে নন্দিত; রোকেয়া প্রতিভা ঠিকই, তবে স্বামীর ছাঁচে বিকশিত প্রতিভা। তিনি অভিজাত পুরুষতন্ত্রেও কুপ্রথা ও অবরোধ পীড়নের বিরুদ্ধে মুখর, আর নিজের জীবনে অতিনিষ্ঠার সঙ্গে পালন করেন পতিপ্রভুর পরিয়ে দেওয়া শৃঙ্খল; আমৃত্যু নিয়ন্ত্রিত হন একটি শবদেহ দ্বারা। তাঁর বিবাহিত জীবন স্বল্পকালের, বৈধব্যের কাল দীর্ঘ; স্বল্প বিবাহিত জীবন কাটে তাঁর মহাপাথরের বন্দনায় আর দীর্ঘ বৈধব্যের কাল কাটে মৃত পতির তৈরি করে রেখে যাওয়া ছক অনুসারে। রোকেয়া বাঙালি মুসলমান নারীর জাগরণের জন্য লিখে যান জ্বালাময়ী প্রবন্ধ আর নিজের জীবনে অনড় করে রাখেন অন্ধকার ও প্রথার মহিমা। রোকেয়া আদ্যপান্ত স্ববিরোধিতাগ্রস্ত। রচনায় তাঁর ক্ষোভ ও বক্তব্য বেজে ওঠে; ব্যক্তিজীবনে তিনি যাপন করেন প্রথাগ্রস্ত, বিনীত, মান্য করে ধন্য হয়ে যাওয়া জীবন। তাই তাঁর রচনাবলী থেকে চোখ ফিরিয়ে তাকানো দরকার তাঁর জীবনের দিকে; তবেই স্পষ্ট হয়ে উঠবে তাঁর সত্য পরিচয় ও ভূমিকা। …”

আর শুধুমাত্র এই গবেষক কেন, বর্তমান সময়ের নারীবাদী চিন্তার অধিকারী যে কোন নারী পুরুষের কাছেই তার বেশ কিছু মতামত অগ্রহণযোগ্য। বেগম রোকেয়ার আরেক লেখনীর অংশ তুলে দিচ্ছি যাতে স্পষ্ট হবে বিষয়টি।

‘‘বেশ কথা। আশা করি আপনারা সকলেই সুগৃহিণী হইতে ইচ্ছা করেন, এবং সুগৃহিণী  হইতে হইলে যে যে গুণের আবশ্যক, তাহা শিক্ষা করিতে যথাসাধ্য চেষ্টাও করিয়া থাকেন। কিন্তু আজ পর্যন্ত আপনাদের অনেকেই প্রকৃত সুগৃহিণী হইতে পারেন নাই। কারণ আমাদের বিশেষ জ্ঞানের আবশ্যক, তাহা আমরা লাভ করিতে পারি না। সমাজ আমাদের উচ্চশিক্ষা লাভ করা অনাবশ্যক মনে করেন। পুরুষ বিদ্যালাভ করেন অন্ন উপার্জনের আশায়, আমরা বিদ্যালাভ করিব কিসের আশায়? অনেকের মত আামাদের বুদ্ধি বিবেচনার প্রয়োজন নাই। যেহেতু আমাদিগকে অন্নচিন্তা করিতে হয় না, সম্পত্তি রক্ষার্থে মোকদ্দমা করিতে হয় না, চাকরীলাভের জন্য সার্টিফিকেট ভিক্ষা করিতে হয় না, ‘নবাব’ ‘রাজা’ উপাধিলাভের জন্য শ্বেতাঙ্গ প্রভুদের খোসামোদ করিতে হয় না, কিংবা কোন সময়ে দেশরক্ষার্থে রণক্ষেত্রে অবতীর্ণ হইতে হইবে না। তবে আমরা উচ্চশিক্ষা লাভ করিব কিসের জন্য? আমি বলি, সুগৃহিণী হওয়ার নিমিত্তই সুশিক্ষা আবশ্যক।’

সুগৃহিণীদের তালিকাগুলো দেখি:

‘‘ঘরকন্নার কাজগুলি প্রধানত এই-

(ক) গৃহ এবং গৃহসামগ্রী পরিস্কার ও সুন্দররূপে সাজাইয়া রাখা

(খ) পরিমিত ব্যয়ে সুচারুরূপে গৃহস্থালী সম্পন্ন করা

(গ) রন্ধন ও পরিবেশন

(ঘ) সূচিকর্ম্ম

(ঙ) পরিজনদিগকে যত্ন করা

(চ) সন্তানপালন করা’’

এখন যে বেগম রোকেয়া নারী জাগরণের অগ্রদূত হিসেবে কাজ করেছে। নারীদের মুক্তির পথ দেখাবার জন্য শিক্ষা অর্জনের স্বপ্ন দেখিয়েছে, তার হাত ধরেই আবার সুগৃহিণী হবার শিক্ষা দেয়াটা বৈপরীত্য বলেই মনে হবে। এবার ভাবি, সময়টা উনবিংশ শতকের শুরুকাল। নারী তখন বুদ্ধিবৃত্তিক জগতে অস্তিত্বহীন। নারীকে ভাবা হয় তখন (এমনকি নারী নিজেও ভাবতেন) প্রয়োজন মিটাবার এক মাংসপিণ্ড মাত্র। সেই সময়ের একজন নারী হয়ে পর্দার এতো ঘেরাটোপের মাঝে থেকে নিজে বেরিয়ে এসে আরেক নারীকে বের করার মতোন কাজ কতজন শক্তিশালী মানুষের পক্ষে সম্ভব? যা করেছেন বেগম রোকেয়া। পুরুষশাসিত সমাজে পুরুষের মতোন এতো শক্তিশালী দানবীয় কাঠামোর সম্পূর্ণ বিপক্ষে গিয়ে নারীদের কোন অর্জন আসলেই কী সম্ভবপর ছিলো? পাশ্চাত্যে নারীবাদের প্রথম তরঙ্গ তখন চলছে। কিন্তু শুরুর অবস্থা কী ছিলো পাশ্চাত্যের নারীদের? মধ্যযুগে পুরুষনিয়ন্ত্রিত সমাজ কাঠামোয় থেকে সম্পূর্ণ তাদের বিরুদ্ধাচার করে মতামত প্রতিষ্ঠার জের দিতে হয়েছিল তখন ইউরোপেরই হাজারে হাজারে নারীর। এর পরবর্তী ফরাসী বিপ্লবের কথাই ধরি। বিপ্লবে রাজতন্ত্রের অবসান ঘটে। লুইয়ের প্রাসাদ পুড়িয়ে দেয়ার সময় ফরাসী নারীরা ছিল পুরুষের আগে ভাগে। রাজক্ষমতা বিলোপের পর পার্লামেন্টারি সিস্টেম চালু হলে সেই পার্লামেন্টই ফাঁসিতে ঝুলায় বিপ্লবে যে নারী নের্তৃত্ব দিয়েছিলো সেই অলিম্প জে গুডজে’কে। তাঁর অভিযোগ ছিলো, নারী পুরুষের সমান মর্যাদার অধিকারে বিদ্রোহ করে বসা।

সেই দশকে উদারপন্থী নারীবাদেরও জন্ম। পাশ্চাত্যে তখন মেরীও নানাভাবে পুরুষতন্ত্রকে চ্যালেঞ্জ ছুড়ে দিলেও শিক্ষা অর্জনের গুরুত্ব বোঝাতে গিয়ে, মায়েরা বা বউরা শিক্ষিত হলে সন্তানের অপুষ্টিতে ভোগা কত কমবে বা শিক্ষিত বউ কতটা কম খরচে সংসার সাজিয়ে সুখের সংসার গড়তে পারবে সেই ধারণাও ছড়াতে হয়েছিল নারীকে শিক্ষার পথে আনতে। নারীর সুস্থ দেহের প্রয়োজনীয়তা বোঝাতে গিয়ে সমাজকে বোঝাতো উদারপন্থী নারীবাদীরা যে সুস্থ নারী কতটা সুস্থ সন্তান জন্ম দিতে বা লালন পালনে সক্ষম হয়। আর নারীর কর্মজীবনে প্রবেশের সুবিধা বোঝাতে গিয়ে বলতে হয়েছিল, নারীর অর্থ উপার্জনে বাড়তি পয়সা দিয়ে সন্তান কতটা ভালো থাকতে পারবে। সেই দশকে একবারও ভাবাই হয় নাই, নারী ঘরে বাইরে এতো কাজ কী করে করতে পারবে বা করা সম্ভব? ঘর আর বাইরের ব্যবস্থাপনার সমান অংশীদারীত্ব নিয়ে চ্যালেঞ্জ করাও সম্ভবপর ছিলো না সেই কালে। পরবর্তীতে উদারপন্থী নারীবাদীদের মাঝেও এ নিয়ে মতদ্বৈততা আসে। যার জন্য বেটি ফ্রাইডান কে বলতে শুনি, নারীকে ঘরের কাজ না কমিয়ে বাইরের কাজের মাঝে আনা মানেই সুপার উইমেন হবার অবস্থায় ফেলা। বেগম রোকেয়ার পক্ষেও তৎকালীন অন্ধকার আর সংস্কারে ঢাকা সমাজ কাঠামোর সম্পূর্ণ বিরুদ্ধে গিয়ে কাজ করার চিন্তাটা অবাস্তব। আর সেই সমাজকে চটিয়ে ঘরের কাজে পুরুষের অংশ নেয়াটা আর পদমর্যাদায় নারীকে পুরুষেরই সমান স্থানে আনা কল্পনাপ্রসূত ধারনা বলে ভাবাই স্বাভাবিক ছিলো তাঁর পক্ষে।

কিন্তু আমাদের ভুলে গেলে হবে না যে, রাজা রামমোহন রায় আর ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর হিন্দু নারীদের যেভাবে বাঁচার অধিকারটুকু করে দিয়েছিলেন, বেগম রোকেয়া সেখানে মুসলিম নারীদের অবরোধ মুক্তির পথ দেখিয়েছেন, শিক্ষার পথে এনে ব্যারিস্টার বা জজ হবার স্বপ্ন দেখিয়েছেন। যদিও বেগম রোকেয়া উপলব্ধি হয়তো করতে পারেননি নারী জজ-ব্যারিষ্টার হলেও পুরুষের পাশাপাশি অবস্থান নিতে ব্যর্থ হবে। কারণ অবস্থার পরিবর্তন হলেই অবস্থানের পরিবর্তন ঘটে না। আর এই উপলব্ধি কেবল বাঙালী সমাজের একজন নারী কেন, নারী উন্নয়নের বিভিন্ন অ্যাপ্রোচ প্রয়োগকারীরাও শুরুতে বুঝতে পারেনি। নারী উন্নয়নে তারা কল্যাণমূলক, সাম্য, সমতা, দারিদ্র্য বিমোচন অ্যাপ্রোচ প্রয়োগ করেও নারীর অবস্থার অবনতি দূর করতে না পেরে জেন্ডার উন্নয়নকে শেষমেষ পাথেয় বলে মনে করলো।

বর্তমান নারীবাদী চিন্তার জায়গা তাই বেগম রোকেয়ার মতাদর্শে আর থাকা সম্ভবপর হয়নি, কারণ এখন নারীর যুদ্ধটা অবস্থান গড়ার। কর্ণাটকের বিচারপতির বক্তব্যে যার ধারনা শুরুতে দিয়েছিলাম। পরবর্তী আলোচনা করবো নারীর অবস্থান নিয়ে নারীরা ঠিক কোন বাস্তবতায় আছে, সেটি নিয়ে।

[ফেমিনিস্ট ফ্যাক্টরে প্রকাশিত কলাম লেখকের নিজস্ব বক্তব্য]