November 24, 2024
সাহিত্যআরও ভাবনাফিচার ৩

আলো অন্ধকারে যাই

মাসকাওয়াথ আহসান।। ইরাক যুদ্ধের কাল। রাতের অন্ধকারে সার্চ লাইট ফেলে বাগদাদে বোমা ফেলছে মার্কিন মেরিনেরা। অসহায় পুরবাসীর আর্তনাদ শোনা যাচ্ছে টিভি ফুটেজে। আবু ঘ্রাইব কারাগারে অকথ্য নির্যাতন চলছে ইরাকি সেনাদের ওপর। ইরাকে কোন জনবিনাশী মারনাস্ত্র নেই; আন্তর্জাতিক পারমানবিক নিয়ন্ত্রক সংস্থা ইরাক পরিদর্শন করে; এমন কোন অস্ত্রের চিহ্ন খুঁজে পায়নি। তারা জাতিসংঘকে সেটা জানিয়েছে। জাতিসংঘের পরিদর্শকেরাও সাক্ষ্য দিচ্ছেন, ইরাকে জনবিনাশী রাসায়নিক অস্ত্র নেই। জাতিসংঘ মহাসচিব কফি আনান, বার বার আহবান জানাচ্ছেন; এ মানবতাবিরোধী যুদ্ধ বন্ধ করো। কিন্তু বুশ-ব্লেয়ারের মাথায় খুন চেপেছে; তারা ইরাকিদের হত্যায়-নারী ধর্ষণে বদ্ধ পরিকর। এ তাদের ক্রুসেড যেন।

এরকম একটা রিপোর্ট লেখার ব্যস্ত সময়ে জার্মান সাংবাদিক গ্রোয়েটে এসে বলে, ন্যাস্টি ওয়ার; রুথলেস, বার্বারাস। এই যে হলিউড বার বার টাইম মেশিনে চড়িয়ে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের গল্পে নিয়ে গিয়ে জার্মানদের খুনী হিসেবে দেখায় প্রতিদিন; ওদের কি চোখে পড়ে না; দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর এমেরিকার সৈন্যরা গিয়ে ভিয়েতনাম থেকে মধ্যপ্রাচ্য; কী খুনাখুনিটা করে বেড়াচ্ছে! নারী ধর্ষণ করছে; ভাবা যায় বলো!

– এমেরিকানরা মিডিয়া ইলিউশান দিয়ে বার বার তোমাদের পুরোনো অপকর্মের কথা বলে নিজেদের চলমান অপকর্ম ঢেকে রাখতে চেষ্টা করে। দেখতে পাচ্ছো না; মিডিয়া এথিকস ভেঙ্গে কীভাবে বিবিসি-সিএনএন-এর সাংবাদিকেরা এমবেডেড জার্নালিজম করছে। আমানপোর আপা অংকশায়িনী হয়েছেন মেরিনের ট্যাংকের ভেতরে। সেখান থেকে মাথা তুলে পিটিসি দিচ্ছে, সাদ্দাম একজন টেররিস্ট; তাকে দমন না করলে; গোটা পৃথিবীতে টেররিজম ছড়িয়ে পড়বে। অথচ কী আইরনি দেখো; যুক্তরাষ্ট্রের বুশ আর যুক্তরাজ্যের ব্লেয়ারের চেয়ে বড় কোন টেররিস্ট এই পৃথিবীতে আছে নাকি!

গ্রোয়েটে কাঁধে হাত রেখে বলে, ডেস্কে বসে দিনের পর দিন এই ওয়ার কাভার করতে করতে আমাদের পিটিএসডি হয়ে যাবে বললাম; হত্যা-ধর্ষণের অংক কষে কষে আমরা পাগল হয়ে যাবো যে। আমি তো প্রেমিক মানুষ; ডন জুয়ান; আমি নারী ধর্ষণ সহ্য করতে পারিনা। ভালোবাসা দিয়ে পৃথিবী জয় করা যায়; কিন্তু প্রতিহিংসার রিরংসায় পৃথিবীটা হয়ে ওঠে জ্বলন্ত নরক; এটা আমি বিশ্বাস করি। ইস ফুলের মতো মেয়েগুলো ইরাকের; তাদের কোমল শরীরে ঝাঁপিয়ে পড়ছে বুনো জন্তুগুলো।

গ্রোয়েটে ইন্দোলজির ছাত্র ছিলো হাইডেলবার্গ বিশ্ববিদ্যালয়ে; শ্রীকৃষ্ণের ভক্ত। ভারতে গিয়ে দীর্ঘকাল কাটিয়েছে “দম মারো দম; হরে কৃষ্ণ হরে রাম” করে। প্রচলিত অর্থে সংসারী হবার লোক নয়; বাউল মন তার। মাঝে মাঝে ছুটি নিয়ে ভারতের নানা আশ্রমে চলে যাওয়ায়; সাংবাদিকতার কেরিয়ারেও কিছুটা পিছিয়ে পড়েছে; প্রডিউসার হিসেবে সপ্তাহে চারদিন কাজ করে; বাকি তিনদিন চিন্তার ছুটি তার। ওর কথা হলো; একটাই জীবন; কী হবে এতো হিসেব কষে! প্রেমের উষ্ণতা দিয়ে সে শীত তাড়ায়; তবু ফায়ার প্লেসে আগুন জ্বালে না। অগ্নি ওর কাছে খুব অপছন্দের বিষয়।

সে ডন জুয়ানের ভঙ্গিতে মার্লবরো সিগেরেটে টান দিয়ে বলে, হের রিডাকটিওর (সম্পাদক); আমি এই ইরাক যুদ্ধের বিভীষিকায় বার্নট আউট। আজ প্রেমের বাগানে ফুল কুড়াতে যাবো। চলো তোমাকে নিয়ে যাই।

ইতস্তত দেখে বলে, কী ব্যাপার ধর্মযাজক হয়ে যাচ্ছো নাকি! কেউ তো কামড় দিচ্ছে না তোমাকে। তুমি বসে বসে ইউরোপের নন্দন কাননের ব্রজগোপীদের হোলি খেলা দেখবে কেবল। আরে বাবা আমি তো এমেরিকান মেরিন নই; আমি গ্যোয়েটে; আমি যাই প্রেমের বীণায় সুর তুলতে। বিশ্বাস করো; আমি কেবলই প্রেমিক। কেউ যদি ভালোবেসে প্রসাদ দেয়; আমি অঞ্জলি ভরে সেই দেবীর পূজা করি।

ট্যাক্সিতে করে পৌঁছে যাই নন্দন কাননে। গ্রোয়েটেকে দেখে সেই স্বপ্নগৃহের দেবীরা এমন লাস্যে হাসে; যেন অনেকদিন পর কৃষ্ণ এসেছে; রাধার কাছে। মিথ্যা বলেনি সে, ডন জুয়ানের মতো উড়ন্ত চুম্বন ছুঁড়ে ছুঁড়ে দিয়ে সন্ধাটাতে দোলা দেয় সে।

ফোনে একটা টেক্সট করি স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে। উত্তর আসে, রিল্যাক্স; জীবনে কখনো এরকম সাঁঝের গল্প লিখবে কিন্তু। মহৎ লেখক হতে গেলে গল্প বলায় সৎ হতে হয়। মনে রেখো আমি একজন লেখকের জীবনের বন্ধু স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়। দক্ষিণ এশিয়ার কোন স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় নই যে, সত্য বলার দায়ে লেখককে কারাগারে ছুঁড়ে ফেলবো; তাকে মেরে ফেলবো। বোঝেনা; লেখককে বাঁচতে হয়; তাহলে যে জীবন জেগে ওঠে। প্লিজ পেইন্ট দ্য সিটি রেড।
গ্রোয়েটে তখন এতো ব্যস্ত যে; তাকে জিজ্ঞেস করতে গেলে; তা তো হোলো গ্রোয়েটে এখন আমি কী করবো এখানে! সে বলে ঠোঁটে আঙ্গুল তুলে বলে, দোহাই চুপ কর ওরে; ভালোবাসিবারে দে একবার।

বাধ্য হয়ে লাতিন এমেরিকার একজন ‘চুল তার কবেকার অন্ধকার বিদিশার নেশা’কে বললাম, তোমার সঙ্গে কী একটু ‘মুখোমুখি বসা’ যাবে ‘বনলতা সেন’?

সে তার অজন্তার-ইলোরার ঘরে নিয়ে যায়। খুব পরিপাটি করে সাজানো। দেয়ালে নানা রঙের মরিচ বাতির আলো আঁধারিতে চকিতে চোখে পড়লো, ছোট্ট একটা নক্সী ফ্রেমে মার্কেজের ছবি। বিস্ময়ের ঘোর তো কাটেনা।
– তুমি মার্কেজ পড়ো।
– মার্কেজের বই কলম্বিয়ার বাসে-ট্রেনে বিক্রি হয়। নতুন বই আসার হাঁক দিয়ে যায় হকার। বলো কী তুমি! সে আমাদের গর্ব।
– তা তুমি এতো সুন্দর দেশ কলম্বিয়া ছেড়ে এই বনবাসে যে!
– সে এক লম্বা গল্প। চলো তার চেয়ে প্রেমের খুনসুঁটি করি!
– আমি যে প্রেমিক নই। আমার বন্ধু এসেছে; তাকে সঙ্গ দিতে এসেছি। কিন্তু ভয় নেই; আমি এখানে বসে থাকার জন্য যতটা সময় নষ্ট হবে; তা পূরণ করে দেবো! তোমার নামই তো জানা হলোনা।
– লিযেথ; দাদু আদর করে লিলিথ বলে ডাকতেন। পরে কী হলো জানো; আমার আর ইভ হওয়া হলো না; লিলিথের মতোই হলো আমার জীবনটা।
– দুঃখ করোনা; সবারই জীবনে কোন না কোন দুঃখ থাকে।
– আমি তো নাহয় কলাম্বিয়া মাফিয়াদের হাতে পড়ে পাচার হয়ে বনবাসে এলাম! কিন্তু তুমি এই বনবাসে কেন?
– আমার দেশের পলিটিক্যাল মাফিয়াদের হাত থেকে বাঁচতে আমিও নির্বাসনে এলাম। আমরা দুজনেই দুঃখী মানুষ লিযেথ।

লিযেথ ঝর্ণাধারার মতো করে হাসে। সোফার হাতলে বসে; ব্ল্যাক আই মেক আপ করা দীঘল চোখে বলে, গ্রোয়েটের বন্ধু তুমি; জার্নালিস্ট। আমার দুঃখের সঙ্গে তোমার দুঃখের তুলনা কোরোনা!
– তোমার যেমন উপায় নেই তোমার স্বজনদের কাছে ফিরে যাবার; তেমনি আমারও নেই। তুমি যেমন মায়ের হাতের ক্রিসমাস কেক খেতে পারো না; আমিও আমার মায়ের হাতের ঈদের ডিমের হালুয়া খেতে পারিনা।

লিযেথ মিউজিক প্লেয়ারে স্প্যানিশ গান বাজিয়ে দিয়ে হাত বাড়িয়ে দেয়, – তুমি তো কাঁদতে আসোনি; চলো উল্লাস করি।
– এক কাজ করো তুমি তোমার এই ড্রেসটা পালটে তোমার প্রিয় পোশাকটা পরো। চলো গল্প করি।
লিযেথ কটাক্ষ করে কাঁধে নখের আঁচড় কেটে জিজ্ঞেস করে, তুমি গে নাকি গো!
এর মাঝে গ্রোয়েটে খানিকটা সম্বিত ফিরে পেয়ে খুশিজলের নেশায় চুর হয়ে টলতে টলতে এসে; দরজা নক করে খুলে বাইরে থেকেই জিজ্ঞেস করে, আলেস ক্লা! সব ঠিক আছে তো হের রিডাকটিওর!

লিযেথের দিকে তাকিয়ে বলে, ও কিন্তু ফিকশান রাইটার। পলিটিক্যাল ফিকশান লেখে। আমি যাই; সময় কোথায়; সময় নষ্ট করার!

লিযেথ যেন অনেক আনন্দ পায়। আলমিরা থেকে মার্কেজের স্প্যানিশ বইগুলো বের করে। হাতে সেগুলো দিয়েই ‘ওয়ান মোমেন্তো’ বলে পাশের ঘরে গিয়ে কিছুক্ষণের জন্য হাওয়া হয়ে যায়।

স্প্যানিশ পড়তে না পারলেও মার্কেজের ছবির উদাত্ত হাসি দেখে মন ভরে যায়। আহা জাদুবাস্তবতার ঈশ্বর; সে বলে ‘কুন’; অমনি গল্পগুলো জ্যান্ত হয়ে হাঁটাহাটি শুরু করে জগতমঞ্চে।

লিযেথ ফিরে আসে লং স্কার্ট আর কালো ফুলহাতা জামা পরে। খুশিজলের গ্লাস এগিয়ে দিয়ে জিজ্ঞেস করে, তা এখন কী লিখছো!
– পলিটিক্যাল মাফিয়ারা রেলিজনের ফুট সোলজারদের নিয়ে যে পুতুল নাচের ইতিকথা লিখে চলেছে; আমি শুধু তা কপি করে যাই। বছর শেষে তা একটা উপন্যাস হয়ে ওঠে। দেশে আমার বন্ধুরা তা ছাপে। বন্ধুরাই পড়ে। খুব একটা পরিচিত লেখক নই আমি; আই এম আ ফ্লপ রাইটার। পলিটিক্যাল ‘রাজভোঁদড়ে’রা আমাকে গাছবলদ বলে। আর পরিচিত লেখক হতে গেলে যতটা সৃজনশীল বা মননশীল হতে হয়; তা আমার নেই। তাই নিউজপেপারের “সফল যারা কেমন তারা” লেখকদের সেরা দশে আমার বইয়ের নাম থাকেনা। ঘাড় কাৎ করে একটা ছবি ছাপে নাগো লিযিথ; এই দুঃখ কোথায় রাখি; আমার বড্ড কান্না পাচ্ছে যে!

লিযিথ চিবুকে আঙ্গুল দিয়ে বলে, তোমাকে কেউ বলেনি যে তুমি লোকটা অনেক ফচকে!
– সে সার্টিফিকেট আছে বেশ কতক। রাখো আমার কথা। তোমার কথা বলো।

লিযিথ রহস্য করে বলে, উঁহু তা হচ্ছে না। আমার সঙ্গে সালসা নাচ নাচতে হবে। নইলে কোন কথা নেই।

– সালসা শিখিনি যে!
– নাচাতে পারো আর নাচতে পারো না; এ আমি বিশ্বাস করি না। ঢং দেখাও কেন! আমি তো নিউজ পেপারের বোকা লিটেরেরি এডিটর নইগো যে আমাকে বোকা বানাবে!
লিযেথই নাচে; সঙ্গে দাঁড়িয়ে একটু ঢেঁকিতে পাড় দেবার ভঙ্গি করলেই বেশ সালসা পার্টনার হওয়া যায়।
লিযেথ নাচতে নাচতে বলে, জার্মানিতে ভালো চাকরি দেবার কথা বলেই আমাকে রাজি করিয়েছিলো ওরা; তারপর শুরু করলো ঝাকা নাকা। বোঝালো, হোয়াইট কলার জব করলে বড় জোর দুই হাজার ইউরো ইনকাম প্রতি মাসে; দেশে পাঠাবে কী! তার চেয়ে হোয়াইট কলারদের কলার ধরে ঝাঁকাও; দেখবে ইউরো ঝরছে তো ঝরছেই। জার্মান ক্যাশকাউগুলো আসে। বিয়ার খেয়ে আধমরা হয়ে পড়ে; বাউন্সাররা ধরে ট্যাক্সিতে তুলে দেয়।
– ভালোই তো বাকরা বানানোর ব্যবসা ফেঁদেছো!
– আবার কী! ক্যাপিটালিজম মানেই বাকরা বানানো; সে কি তুমি বোঝোনা ডিয়ার ফ্লপ রাইটার।

লিযেথের হাত ধরে তার মাথার ওপর দিয়ে ঘুরিয়ে দিলে; সে ঘরময় গোল্লাছুট খেলে ফিরে আসে প্রশ্বাস দূরত্বে।
এবার সে বলে, টাকা জমাচ্ছি। এইতো আর কিছুদিন। এরপর এসব বাকরা বানানোর ব্যবসা ছেড়ে একটা কিয়স্কের ব্যবসা শুরু করবো। লিযেথের দোকান থেকে ফুল কিনবে না এমন কোন কাস্টমার জন্মেছে নাকি!
– সত্যিই জন্মায়নি। যদি জন্মেও থাকে তবে সে জন্ম মিছে লিযেথ। আমি তোমার কিয়স্ক থেকে ফুল কিনে তোমাকেই উপহার দেবো প্রথম দিন।

“সব পাখি ঘরে ফেরে; সব নদী ফুরায় এ জীবনের লেনদেন; থাকে শুধু ‘আলো-অন্ধকার’ মুখোমুখি বসিবার; বোগোতার ‘লিযেথ’ সেন।”