September 20, 2024
কলামফিচার ৩

কবরীর বোঝাপড়া

মেহেদী হাসান।। আমাদের পুরুষতান্ত্রিক গড়নের সমাজে কবরীর মতো নারী ব্রাত্য, তাই বর্জনীয়। তিনি হিন্দু থেকে মুসলমান হয়েছিলেন। তাই নজরুলের বিয়ের মতো তিনিও হিন্দু সমাজের কাছে গ্রহণীয় হবার কথা নয়। পেশা ছিলো চলচ্চিত্রে অভিনয়। এ কারণে মুসলমান সমাজেও তিনি যে আদরণীয় হবেন এমন নয়। আমরা লিখতেই পারি বাংলাদেশের প্রধান দুটো ধর্ম সম্প্রদায়ের সন্দেহের মধ্য দিয়ে তাঁর বেড়ে ওঠা।

জন্মসূত্রে তিনি দুটো নিম্নবর্গত্ব পেয়ে বড় হয়েছিলেন। তাঁর জন্ম নাম মিনা পাল। যে পাকিস্তান রাষ্ট্রে তাঁর জন্ম ও বেড়ে ওঠা সে রাষ্ট্রে এ নাম সংখ্যালঘুত্ব শুধু নিশ্চিত করে না, নাগরিকের সাধারণ অধিকারেও এক ধরনের প্রতিবন্ধকতা তৈরি করে। তবু তিনি তের বছর বয়সে সুভাষ দত্তের কল্যাণে ‘সুতরাং’ ছবিতে কেন্দ্রীয় নারী চরিত্র করতে পেরেছিলেন। জন্মগত প্রতিভা থাকলে এমনই হয়। দুর্দান্ত ভাবে তিনটা চারটা ছবি করেই বাজিমাৎ করে দেন। কিন্তু এটা তাঁর আরেকটা নিম্নবর্গত্ব ঘুচাতে পারে নি। তাই লৈঙ্গিক নিম্নবর্গত্ব তাঁকে গ্রাস করে। সে সঙ্গে বলতে ভুলে গেছি পরিবারটির আর্থিক টানাপোড়েনও যুক্ত ছিলো। তাই তাঁকে ইচ্ছে নয়, এমন একটা বিয়ে করতে হয়।

মিনা পালে তিনি আটকে থাকার মেয়ে নন। তাই তিনি ২৮ বছর বয়সে আবার বিয়ে করেন। হয়ে ওঠেন করবী সারোয়ার। কিন্তু যে পরিবারটিতে তাঁর বিয়ে হয়, এর সামন্ত-আভিজাত্য অনেক বেশি পুরুষতান্ত্রিক। এর জান্তব রূপটা দেখতে পেলেন যখন বিয়ের প্রায় তিরিশ বছর পর ২০০৮ সালে রাজনীতিতে নাম লেখানোর ইচ্ছে হলো তখন। পার্লামেন্টের সদস্য হওয়ার দাবি করা তাঁর জন্য বড় কোনো যোগ্যতার পরিচয় দেওয়ার বিষয় ছিল না। নিজে মুক্তিযোদ্ধা ছিলেন, ব্যাপক সামাজিক পরিচয় ছিল, তার ওপর শ্বশুরবাড়ির রাজনৈতিক পরিচয় দেশজোড়া। তাঁর জন্য এমপি হওয়া সাধারণ দাবিই বলা যায়। কিন্তু পুরুষতন্ত্রের ঘাপটি মেরে থাকা হিংস্র রূপটা দেখতে পেলেন এবার। অভিজাত পরিবারটির তিনি যে একজন হয়ে উঠতে পারেন নি তা তো নারী বলেই। একই পদের অন্য একজন পারিবারিক পুরুষ সদস্য নমিনেশন না পেয়ে কবরী সারোয়ার পেলেন- এটা তাঁর জন্য কাল হলো। একেবারে সরাসরি ডিভোর্স লেটার পেয়ে গেলেন।

কবরী কি দমে গিয়েছিলেন এতে? না, দমেন নি। এমপি তিনি ঠিকই হয়েছিলেন। দায়িত্বটি তিনি নানা ধরনের বাধাবিপত্তি অতিক্রম করে ঠিকই পালন করতে পেরেছিলেন সফলভাবে।

আমাদের মনে প্রশ্ন জাগে, কবরী কি নারীবাদী ছিলেন? বারবার পুরুষতন্ত্রের কাছে হোঁচট খেয়ে নারীবাদী হিসেবে জেগে উঠেছিলেন? না, বিষয়টা সে রকম কিছু নয়। তাঁর সম্পর্কে একবার ঋত্বিক বলেছিলেন, বাংলার ‘মাতৃময়ী’ রূপ। বিষয়টা তেমনই। তিনি একেবারেই আটপৌরে একজন নারী। সারাজীবন নিঃসঙ্গ থেকেছেন। বলেছেন, ‘‘আমি একলা মানুষ।’’ একা যে থাকতে হয়েছে সেটা কেবল নারী বলেই। না হয় নিজেই বলেছেন, ‘‘আমার একটা দুঃখ রয়ে গেল, জীবনে আমি একজন ভালো বন্ধু পেলাম না, ভালো স্বামী পেলাম না। সন্তানেরা অনেকটা যার যার মতো করে আছে। কিন্তু সঙ্গ দেওয়ার মতো একজন ভালো মানুষ আমি পাইনি, যাকে বলতে পারি, এসো, এক কাপ চা খাই, একটু গল্প করি। এটাই হয়তো মানুষের জীবন। তবে মানুষের চাওয়ার তো শেষ নেই। মনে হয়, যদি আমার একজন বন্ধু থাকত, তাহলে যখন-তখন তার সঙ্গ পেতাম। এই আনন্দটুকু আমি পাইনি। এটা আমার জীবনের সবচেয়ে বড় আফসোস। আমি দিতে পারি। সারা জীবন অনেক দিয়েছি। কিন্তু নিতে আমার খুবই কষ্ট। কারণ মনে হয় যে নিজে নিতে গেলে আমি ছোট হয়ে যাব।’’

এ আকুতি আটপৌরে কোনো নারীর বলে মনে হয়। যে বেদনা বিকশিত হবার পথে সব নারীকে বহন করতে হয়। দারিদ্র, ধর্মীয় পরিচয় পরিবর্তন আর বিয়ের আকুতির কারণে তাঁকে বেশি বয়ে বেড়াতে হয়েছে, এই যা।

 

[ফেমিনিস্ট ফ্যাক্টরে প্রকাশিত কলাম লেখকের নিজস্ব বক্তব্য]