May 15, 2024
ফিচার ৩মুক্তমত

পরকীয়ার সমীকরণ- ঘরেরটা খাবো আর তলারটা কুড়াবো

রুখসানা কাঁকন।। পরকীয়া একটা ঝড়ের  মতো। হঠাৎ আঘাত করে, উড়ে এসে উল্টোপাল্টা করে দেয় জীবন।  একটা পরিবারের অনেক ক্ষতি করে। যে পরকীয়া করে সে প্রায়শই তার সঙ্গীর নানা দোষ খুঁজে পায়। যেমন বলে- আমার সঙ্গী মিথ্যা কথা বলে, আমাকে সব বিষয়ে দোষ দেয়, ডোমিনেট করে বা আমার যৌনজীবন সুখের না। কিন্তু তারা বোঝে না, পরকীয়া চিরস্থায়ী সুখ নিয়ে আসে না।

সে মনে করে, তার অবৈধ সম্পর্কটি আবিষ্কার হলে তার সঙ্গী শুধুমাত্র আঘাত পাবে। কিন্তু পরকীয়া করার ফলাফল এইটুকু মাত্র নয়। সে তার পরিবার পরিজনসহ সকলকে ক্ষতবিক্ষত করে। পরকীয়া যারা করে, তাদের অনেকে মনে করে আমি তো সংসার ভাঙ্গছি না। বরং আমি বাজার থেকে যেমন রুটি চাল আটা নিয়ে আসি, তেমনি  অন্য কারু কাছ থেকে  ভালোবাসা নিয়ে আসছি! এটি একটি হাস্যকর ভাবনা।

পরকীয়া প্লেটনিক- এই দর্শনের বিশ্বাসযোগ্যতা খুবই কম। পরকিয়ার শেষ স্টেশন শারীরিক প্রেম যার প্রভাব বিবাহিত জীবনকে আঘাত করতে বাধ্য। ঘরেরটা খাবো আর গাছের তলারটা কুড়াবো- এই সমীকরণ মিলিয়ে ফেলা খুবই কঠিন। যে সংসারে তথাকথিত “না” পাওয়ার অভাবে আপনি পরকীয়া করেছেন, সঙ্গীর হাতে ধরা খাওয়ার  পর আপনি নিজেই ঝাঁপিয়ে পড়বেন সেই সংসার রক্ষা করতে।

তাই বলতে চাই,  যিনি পরকীয়া করছেন, তার স্বীকার করা উচিত যে সে তার আচরণের জন্য শতভাগ দায়বদ্ধ এবং তার খারাপ আচরণ তার কাছের মানুষ প্রত্যেকের উপর নেতিবাচক প্রভাব ফেলেছে।

বিবাহবহির্ভুত পরকীয়ার সম্পর্ক একটি পরিবারকে আঘাত করে আর সেই সম্পর্কে যদি সন্তানরা থাকে, তবে  তারা মারাত্মকভাবে ক্ষতিগ্রস্থ হয়। ‘When a house burns down, the children along with the adults become homeless’. যেহেতু শিশুরাও আহত হয় তাই কিছুই ঘটেনি বা কিছুই পরিবর্তিত হয়নি বলে ভান করলে, তাদের আরও বড় ক্ষতি  করা  হয়।  শিশুরা ভেবেই নেয় একটা ভয়াবহ কিছু ঘটছে আর তারা এ সম্পর্কে কথা বলতে পারছে না। তখন তারা নিজের বাবা মার কাছে নিরাপত্তাহীনতায় ভোগে। তাই মানসিকভাবে ভেঙ্গে পরার আগে আপনার বাচ্চাদের সাথে কথা বলা দরকার। তাদের বয়স আর বোঝার ক্ষমতার উপর ভিত্তি করে কথা বলুন।

পরকীয়া বিবাহবিচ্ছেদের দিকে পরিচালিত করে। তিলতিল করে গড়ে ওঠা একটা পরিবারের সদস্যরা নৌকার যাত্রীদের মত। নৌকা ডুবে গেলে সবাই ডুবে যায়। প্রাপ্তবয়স্করা সাধারণত সাঁতার কেটে বেঁচে ওঠার সংগ্রাম করে  এগিয়ে যেতে পারে, কিন্তু  গবেষণা দেখায় যে প্রায়শই এটি শিশুদের ক্ষেত্রে হয় না। বাবা মার বিচ্ছেদ হওয়া বাচ্চাদের একাডেমিক, সামাজিক এবং মানসিক ব্যর্থতার ঝুঁকি বেড়ে যায়।

আপনি পরকীয়া করে সংসার ভেঙ্গে এখন যদি ডিভোর্স না চান, তখন আপনার আর আপনার সঙ্গীর উচিত হবে আপনাদের আবারো ভেবে দেখা, একসাথে আর সত্যিই থাকা যাবে কি না।  আর যদি সংসার নামের বলয়টি রক্ষা  করতে হবে ভাবেন, তখন  পেশাদার কোন মনস্তত্ববিদের সাহায্য নেন। ঝগড়া বা মারামারি করে আরো অনেক কিছু হারিয়ে  ফেলার আগে সমঝদারের মত আচরণ করুন।

পরকীয়া একটি প্রতারণা। যদি পরকীয়ায় জড়িত সঙ্গী তার খারাপ আচরণের জন্য অনুশোচনা করে, তাহলে হয়তো আবারো নতুন করে শুরু করা যায় দাম্পত্য জীবন, বিশেষত যদি পরিবারে বাচ্চারা থাকে। এক্ষেত্রে একজন দক্ষ  Couple Therapist এর সন্ধান করুন, কারণ অসুস্থ সম্পর্কের নিরাময় সম্পূর্ণ হয়েছে কি না সেই কেবল তিনিই নিশ্চিত করতে পারেন। আপনার যদি ভাঙ্গা হাড় থাকে তবে আপনি যেমন চিকিৎসা করার চেষ্টা করবেন, একইভাবে একটি ভাঙ্গা সম্পর্ক স্থির করার সময় পেশাদার সহায়তা নেওয়া জরুরি।

পেশাদার মনস্তত্ত্ববিদ না নিয়ে অনেক দম্পতি নিজেরাই সমঝোতামূলক জীবন শুরুর চেষ্টা করে। কিন্তু অবিশ্বাস ও অপরাধবোধ নিয়ে কোন সম্পর্ক পুরোপুরি পুনরুদ্ধার হয় না। এটি মেটাল ফ্রেমে বাঁধানো ছবির উপর মরিচার মত। ছবিটা আগের মত আকর্ষণীয় হয় না। দম্পতি যারা পরকীয়ার কারণে সৃষ্ট আঘাতগুলো সবটা নিরাময় করে না, তাদের মধ্যে থাকে কষ্টের স্মৃতি, আবেগের অস্থিরতা যা যেকোন সময় চরম কোন প্রতিক্রিয়া তৈরি করতে পারে।

পরকীয়ার ঘটনা এ সমাজে খুবই মুখরোচক। যিনি এটি করছেন তিনি তো বটেই, তার সঙ্গীও চিরকাল পরিবার ও বন্ধুদের কাছে নানাভাবে ছোট হয়।  এক্ষেত্রে আপনাদের বুঝতে হবে, কার সাথে সবকিছু শেয়ার করবেন আর কার সাথে না।

এই ক্ষেত্রে সমস্ত জীবনকে দুটি ভাগে ভাগ করা যায়- যে জিনিসগুলি আমরা পরিবর্তন করতে পারি এবং যে  জিনিসগুলি যা আমরা পরিবর্তন করতে পারি না। অন্য লোকেরা কীভাবে নেবে তা আপনি পরিবর্তন করতে পারবেন না। সর্বোত্তম কৌশলটি হল বাস্তবতাকে মেনে নেয়া এবং এটি মোকাবেলা করা। যদি নির্দিষ্ট কোন ব্যক্তি  আপনার অতীত নিয়ে আপনাকে বিব্রত করে এবং আপনি  সমস্যায় পড়েন তবে আপনি কিছুটা হলেও তাদের সাথে দূরত্ব তৈরি করতে পারেন এবং এটি করা উচিত।

মনে রাখবেন, পরকীয়া আপনার জীবনে আলো নয়, অন্ধকার বয়ে আনবে। এই সম্পর্কে জড়ানো মানুষগুলো হয় প্রতারক, ভন্ড বা ভীতু।  পরকীয়া  একটি সামাজিক অপরাধও বটে। তাই, একটি সম্পর্কের ভেতর থাকা অবস্থায় আরেকটি সম্পর্ক তৈরির আগেই নিজেকে প্রশ্ন করুন, শেষ পর্যন্ত এর পরিনতি কী হতে যাচ্ছে!

রুখসানা কাঁকন: টেলি কমুনিকেশন এক্সিকিউটিভ, জার্মানি 

[ফেমিনিস্ট ফ্যাক্টরে প্রকাশিত মুক্তমত লেখকের নিজস্ব মতামত]