November 25, 2024
কলামফিচার ২

একজন আয়েশা সিদ্দিকা এবং আমরা

আঞ্জুমান রোজী।। মধ্যযুগীয় বর্বরতা দেখছি এখন বাংলাদেশে। যখন বিশ্ব সভ্যতার চরম চূড়ায় অবস্থান করছে তখন বাংলাদেশ চলছে পশ্চাৎপদে। চিন্তাভাবনা, মননে মগজে চলছে পচন ক্রিয়াশীলতা। প্রগতির ভাবনা নয়, ভাবছে মধ্যযুগীয় ভাবনা। যেখানে নারীপুরুষ সম্মিলিত প্রচেষ্টায় এগিয়ে চলার কথা, সেখানে নারীকে রাখার চেষ্টা হচ্ছে অন্ধকার গুহায়। এই ভাবনা নারী-পুরুষ কমবেশি অনেকের মধ্যেই আছে। তারা শিক্ষিত কি অশিক্ষিত তাতে কিচ্ছুই যায় আসে না৷ কারণ তাদের মনন এবং মগজ ধর্মীয় গোড়ামি ও সামাজিক কুসংস্কারে আচ্ছন্ন। নাহলে এখনো আমাদের  দেখতে হয়, শুনতে হয় নারীর পেশা নির্বাচনে ঘৃণ্যতম সামাজিক বিধি নিষেধ!

দিনাজপুরের আয়েশা সিদ্দিকা ম্যারেজ রেজিস্ট্রার বা বিয়ের কাজী হতে চেয়েছিলেন। কিন্তু হাইকোর্ট বিতর্কিত রায় দিয়ে নারীর শরীরবৃত্তীয় প্রাকৃতিক ব্যাপারের জন্য পুরো একটি প্রফেশনকে পুরুষের দখলে নিয়ে মধ্যযুগীয় চিন্তাভাবনার প্রতিফলন ঘটায়!

দিনাজপুরের ফুলবাড়িয়া পৌরসভায় ২০১২ সালে ম্যারেজ রেজিস্ট্রার নিয়োগের এক বিজ্ঞপ্তি দেখে আয়েশা তিনটি ওয়ার্ডের জন্য বিয়ের কাজী হতে আবেদন করেন। নির্দিষ্ট সময়ে ইন্টারভিউতে ডাকা হলে তিনি ভালভাবে উৎরে গিয়ে এই পদের যোগ্য বলে বিবেচিত হন। তাকে নিয়োগের সুপারিশ করে কাগজপত্র মন্ত্রণালয়ে পাঠিয়ে দেওয়া হয়। কিন্তু মন্ত্রণালয় থেকে পরিস্কার জানিয়ে দেওয়া হয় তিনি এই পদের যোগ্য হবেন না। কারণ এই পদে কোন মহিলা নিয়োগের বিধান নেই।

তারপরেই শুরু হয়ে যায় আয়েশা সিদ্দিকার যুদ্ধ। প্রথমে ২০১৪ সালে হাইকোর্টে রিট পিটিশন দায়ের করেন। পরবর্তীতে বিতর্কিত রায় ঘোষণার পর এখন চলছে আপিলের প্রক্রিয়া।  আয়েশার কথা- তিনি এর শেষ দেখতে চান। হয়তো আয়েশা তার পক্ষে রায় পেয়েও যেতে পারেন। কারণ সংবিধানে নারীপুরুষের সমান অধিকারের কথা বলা আছে। সংবিধান পাশ কাটিয়ে এমন রায় কোনো অবস্থায় গ্রহণযোগ্যতা রাখে না। কিন্তু কথা হলো, এই ভোগান্তিটা কেন আয়েশাকে দেয়া হলো?

নারীর প্রতি বৈষম্যমূলক দৃষ্টিভঙ্গির পরিবর্তন আর কবে হবে?  যুগে যুগে নারীকেই তো সমাজের প্রতিকূল অবস্থার বিরুদ্ধে যুদ্ধ করে আসতে হচ্ছে।

নারীর প্রতি সবরকম অন্যায়-অত্যাচারের প্রতিবাদ, নারীর ন্যায্য অধিকার আদায়ের দাবি; সবই তো নারীকেই করতে হচ্ছে। সেই উনিশ শতকের মাঝামাঝি থেকে শুরু করে আজ পর্যন্ত অধিকার আদায়ের যুদ্ধটা নারী একাই চালিয়ে যাচ্ছে। প্রায় সময় আমার পুরুষ বন্ধুদের কাছ থেকে শুনি, আপনারা মাঠে নামেন না কেন? সমস্যা তো আপনাদের! আমি অবাক হয়ে ভাবি, নারীর এই সমস্যাগুলো কারা তৈরি করছে? কাদের জন্য নারীর জীবন এমন মানবেতর? সমাজের সিস্টেম কাদের হাতে? কারা সবকিছু নিয়ন্ত্রণ করছে? সবই তো পুরুষ!  তাই নারী যখন প্রতিবাদী হয়ে উঠছে তখন একশ্রেণির পুরুষ ঝাপিয়ে পড়ছে নারীকে দমন করার জন্য। কিন্তু যে সমস্ত পুরুষ নারীর পক্ষে কথা বলছেন বা লিখছেন, তারাই বা কতটুকু নারীর জন্য সরব?

সামাজিকভাবে নারী বিষয়ক কোনো আন্দোলনে গুটিকয়েক পুরুষ ছাড়া তেমন সচেতন পুরুষদের পাশে পাওয়া যায় না। তারা দূর থেকে কিম্বা অন্দরমহলে থেকে নারীর পক্ষে অল্পবিস্তর কথা বলেন। অথচ আমরা চাই, যে কোনো আন্দোলন -বিপ্লবের মতো নারী অধিকার আন্দোলনেও পুরুষের অংশগ্রহণ। আমাদের পায়ে পা মিলিয়ে তারাও বলুক নারীমুক্তির কথা। এমনটা অবশ্য স্বপ্ন। কারণ পুরুষতান্ত্রিক সমাজে পুরুষ পুরুষের পাশেই থাকে। এক পুরুষ, আরেক পুরুষকে ক্ষেপিয়ে সমাজে চলাফেরা করে না। বরঞ্চ সমঝোতা করেই চলে। বিশেষ করে নারীর বিষয়ে অধিকাংশ পুরুষ একাট্টা হয়ে থাকে। বিষয়টা এমন যে, নারীর সমস্যা পুরুষের সমস্যা নয়। অথচ এটি একটি সামাজিক সমস্যা। এমতাবস্থায় আয়েশাকে একাই যুদ্ধ করতে হচ্ছে।

আজকে আয়েশা সিদ্দিকা যে যুদ্ধটা করছে, এটা শুধু তার একার যুদ্ধ নয়। এই যুদ্ধ সমগ্র নারীকুলের জন্য, নারীর অস্তিত্বের জন্য। নারী সর্বাবস্থায় সমান অধিকার নিয়ে যাতে চলতে পারে তারই যুদ্ধ। অথচ সামাজিক মাধ্যমে আয়েশার বিষয় নিয়ে তেমন লেখা হচ্ছে না, হচ্ছে না বিতর্কিত এবং ঘৃণ্য  রায়ের বিরুদ্ধে প্রতিবাদলিপি। আমি জানি না, আয়েশা সামাজিকভাবে কোনো মোরাল সাপোর্ট পাচ্ছে কিনা!

মানসিকভাবে সম্পূর্ণরূপে আমি আয়েশাকে আমার অবস্থান থেকে সমর্থন দিয়ে যাচ্ছি। তবে আশা করবো সব নারীই আয়েশাকে পূর্ণ সমর্থন জানিয়ে যাবে। আয়েশা সিদ্দিকা যদি তার পক্ষে রায় পেয়ে যান, তাহলে তাকেও আমাদের উচিৎ সামাজিকভাবে সাহসী নারী হিসেবে চিহ্নিত করা এবং স্বীকৃতি দেয়া।  যুগে যুগে নারী অধিকার আদায়ের ইতিহাসে এমন নারী ছিল বলেই নারীর চলার পথ মসৃণ হয়েছে। তা-ই আয়েশা সিদ্দিকাকে  জানাই আমার গ্রেট সালাম।

 

[ফেমিনিস্ট ফ্যাক্টরে প্রকাশিত কলাম লেখকের নিজস্ব বক্তব্য]