November 21, 2024
বয়ঃসন্ধি-Adolescenceফিচার ৩মুক্তমত

বয়ঃসন্ধির সন্তান: কী করা উচিত বাবা মায়ের?

ফারজানা নীলা।। জীবনের সবচেয়ে কঠিন প্রহর কোনটি- বললে আমার কাছে মনে হয় বয়ঃসন্ধিকালই সবচেয়ে কঠিন। এই বয়সে চিরচেনা শরীর আমূল পালটে যায়। চিরচেনা মন সবচেয়ে অদ্ভুত চিন্তা করতে শুরু করে, যার সাথে পরিচিত করিয়ে দেওয়ার মত কেউ থাকে না। যার সাথে পরিচিত হতে হয় নিজে নিজে। পরিচিত হতে গিয়ে অনেক সময় ভুল হয়ে যায়, আবার হয় না।

এই সময়ে ছেলেমেয়েদের মনোজগতে আর  শরীরে কেমন পরিবর্তন আসে তার কোনও শিক্ষা আমরা পারিবারিক ভাবে  পাই না।  তবুও কি এই পরিবর্তন থেমে থাকে?

পরিবর্তন নিজের গতিতেই চলে আসে। অস্বস্তিতে  ফেলে দেয় সদ্য কিশোর কিশোরীদের। যাদের অস্বস্তি দূর করার জন্য পাশে কেউ থাকে না। অস্বস্তি দূর করার জন্য নানা অজানা প্রশ্নের উত্তর খুঁজে নিতে হয় নিজের তাগিদে।

সন্তানের জন্য সবচেয়ে আপন তার বাবা মা। এই বাবা মায়ের কী ভূমিকা দেখতে পাই যখন তার ছেলে মেয়ে বয়ঃসন্ধিতে পড়ে? মেয়েদের ক্ষেত্রে শুধু মাসিক শুরু হলে বলে দেয় প্যাড কীভাবে পরতে হবে, ব্যথা হলে একটু সহ্য করতে হবে, এই শিক্ষাই দেওয়া হয়।

এছাড়া আমরা কি বলি কেন মাসিক হয়? মাসিক হলে শরীর এবং মন খারাপ হতে পারে, এই সময়ে কী কী করতে হয়? হাইজিন কীভাবে রক্ষা করতে হয়? মধ্যবিত্ত থেকে শুরু করে উচ্চবিত্ত কোনো পরিবারে কি এই নিয়ে ছেলেমেয়েদের শিক্ষা দেওয়ার বিষয়টিকে গুরুত্ব দেওয়া হয়? হয় না। পরিবারের ব্যবহার এমন যেন এই নিয়ে সবাই মায়ের পেট থেকে শিক্ষা নিয়ে আসে। বয়স হলে নিজে নিজেই বুঝে যাবে। এগুলা নিয়ে ছেলে মেয়েদের সাথে কথা বলা লজ্জার বিষয়।

আর বাবা মা’দেরও বা কে শিখিয়েছে? তারা বলে এসব নিজেরাই শিখে নেবে ধীরে ধীরে। এগুলোর জন্য আলাদা করে বলতে নেই। ওই মেয়েদের একটু দেখিয়ে দিতে হয় কীভাবে  পিরিয়ড হলে কী কী করতে হয়। তখন তারা ‘অপবিত্র’ থাকে ! তাই নামাজ রোজা করতে পারবে না। এই।

আর ছেলেদের ক্ষেত্রে? ওদের কিছু বলতে করতে হয় না। ওরা বড় হলে নিজেরাই বুঝে যাবে সে যে বড় হচ্ছে। দাদা দাদীদের কেউ শেখায় নি, তারাও বাবা মা’দের শেখায় নি। সুতরাং বাবা মা’রাও সন্তানদের ক্ষেত্রে একই ধারণা পোষণ করেন।

বয়ঃসন্ধিকালকে “তেমন কিছু না” ব্যাখ্যা দিয়ে চলতে আমাদের বাবা মা’রা বেশি পছন্দ করেন। তাদের একটাই যুক্তি “আমাদের তো কেউ শেখায় নি, আমরা কি শিখি নি নিজে নিজে? আমরা তো ঠিকই এই সময়ে ভালমন্দ বুঝে চলেছি।”

তাদের যুক্তিটা প্রযোজ্য হতো যদি এখনকার ছেলেমেয়েরা তাদের সময়ে বাস করত। সময় যে বহু আগে বহু রকমের রঙে পাল্টে গিয়েছে সে নিয়ে খবর হয় যখন এই বয়সে সন্তানরা বিপদে পড়ে।

ক্ষেত্র বিশেষে প্রাণ হারায়।

আমি বা আমার মত অনেকেই বয়ঃসন্ধি সম্পর্কে প্রথম জেনেছিলাম, হয় বড় কাজিন বোনের থেকে বা স্কুলের আগেভাগে বয়ঃসন্ধিতে পড়া কোনও বান্ধবীর থেকে। জেনে আমাদের মনে শরীরে যে বিস্ময়ের স্রোত বয়ে গিয়েছিল,  সে খবর কে রাখত!

এই সময়ে বিপরীত লিঙ্গের প্রতি আকর্ষণ জন্মে সেটার  ভালো খারাপ দিক কে নির্ণয় করে দেয়? এই আকর্ষণকে একবার খুব খারাপ, অন্যবার খুব ভাল  লাগার যে প্রবণতা সেটার আসল ব্যাখ্যা কেউ দেয়?

শারীরিক চাহিদা যখন জাগতে শুরু করে তখন এই কিশোর কিশোরীরা কাকে জানায় এই অজানা ইচ্ছের কথা? কাউকেই না। তারা নিজেরাই বুঝে যায় এ এক নিষিদ্ধ ইচ্ছে। কিন্তু এই ইচ্ছে কেন জাগে কীভাবে এর সাথে সামঞ্জস্য করতে হয় কেউ তাদের শেখায় না।

যৌনতা আমাদের কাছে আজন্ম এক নিষিদ্ধ বিষয়। এখানে জন্ম থেকে শিশুরা দেখে আসছে বাবা মা একে অপরের হাতও ধরে না প্রকাশ্যে। কেন? কারণ ‘স্বামী স্ত্রী হলেও প্রকাশ্যে ছোঁয়াছুঁয়ি ভাল না! সন্তানের সামনে তো আরও খারাপ! সন্তান তাতে খারাপ চিন্তা করতে শেখে!’

অথচ বাবা মা’কে এভাবে দেখতে অভ্যস্ত সন্তানরা যখন হুট করেই যৌনতা সম্পর্কে জানে তখন সবচেয়ে বেশি খারাপ বাবা মা’কেই মনে করে। মনে করে তারা খারাপ কাজ করে তাকে এই পৃথিবীতে এনেছে।

নিজের শরীর মন নিয়ে এই সময়ে অজানাকে জানতে জানতে সৃষ্টি হয় বাবা মায়ের সাথে দূরত্ব। শৈশবের সবচেয়ে প্রিয় বাবা মা হয়ে যায় সবচেয়ে খারাপ, সবচেয়ে দূরের।

কারণ সে যা জানতে চায় তা সে বাবা মায়ের সাথে আলোচনা করতে পারে না। সে যা জানতে চায় তা সে জানে বিভিন্ন নিষিদ্ধ বই থেকে, নিষিদ্ধ ইথারের বিভিন্ন নিষিদ্ধ ওয়েবসাইটের মাধ্যমে, বিভিন্ন সৎ অসৎ বন্ধুর মাধ্যমে।

বাবা মা আরও খারাপ হয়ে যায় যদি বাবা মা তার ইচ্ছেমত চাহিদা পূরণ না করে। তার সব চাহিদার কথা এতদিন সে প্রকাশ্যে বলতে পারলেও এখন সে আর পারছে না সবকিছু খুলে বলতে। বাবা মা’ই হাতে তুলে দিচ্ছে দামি ফোন। ভারি পকেট মানি। তা  দিয়ে বাবা মা আশা করছে ছেলে মেয়ে মোবাইলে শুধু ভাল জিনিসই দেখবে। অথচ খারাপ কাকে বলে সে সম্পর্কে পূর্ব কোনো শিক্ষা কি বাবা মা দেয়? বলে দেয় কি এই সময়ে কী দেখা উচিত, কী দেখা উচিত নয়? উচিত যদি না হয় তবে সেটা কেন উচিত নয় তার ব্যাখ্যা কোথায় পাবে ?

পায় না। এই সময়ে চোখের উপর রঙ্গিন চশমা লাগানো থাকে সার্বক্ষণিক। সবকিছুই রঙ্গিন লাগে তখন। প্রেম রঙ্গিন লাগে, শরীর রঙ্গিন লাগে, সিনেমার নায়ক নায়িকাদের পোশাক,জীবন যাপন, সিনেমার শারীরিক সম্পর্কের দৃশ্য সবই সবচেয়ে মধুর লাগে।

স্কুলে আসতে যেতে ছেলেদের সাথে চোখে চোখে ইশারা ভাল লাগে। চ্যাটে হাজারো ছবি আদান প্রদান ভাল লাগে। ভাল লাগতে লাগতে ইথার থেকে বের হয়ে সরাসরি আদানপ্রদানও ভাল লাগতে শুরু করে।

এরপর যখন কিছু একটা খারাপ হয়ে যায়, বা বাবা মা জেনে যায় তার মেয়ে বা ছেলে “প্রেম” করে  বেড়াচ্ছে তখন শুরু শাসন নামের আরেক প্রহসন। চলে মারামারিও। এতে কিশোর কিশোরীর মনে কী  প্রভাব পড়ে সেটা ভেবে দেখার অবকাশ কিন্তু আমাদের নেই। শাসন করার আগে কেউ কিন্তু ঐ কিশোর কিশোরীদের বুঝায় নি কী করা উচিত এই বয়সে কী  করা উচিত না।

আমাদের বাবা মা রায় দিয়ে দেয় “খবরদার প্রেম করবি না, ছেলেদের সাথে মিশবি না, মেয়েদের সাথে মিশবি না।” কিন্তু এই বয়স যে মিশতে চায়, কেন মিশতে চায় সেই ব্যাখ্যা তো বাচ্চারা নিজেরা জানতে পারে না, যদি না তাদের কেউ শেখায়। সেই শেখার দায়িত্ব কেউ নেয় না। পরিবার, স্কুল, সমাজ- কেউ না।

সবাই রায় শোনায়। কিন্তু রায়ের ব্যাখ্যা অজানা থেকেই যায়। এই বয়সে ছেলে মেয়েদের মধ্যে মেলামেশা নিষিদ্ধ না হয়ে সেটা কতটা মিশলে ভদ্র এবং স্বাভাবিক থাকবে সে বিষয়ে বন্ধুর মত বাচ্চাদের না বুঝিয়ে সীমা যখন অতিক্রম হয়ে যায় তখন শাসনের ফল অধিকাংশ ক্ষেত্রে ভাল না হয়ে খারাপই হয়।

এখন ধরুন অভিভাবকদের বলা হল আপনারা বন্ধুর মত মিশুন এই বয়সে বাচ্চাদের সাথে। তাকে বুঝান এই বয়সে কী করা উচিত কী করা উচিত নয়। তখন খুব সাধারণ উত্তর পাওয়া যায়- “কেন অমুক বাসার বাচ্চা তো এমন করে না, অমুকের ছেলে তো এসব ছাইপাশ খায় না, অমুকের মেয়ে তো চোখ নিচের দিকে রেখে স্কুলে যায় আসে। ওদেরকে কি কেউ এসব নিয়ে জ্ঞান দিয়েছে? নিজেরা শেখে নি?”

এসব যুক্তি শুনলে মনে হয়, বাচ্চাদের শিক্ষা দেওয়ার আগে বাচ্চাদের বাবা মা’দের কোর্স করা উচিত, “কীভাবে বয়ঃসন্ধির বাচ্চাদের সাথে মিশতে হবে।”

হ্যাঁ, এখন এই কথা শুনে অনেকের তেড়ে আসবেন এই বলে “বাবা মা’দের শেখাতে আসছেন, বাবা মা থেকে জন্ম নিয়ে এখন তাদের উপর জ্ঞান ঝাড়তে আসছেন।”

বাবা মা থেকে জন্ম যেহেতু নিয়েছি, হাঁটতে চলতে কথা বলতে যেমন বাবা মা থেকেই শিখেছি, তেমনি শারীরিক এই পরিবর্তনের সময়ের সঠিক শিক্ষাও বাবা মা থেকেই আসতে হবে।

এটা “নিজে নিজে শেখার” মত বিষয় না। ক্ষুধা লাগলে খেতে হবে যেমন সহজাত প্রবৃত্তি মানুষের তেমনি এই বয়সে শারীরিক বিষয়ে জানতে চাওয়াও সহজাত প্রবৃত্তি। বাচ্চাকে যেমন আমরা চাইলেই চকলেট চিপস খেতে দেই না, কেননা তাতে তার শরীর খারাপ হতে পারে, তাকে পুষ্টিকর খাবার খেতে যেমন বাবা মা’রাই শেখায়, কারো সাথে ঝগড়া মারামারি না করতে যেমন বাবা মা’রাই শেখায়, মিথ্যা কথা না বলতে যেমন বাবা মা’রাই শেখায়, ভালভাবে পড়ালেখা করতে যেমন বাবা মা’রাই শেখায়, তেমনি এই বয়সে শরীরে এবং মনে যখন পরিবর্তন আসবে সেই পরিবর্তন সম্পর্কে আগেভাগে সন্তানকে অবগত করা বাবা মা’দেরই দায়িত্ব।

এই দায়িত্ব পালন না করে সব শেখার দায়ভার সন্তানের উপর ছেড়ে দিলে সন্তান যেটা ভাল মনে করবে সেটাই বেছে নেবে। তখন সকল কর্মফলের দায়ভারও আমরা সন্তানের উপর ছেড়ে দিয়ে সন্তানকেই ভিলেন বানিয়ে নিজেরা নিষ্পাপ হয়ে যাই।

তবে খেয়াল রাখতে হবে শিক্ষা দেওয়ার মানে এই না যে উঠতে বসতে তাকে শুধু “না” শোনানো। সকল বিষয়ে ‘না’ বাচ্চাদের আরও জানার ইচ্ছের দিকে ঠেলে দেয়।

নতুন জানতে জানতে সে কখন কোন খারাপ পথে চলে যায় সে তা নিজেও জানে না। সবচেয়ে ভয়ংকর তার সঙ্গ যদি খারাপ হয় তবে দিহানের মত চরিত্র গঠন হওয়া খুবই স্বাভাবিক। যার পরিণতি হতে পারে আনুশকার মত। খুব নিশ্চিতভাবেই বলা যায়, দিহান বা আনুশকা, কারো পরিবারই তাদের বয়ঃসন্ধিকাল সম্পর্কে সঠিক শিক্ষা দেয় নি। কেউ তাদের শেখায় নি এই বয়সে ছেলে মেয়েদের মধ্যে কেমন সম্পর্ক হওয়া উচিত। কতটুকু সীমার মধ্যে থাকতে হয়। কোন চাহিদাকে গুরুত্ব দিতে হয় আর কোনটাকে এড়িয়ে চলতে হয়।

বন্ধুর সাথে যা শেয়ার করা যায় তা কেন বাবা মাদের সাথে শেয়ার করা যাবে না এই প্রশ্ন বাবা মা’রা নিজেরাই নিজেদের করুক। শারীরিক সম্পর্ক কী কেন কখন প্রয়োজন, বয়সের চাহিদা অনুযায়ী কখন কী করা উচিত কেন উচিত কেন উচিত না এই বিষয়ে তারা সন্তানদের সঠিক শিক্ষা না দিয়ে সন্তানের বিপদের পরে হাহুতাশ করে কী ফায়দা!

বড় হলে বুঝে যাবে এই বোধ আসতে আসতে অনেক সময় দেরি হয়ে যায়। তখন চাইলেই আর স্বাভাবিক হওয়া যায় না। এই বয়সের অনেক ভয়ানক স্মৃতি তৈরি হয়ে যেতে পারে যা বয়ে বেড়াতে হয় আজীবন। গোপনে আড়ালে ঘটে যেতে পারে অনেক অনাকাঙ্ক্ষিত ঘটনা বিশেষ করে মেয়েদের জীবনে, যা সে না কারও সাথে শেয়ার করতে পারে, না কাউকে বলতে পারে।

মা সবচেয়ে আপন। অথচ এই বয়সে এমনই এক দূরত্ব সৃষ্টি হয় যাতে মাও হয়ে যায় অনেক দূরের। এই দূরত্ব সন্তান অতিক্রম করতে পারে না। পারে মা। মাকেই এখানে বন্ধুর ভূমিকা নিতে হয়। অথচ আমাদের দুর্ভাগ্য যে এই বয়সে সন্তান পরিবারে কাউকেই বন্ধু হিসেবে পায় না। পায় অভিভাবক। যাকে সে মনে করে তার সকল চিন্তা ভাবনা কর্ম থেকে গোপন করার মানুষ।

“আমরা যেভাবে বুঝে নিয়েছি সেভাবে সন্তানরাও বুঝে নেবে” থিউরি দিয়ে চলা সম্ভব না সেটা অভিভাবকদের সবার আগে বুঝতে হবে। সময়ের পরিবর্তন অস্বীকার করে বাস্তবতা অস্বীকার করা যাবে না।

আমাদের বোধোদয় হোক। আমরা যেন আমাদের সন্তানদের বুঝতে পারি।  আমরা যেন শুধু অভিভাবক না হয়ে সন্তানের বন্ধু হতে পারি সব বয়সে।

[ফেমিনিস্ট ফ্যাক্টরে প্রকাশিত মুক্তমত লেখকের নিজস্ব বক্তব্য]