November 21, 2024
কলামফিচার ৩

রোদ্দুর রয় নাকি পি কে মল্লিক: রবীন্দ্রনাথ আসলে কার?

সেঁজুতি জাহান জিনাত।। প্রাক করোনাকালে কলেজে রবীন্দ্র সংগীত প্রতিযোগিতার ইভেন্টে এক ছাত্র দেখি ‘যেতে যেতে পথে’ দিয়ে গান শুরু করেছে। কণ্ঠে কিঞ্চিৎ রোদ্দুর রয়ের টেস্টও পাওয়া গেল। এমনিতে তার গলা এবং গায়কী খারাপ না। ভেবেছিলাম পুরো গানটাই গাইবে। কিন্তু না, সে ওইটুকুই গাইলো যেটুকু রোদ্দুর রয় গেয়েছিল।
আমি যার পর নাই হতাশ হলাম। অনেকেই রোদ্দুর রয়কে দেখতে পারেন না। আমি তাদেরকে এভাবে যুক্তি দিই: ‘সেদিন দুজনে’ গানটি যেই ছেলে কোন দিন শোনে নাই, সেও রোদ্দুর রায়ের উসিলায় রবীন্দ্রনাথের অন্তত একটি গান শুনলো তো! এটা শুনেও হয়ত সে আসল রবীন্দ্র সংগীতে আগ্রহী হয়ে উঠতে পারে!

জীবন থেকে নেওয়া গল্পের একটি পাতা বের করি।
২০০৩ এর দিকে আমি ঢাকায় আসি বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তির জন্য কোচিং করতে। তার আগে বাড়িতে থাকতে বাংলা ব্যান্ডের ‘কিংকর্তব্যবিমূঢ়’ অ্যালবামটি পেপারের একটা প্রতিবেদন পড়ে প্রভাবিত হয়ে কিনি। অর্ণব আর আনুশেহকে ওই থেকে পছন্দ। ‘সহজ মানুষ’, ‘আমি অপার হয়ে’ গানদুটো এর আগেও বহুবার শুনেছি, কিন্তু ঠিক মনে লাগেনি। এই ব্যান্ডের সবগুলো গান মুখস্থ ছিল। ‘লালন’, ‘বিজয় সরকার’, ‘দুর্বিন শাহ’ এর আগে জীবনেও ভাল্লাগতো না। এই ব্যান্ডের বদৌলতে আমি এসব দেশি গানের দিকে মন দিতে সফল হই।

লালনের গান একসময় মনে হইত ফকির ফাকরাদের গান, বিজয় সরকারের গান মুজিব পরদেশির কণ্ঠে শুনতাম ঠিকই, কিন্তু মনে হতো কি খ্যাত খ্যাত গান সব!
আনুশেহ আর অর্ণব আমাদের এই মূর্খতাকে ভাঙলেন তাদের এইসব গান দিয়ে। এদের গানে সুর বিকৃতির অভিযোগ থাকলেও আমাদের প্রজন্ম মাকসুদ, আনুশেহ আর অর্ণবদের কাছে ঋণী নিজেদের গানের সঙ্গে সংযোগ ঘটিয়ে দেবার জন্য। ওই থেকে লালন, বিজয় সরকার, শাহ আব্দুল করিম, শাহ আলম সরকারসহ সমস্ত ‘খ্যাত’ গানের ‘র’ ভয়েসই তো তালাশ করে ফিরি!

ভেবেছিলাম এমনটাই হবে হয়তো!

কিন্তু না, তা আর হচ্ছে কোথায়? বিকৃতকে নিয়ে, অসংগতিকে নিয়ে মজা করা যায়, কিন্তু তাকে মূল স্রোতে প্রতিষ্ঠিত করা যায় না শেষ পর্যন্ত। মজা, ভাঁড়ামো খুব দরকারি জীবনের জন্য; কিন্তু সেটা একমাত্র ভিত্তি হতে পারে না। আবার এটাও ঠিক রবীন্দ্রনাথের ব্যাপারে না বুঝে না জেনে যে ‘পুতুপুতু’ ভাবের আতিশয্য চলে চতুর্দিকে তা রবীন্দ্রনাথের আসল কাজগুলোকে বরং আবডাল করে ফেলে। তাই হয়ত রোদ্দুর রয়দের আবির্ভাব ঘটে ধরায়।

‘পুতুপুতু’ রবীন্দ্র চর্চা মানে হলো, রবীন্দ্রনাথ বলেছেন এটাই নমস্য, কী বলেছেন কেন বলেছেন তার গুরুত্ব আবিষ্কার নয়। এই ‘পুতুপুতু’ রবীন্দ্র-চর্চার আড়ালে তাঁর প্রকৃত প্রাসঙ্গিক কাজগুলো ঢাকা পড়ে যায়। পুতুপুতু সূক্ষ্ণতাকে জাতীয় আবেগে ধারণ করতে গিয়ে যে সমাজের কল্যাণ-কর্ম ব্যাপকভাবে ব্যাহত হয়,এ ব্যাপারে খোদ রবীন্দ্রনাথই বলছেন:

“কাজে নামিলেই অতিসূক্ষ্ম অংশগুলি ছাঁটিয়া চলিতে হয়, নতুবা হিসাব মিলাইতে মিলাইতে কাজ করিবার সময় পাওয়া যায় না।” (আচারের অত্যাচার)

একদম ন্যায্য কথা। রবীন্দ্রনাথের ব্যাপারে বাঙালির আবেগ থাকতেই পারে, এটা দোষের কিছু নয়, বরং দীর্ঘ রবীন্দ্র জীবন এ আবেগকে একটি কার্যকরী উচ্চতায় নিয়ে যেতে পারে। কিন্তু, শুধু সেই আবেগেই বুঁদ হয়ে নিষ্ক্রিয়, নিভৃত থাকলে তো রবীন্দ্রনাথের সাংস্কৃতিক ও সামাজিক আন্দোলনের ‘ভাষা’টি মরে যাবে কালে কালে।

রবীন্দ্রনাথ ‘স্কুল পালানো ছাত্র’ হওয়ায় স্কুলের কারিকুলাম বা মাস্টার মশাইদের শিক্ষার্থী-বান্ধব করে তোলার জন্য আজীবন লেগে থেকেছেন। সাহিত্য করেছেন কেবল আত্মতুষ্টির জন্য, তা কিন্তু মোটেও নয়। সাহিত্য করার পাশাপাশি সব সময় তাঁর চিন্তা ছিল জনকল্যাণকর কিছু করার। বৃহত্তর জনগোষ্ঠীর সার্বিক উন্নয়ন তাঁর সাহিত্য ও জ্ঞান জগতের মূল উদ্দেশ্য ছিল। নব্য লেখকদের পাতার পর পাতা পড়ে পড়ে তাদের সাহিত্য ও জ্ঞানচর্চার তরিকা বাতলে দিয়েছেন। বই পড়ার জন্য, গবেষণা করার জন্য প্রতিনিয়ত আর্থিক ও সামাজিক সহযোগিতা দিয়ে গেছেন।

প্রেসিডেন্সি কলেজের পদার্থ বিজ্ঞানের অধ্যাপক ও আমাদের অতি পরিচিত জগদীশচন্দ্র বসু শিক্ষা ছুটি নিয়ে বিলেতে গবেষণার জন্য গেলে, তাঁর গবেষণা কাজ অর্থ ও ছুটির অভাবে যেন কোনোভাবেই বিঘ্নিত না হয় সেজন্য অর্থ ও ছুটির জন্য খুব ব্যতিব্যস্ত হয়ে কার্যকরী ভূমিকা পালন করেন রবীন্দ্রনাথ। তিনি ত্রিপুরার মহারাজা রাধাকিশোর মাণিক্যের শরণাপন্ন হয়ে দশ হাজার টাকা পাঠানোর ব্যবস্থা করে দেন। রবীন্দ্রনাথ জগদীশচন্দ্র বসুকে পত্রে লিখছেন: “তোমার কাছে জ্ঞানের পন্থা ভিক্ষা করিতেছি – আর কোনো পথ ভারতবর্ষের পথ নহে – তপস্যার পথ, সাধনার পথ আমাদের।” (৪৫,প্রভাতকুমার মুখোপাধ্যায়, রবীন্দ্র জীবন কথা)

ভারতবর্ষের সব ধরনের পশ্চাৎপদতাকে যেকোনো মূল্যে দূর করার জন্য তাঁর ভেতরে সব সময় একধরনের হাহুতাশ পরিলক্ষিত হয়েছে। ‘সভ্যতার সংকট’, ‘শিক্ষা’, ‘রাশিয়ার চিঠি’, ‘আত্মপরিচয়’ প্রভৃতি প্রবন্ধে লেখক বেশ সবিস্তারে ভারতবর্ষের আত্মশক্তিতে বলীয়ান হয়ে নিজেদের জীবনাচার ও শিক্ষাচারকে প্রায় সব অর্থেই ‘সহজ’ করার জন্য বলেছেন।
রবীন্দ্রনাথ যে ‘সভ্যতা’কে ‘সদাচার’ বলে বাঙালির ইউরোপীয় দাসবৃত্তির চরম ও করুণ ভবিষ্যৎ নিয়ে চিন্তা করে আফসোসে আফসোসে শেষ হয়ে গেছেন। জীবনের ৮০ বছরে উপনীত হয়ে আত্মখেদ জাহির করেছেন বিভিন্ন লেখায়। দুঃখজনক হলেও সত্য সেই ‘সভ্যতার সংকট’কে আমরা জিনেটিক্যালি বয়ে নিয়ে বেড়াচ্ছি আমাদের ঐতিহাসিক সমাজ ব্যবস্থার নিয়মিত গতিধারায়।

রোদ্দুর রয় নিশ্চই রবীন্দ্রপিয়াসী, না হলে তিনি দ্বীজেন্দ্রলাল রায়ের গানের এমন রিমেক করতেন। কিন্তু তাকে যারা আমরা ফলো করছি, সেই আমাদের পিয়াসা ঠিক কীসে, তা কিন্তু নিজেরাই জানি না। জীবনের ৫০-৬০ বছর পার করে দিয়েও জনসংশ্লিষ্ট একটি কাজের সাথেও নিজেদেরকে এনগেইজ করতে পারি না।

অথচ মাত্র ১৭ বছর বয়সে রবীন্দ্রনাথ বিলেতে ওকালতি পড়তে যান। ওকালতি পড়া তাঁর না হলেও তিনি বাংলাকে দিয়েছেন প্রমিত উচ্চারণের একটি সুনির্দিষ্ট সূত্র। রবীন্দ্রনাথের এই ওকালতি পড়তে যাবার আগে ধারণা ছিল ইংরেজি বানান ও উচ্চারণে যে ঝামেলা তা বোধ হয় বাংলাতে নাই। কিন্তু তিনি তাঁর এক বন্ধুকে বাংলা শেখাতে গিয়ে যথেষ্ট সমস্যা অনুভব করেন। প্রমিত বাংলা উচ্চারণের ক্ষেত্রে যথেষ্ট ঘাপলা আছে। এ বিষয়ে রবীন্দ্রনাথ নিজেই যখন বলেন:

“পূর্বে আমার বিশ্বাস ছিল আমাদের বাংলা-অক্ষর উচ্চারণে কোনো গোলযোগ নাই। কেবল তিনটে স, দুটো ন ও দুটো জ শিশুদিগকে বিপাকে ফেলিয়া থাকে। এই তিনটে স-এর হাত এড়াইবার জন্যই পরীক্ষার পূর্বে পণ্ডিতমশায় ছাত্রদিগকে পরামর্শ দিয়াছিলেন যে, “দেখো বাপু, ‘সুশীতল সমীরণ’ লিখতে যদি ভাবনা উপস্থিত হয় তো লিখে দিয়ে ‘ঠান্ডা হাওয়া’।” এ ছাড়া দুটো ব-এর মধ্যে একটা ব কোনো কাজে লাগে না। ঋঌঙঞ-গুলো কেবল সঙ সাজিয়া আছে। চেহারা দেখিলে হাসি আসে, কিন্তু মুখস্থ করিবার সময় শিশুদের বিপরীত ভাবোদয় হয়। সকলের চেয়ে কষ্ট দেয় দীর্ঘহ্রস্ব স্বর। কিন্তু বর্ণমালার মধ্যে যতই গোলযোগ থাক্‌-না কেন, আমাদের উচ্চারণের মধ্যে কোনো অনিয়ম নাই, এইরূপ আমার ধারণা ছিল।
ইংলন্ডে থাকিতে আমার একজন ইংরেজ বন্ধুকে বাংলা পড়াইবার সময় আমার চৈতন্য হইল, এ বিশ্বাস সম্পূর্ণ সমূলক নয়।” (বাংলা শব্দতত্ত্ব)

কবি তাৎক্ষণিকভাবে বন্ধুকে বাংলা শেখাতে গিয়ে বেশ কিছু বাংলা ডিকশনারির সহায়তায় প্রাথমিক ৮টি নিয়মকে ছকে বেঁধে ফেললেন। এটি তাঁর ১৭ বছর বয়সের কাজ। এরপর থেকে ‘স্কুল পালানো’ এই ছাত্রটি ভারতবর্ষের শিক্ষা ব্যবস্থা ও সংস্কৃতির উন্নতি সাধনে যার পর নাই চিন্তিত ও নিয়োজিত ছিলেন। স্ত্রী মৃণালিনী দেবীর গুরুতর অসুস্থতাসমেত তিনি শান্তিনিকেতন প্রতিষ্ঠার জন্য বেশ সচেষ্ট হন। এ ব্যাপারে তাঁকে নির্ভর করতে হয়েছিল পিতা মহর্ষি দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুরের ওপর। পিতার মতামত ও ব্রিটিশ সরকারের অনুমোদন উভয়ই ছিল তখন কবির জন্য কঠিন। কেননা তখন তাঁর স্ত্রী মৃত্যুশয্যায়। তবু তিনি হাল ছাড়েননি। স্ত্রীর মৃত্যুর পরে দশ মাসের মাথায় মেজ মেয়ে রানী মারা যান। বিমর্ষ কবি গভীর ব্যথা মনে লুকিয়ে রেখে সর্বভারত-কল্যাণে ডুবে ছিলেন। একদিকে ‘বঙ্গদর্শন’ পত্রিকার জন্য ‘নৌকাডুবি’ উপন্যাসও লিখছেন, আবার অন্যদিকে তৎকালীন রাণী ভিকটোরিয়ার মৃত্যুর পর রাজপ্রতিনিধি বা ভাইসরায় লর্ড কার্জন কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাবর্তনে প্রাচ্যদেশীয়দেরকে নিয়ে কটূক্তি করা ব্যঙ্গের উত্তরে ‘অত্যুক্তি’ প্রবন্ধও লিখছেন।

নিজের বড় ছেলে রথীন্দ্রনাথকেও তাঁর এন্ট্রেন্স পাশ করার পর মাত্র ১৭ বছর বয়সে কবি মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে পাঠালেন। কৃষিকাজ ও গো-পালন শেখার জন্য। যেখানে সেই সময় একটু সম্ভ্রান্ত পরিবারের ছেলেরা বিলেতে যেত ওকালতি বা সিভিল সার্ভিসের পরীক্ষার জন্য। অথবা জাপানে যেত জুতার কালি, বিস্কুট, সাবান প্রস্তুত প্রণালি শিখতে, সেখানে রবীন্দ্রনাথ নিজের বড় ছেলে ও বন্ধু শ্রীশচন্দ্রের ছেলে সন্তোষচন্দ্রকে কৃষি-কাজ ও গো-পালনের জন্য আমেরিকা পাঠালেন। কেন এমনটা করলেন?

পি কে মল্লিকের কণ্ঠে ‘তোমার হলো শুরু আমার হলো সারা’ কিংবা রোদ্দুর রয়ের কণ্ঠে ‘চাঁদ উঠেছিল গগনে’ শুনতে শুনতেও কিন্তু এ বিষয়ে নানামাত্রিক গবেষণা করা যায়।

রবীন্দ্রনাথের সমগ্র লেখক জীবনে কল্যাণের কোনো প্রসঙ্গ এলেই তিনি নিজের ভেতর থেকে চলে যেতেন জন-সংশ্লিষ্টতার ভেতরে। শিক্ষাকে হতে হবে শিক্ষার্থীবান্ধব। সেই প্রত্যয় থেকেই সারা জীবন তিনি শিক্ষা গ্রহণ ও প্রদানের ব্যাপারে পরামর্শ দিয়ে গেছেন। ঠিক এ কারণেই তিনি ‘সহজ’ কথার উপাসনাও করে গেছেন।

গোপনে অনেকেই অভিযোগ করেন ‘উনি তো ছিলেন জমিদারের পুত’ ইত্যাদি ইত্যাদি। একজন মানুষ যে পরিবেশে বেড়ে ওঠে সেটা পুরোপুরি কাটিয়ে উঠতে পারা খুবই দুরূহ ব্যাপার। ‘কাটিয়ে ওঠা দরকার’ এটাও তো অনেকের ভাবনায় আসে না। কেউ কেউ ভাবেন, না পারলেও চেষ্টা করেন, তাঁদের মধ্যে রবীন্দ্রনাথ একজন। নিজেকে অতিক্রম করবার চেষ্টাই তাঁকে তাঁর সময়ের বজরায় করে অতিক্রম করিয়ে আজকের সময়ে এনে পৌঁছে দিয়েছে।

নিজেকে আঁকড়ে থেকে যাওয়া মানুষগুলো নিজেকে অতিক্রম করবে কীভাবে? ফলে রবীন্দ্রনাথকেও কেউ অতিক্রম করতে চান না, কেউ ‘পুতুপুতু’ করেন, কেউ ‘হালার পুত’ বলে গাইল পাড়েন। গালি দিয়ে কিংবা ‘পুতুপুতু’ করেই যদি কেউ মনে করে যে সে ভেস্তে চলে গেল, তো তার জন্য রোদ্দুর রয় বা অন্ধ-অর্চনার জেলখানাই উপযুক্ত স্থান।

রবীন্দ্রনাথ প্রাসঙ্গিক হোক, বিকশিত হোক তার গান, কথা, মনন আর হৃদয়। ১৬০তম জন্মদিন পেরিয়ে একজন চিন্তক-কর্মী রবীন্দ্রনাথকে স্মরণ করি।

 

[ফেমিনিস্ট ফ্যাক্টরে প্রকাশিত কলাম লেখকের নিজস্ব বক্তব্য]