September 20, 2024
ফিচার ৩মুক্তমত

এ যুগের যুগলদের পুরোনো চিন্তা-নৈতিকতার মাপকাঠিতে মাপলে চলবে না

সৈয়দ মাহী আহমদ।। বাংলাদেশসহ পুরো পৃথিবীতে এখন সম্ভবত আলোচিত বিষয় বিল ও মেলিন্ডার বিবাহ-বিচ্ছেদ। উন্নত বিশ্বে, বিশেষ করে যেসব দেশ অর্থনীতি ও চিন্তায় উন্নত, সেখানে এ বিষয়ে কম আলোচনা হলেও আমাদের সমাজে তা অনেক বেশি আলোচিত। আমাদের অনেকেই হতাশা প্রকাশ করেছেন, ২৭ বছরের সংসার ভেস্তে গেলো বলে। সংসার এক বছরেও যেমন ভেঙে যেতে পারে, তেমনি পঞ্চাশ বছরেও ভেঙে যেতে পারে। প্রেম-ভালোবাসা-একসাথে থাকার বিষয়টি সবসময় সময়ের ওপর নির্ভরশীল- এই কল্পনাপ্রসূত-সত্যটি আমরা কোথায় পেলাম?

হ্যাঁ, অনেক সম্পর্ক আছে সারাজীবন টিকে থাকে। কিন্তু সেই সম্পর্ক টিকে থাকে ভালোবাসা, শ্রদ্ধা, সহযোগিতা ও পারস্পারিক সিদ্ধান্তের ওপর ভিত্তি করে। প্রেম, কাম, ইচ্ছা, আবেগ সব বয়সেই থাকে, তা তারুণ্য, যৌবন বা বৃদ্ধ যে বয়সেই হোক না কেন। আমাদের সমাজে অনেক সম্পর্ক টিকে থাকে সময়ের দোহাই দিয়ে। অনেকেই বলেন, “তোমার সাথে ২০ বছর সংসার হয়ে গেলো। আর বাঁচবই কতোদিন? তাহলে বাকি সময়, যতো বছরই পাই না কেন,  তোমার সাথে কাটিয়ে দেই তিক্ততা বা প্রেম-ভালোবাসা-কামের অনুপস্থিতিতে।

আমরা যা করি পাশ্চাত্য অনেকেই তার বিপরীত করে, কেননা তা না হলে তারা আমাদের মতোই অর্থনীতি, রাজনীতি, কর্ম ও ব্যক্তিগত সম্পর্কে অনুন্নত থেকে যাবে। তাদের কাছে সময়ের মূল্য অনেক। ভালোভাবে বেঁচে থাকার ইচ্ছাটাও প্রবল। আমরা যেখানে ৫০ বছর বা ৬০ বছর পর জীবনের সমাপ্তি ঘোষণা করি, জানটা বের হয়ে গেলে বাঁচি। তারা সেখানে ষাটোর্ধ্ব হওয়ার পরও জীবন ও পৃথিবী নিয়ে স্বপ্ন দেখে, বিরামহীন কাজ করে যায়। শেষ বয়সেও তাদের কর্মদক্ষতা, উদ্ভাবনদক্ষতা ও কাজের উদ্যম অটুট থাকে। তাই তারা জীবনকে তা যে বয়সেই হোক-না কেন, বিষিয়ে তুলতে চায় না; চায় না তাদের পথচলা বন্ধ করতে। আর চায় না বলেই তারা সম্পর্ককে সমাপ্ত করে আবার পুনরায় চলতে শুরু করে। আর কর্মের সাথে অবশ্যই প্রেম, আনন্দ ও স্বতস্ফূর্ততার গুরুত্বপূর্ণ ইতিবাচক সম্পর্ক রয়েছে।

অনেকেই বলছেন, “দেখেন, টাকাপয়সা মানসিক শান্তি নিয়ে আসতে পারে না। বিল ও মেলিন্ডার এতো টাকা, কিন্তু মানসিক শান্তি নাই।” তারা কীভাবে বুঝলেন তাদের মানসিক অশান্তি বিরাজ করছে! বিচ্ছেদ কি মানুষ শুধুই মানসিক শান্তি-অশান্তি থেকে করে? কতশত কারণে বিচ্ছেদ হতে পারে। এতো বছর একসাথে চলার পর হয়ত বা একজন অপরজনের প্রতি আকর্ষণ হারিয়ে ফেলেছেন; হয়তবা এখন অন্য অনেক কাজে মনোযোগ দিতে চান (অনেক তো সংসার করলেন); দু’জনের মাঝে কেউ/উভয়ই একা থাকতে চাচ্ছেন- এরকম অজস্র কারণ থাকতে পারে/আছে। আমি, আপনি কাউকে বিচার করা বা কারো বিষয়ের সিদ্ধান্ত টানার কে?

আবার, একদল দেখলাম যে, বলছেন, “মেলিন্ডা এখন বিচ্ছেদপ্রাপ্ত টাকা থেকে ধনী হয়ে যাবেন।” তারা হিসাব-নিকাশ করে বের করছেন মেলিন্ডা কতো টাকা পাবেন। মেলিন্ডা’রা আসলে হিসেব করেন না যে, বিয়ে বা বিচ্ছেদ হলে কতো টাকা পাবেন আর পাবেন না। তারা আমাদের মতো অর্থ-বিত্ত, সম্মান, চাকরি দেখে একসাথে থাকা বা না-থাকার সিদ্ধান্ত নেন না। মেলিন্ডা বেকার না, মাইক্রোসফট-এ কাজ করেছিলেন, দাতব্য প্রতিষ্ঠান গড়ে তুলেছিলেন এবং এখনও তুলছেন, বই লিখছেন, বক্তৃতা দিচ্ছেন। আর মেলিন্ডা বা বিল এর টাকার লোভ যদি থাকত, তাহলে দু’জনে আলাদা হতেন না; একসাথে থাকতেন কারণ তারা এটা আমাদের চেয়ে ভালো জানেন যে, বিচ্ছিন্ন হলে তাদের সম্পত্তির পরিমাণ কমবে, সব কিছু  আইনানুযায়ী ভাগ হবে। তারা এটা বোঝেন সম্পত্তির চেয়ে আকর্ষণ, শ্রদ্ধা, ভালোবাসা ও মনের গুরুত্ব বেশি। বরং আমাদের সমাজে উল্টোটা দেখা যায়, অনেক নারী শুধুমাত্র স্বামী উচ্চবিত্ত হওয়ার কারণে মনের মিল, প্রেমের অভাব থাকা সত্ত্বেও সংসার করে যাচ্ছেন, বিচ্ছেদ দিচ্ছেন না; অনেক পুরুষ আবার স্ত্রীর সাথে আনুষ্ঠানিক সম্পর্ক ছিন্ন করেন না আইনিভাবে সম্পদ বণ্টন বা কমে যাওয়ার ভয়ে। লোভী তাহলে কারা? টাকা, সম্মান ও সম্পদের জন্য কারা সম্পর্ক টিকিয়ে রাখে? আমি পত্রিকা মারফত এটা জানলাম যে, মেলিন্ডা ভরণপোষণের জন্য বিলের থেকে টাকা নিতে অনিচ্ছুক (ওনার এরকম টাকা লাগবে না)। কাজেই, আমরা যে তাদেরকে লোভী বলি! আমরা কতোটুকু নির্লোভ?

বিল ও মেলিন্ডা আলাদা হয়ে যাচ্ছেন। তারা স্বামী-স্ত্রী না, কিন্তু তারা আবার ভালো বন্ধু, সঙ্গী বা পরামর্শক হিসেবে একে অপরের জীবনে থাকতে পারেন। তারা টুইট-এ বলেছেন, আমরা আর স্বামী-স্ত্রী হিসেবে জীবনযাপন করব তা আর বিশ্বাস করি না, কিন্তু আমরা দু’জনেই আমাদের কাজ একসাথে চালিয়ে নিয়ে যাবো। একটু কি দেখবেন তাদের সাথে আমাদের চিন্তার পার্থক্য? আমাদের যখন বিচ্ছেদ হয়, তখন পাড়ার একশো লোক জানে, মারামারি, তুমুল ঝগড়া হয়। বিচ্ছেদের পর আর একে অন্যের মুখ দেখি না; একজন অপরজনের বিরুদ্ধে কুৎসা ছড়াই, নোংরামি করি। আমরা কি পারবো তাদের মতো করে সম্মানজনক বিচ্ছেদ নিতে? পারব এটা বলতে আমি আর তোমার পার্টনার হিসেবে থাকতে চাই না, কিন্তু তোমার বন্ধু হিসেবে থাকব ও আমাদের অস মাপ্ত কাজ সমাপ্ত করব?

বিচ্ছেদ মানে সম্পর্ক নষ্ট হয়ে গেছে, পচে গেছে, আর তাই সম্পর্কের ইতি টানতে যাচ্ছি- এরকম ধারণা সেকেলে। বিচ্ছেদ মানে এটাও হয় আমরা আমাদের শ্রদ্ধা, সম্মান ও ভালোবাসাটুকুকে আগলে রাখছি, এতো বছর যে আমাদের মাঝে অনেক সুন্দর ও ভালোবাসার সম্পর্ক ছিল তা দু’জনেই স্বীকার করছি এবং এখন যৌথ সিদ্ধান্তেই দু’জনই নতুন জীবনের দিকে যাত্রা করছি।

আমাদের দেশে অনেক নারী আছেন যারা অনেক কিছুর ভয়ে আলাদা হতে পারেন না। নিজেদেরকে মানিয়ে নেন। আর মানিয়ে নেন বলেই তাদের দ্বারা প্রাত্যহিক কাজ হয়, উদ্ভাবনী কাজ হয় না; কারণ সৃষ্টিশীল ও মননশীল মানেই হলো নিজেকে না মানিয়ে নিয়ে বরং সৃষ্টিশীল ও উদ্ভাবনী হওয়া। আর কোনো নারীর যদি বিচ্ছেদ হয়, তাহলে তার ওপর নেমে আসে সামাজিক-মানসিক নিপীড়ন। নারীর চরিত্র ও মনকে একদম গিলে খাই আমরা। যে নারী বিবাহ-বিচ্ছেদ করেন, তারা আমাদের টাকাপয়সা চলেন না, আমাদেরকে এসে তাদের হতাশা ও অপ্রাপ্তির কথা বলেন না, তাই আমাদের তাদেরকে বিচার করার, কলঙ্ক দেওয়ার ও অপমান করার কোনো অধিকারই নেই। আর আমরা যদি তাদেরকে কোণঠাসা ও অপমান করা বন্ধ না-করি, তার অর্থ হলো এই যে আমরা এখনো সভ্য ও সংবেদনশীল হতে পারি নি। বিচ্ছেদ মানেই বিষণ্ণ ও খারাপ থাকা নয়, বিচ্ছেদ মানে ভালো ও নিজের মতো থাকা হতে পারে, হতে পারে একা থাকা, নিজের স্বপ্ন ও ইচ্ছাকে পূর্ণ করা।

বর্তমান সময়ে সম্পর্কের ধরন-ধারন খুব দ্রুত বদলাচ্ছে। টাকা ও টেকনোলজির কারণে মানুষের জীবনে নতুন অনেক কিছু যুক্ত হচ্ছে। মানুষের চিন্তা ও সংবেদনশীলতার পরিধিও বেড়ে যাচ্ছে। পুরনো অনেক নীতি-নৈতিকতা বিচূর্ণ হয়ে নতুন নীতি-নৈতিকতার উদ্ভব ঘটছে। কাজেই এখনকার যুগলদেরকে আমাদের পূর্ববর্তী ও প্রচলিত নীতি-নৈতিকতার মাপকাঠিতে মাপলে চলবে না।

 

[ফেমিনিস্ট ফ্যাক্টরে প্রকাশিত মুক্তমত লেখকের নিজস্ব বক্তব্য]