September 20, 2024
ফিচার ৩মুক্তমত

যৌতুক এখন নতুন চেহারায়

নাহিদা নিশি।। একটা সময় ছিলো যখন লেখক কবিরা যৌতুক প্রথার বিরুদ্ধে প্রচুর লেখালেখি করতেন, যেটা এখন লক্ষণীয় হারে কমে গেছে। শহুরে নারীবাদ এতো এগিয়ে গিয়েছে যে, যৌতুক নিয়ে লেখালেখির আবেদন ফুরিয়েছে সম্ভবত। কিংবা দিনে দিনে যৌতুক ব্যাপারটা স্বাভাবিক হয়ে উঠেছে। অথচ যৌতুকের কারণে আজও শত শত হৈমন্তীর মৃত্যু ঘটছে।

আইন ও সালিশ কেন্দ্রের তথ্যমতে, গত বছর যৌতুকের কারণে অত্যাচারিত হয়েছে ৯৯ জন এবং মারা গেছে ৮৯ জন নারী। চলতি বছরের জানুয়ারি থেকে মে মাস পর্যন্ত ৩২ জনের মৃত্যু ঘটেছে আর শারীরিক অত্যাচারের শিকার হয়েছেন ৪৯ জন নারী। সংখ্যাটা অনেকের কাছে খুব কম মনে হতে পারে, কিন্তু বাস্তবতা একদমই ভিন্ন। এই ৩২ জন নারীর নাম পত্রপত্রিকায় এসেছে বলেই, এই ৪৯ জন নারী আইনের দ্বারস্থ হয়েছে বলেই এদের কথা আমরা জানতে পেরেছি। কিন্তু শহরে-গ্রামে এরকম অসংখ্য নারী আছেন যাদের বিবাহিত জীবন ২০-২৫ বছর পেরিয়ে গেছে, এখনো স্বামীর হাতে মার খেতে হয় কিংবা উঠতে বসতে কটু কথা শুনতে হয়, কারণ বিয়ের সময় বাবা মোটা অংকের টাকা দিতে পারেনি, কারণ আসবাব বলতে কিছুই পাঠায়নি মেয়ের বাড়িতে, কারণ প্রতি ঈদে বাবার বাড়ি থেকে সেমাই-চিনি, কাপড়চোপর আসে না নিয়ম করে।

যাই হোক, বাড়ি এসে দুটো ঘটনা শুনে ভীষণ বিধ্বস্ত হয়ে আছি।

ঘটনা ১: নীলা নামের মেয়েটার বয়স প্রায় ত্রিশ। গায়ের রঙ বেশ কালো। কামিল পাশ, বিয়ে হয়নি। আর্থিক অবস্থা খুব খারাপই বলা চলে। লোকে দেখলেই জিজ্ঞেস করে, “এখনো বিয়ে হয়নি!” যেনতেন ছেলেকে বিয়ে করলে অনেক আগেই হয়তো হয়ে যেতো। কিন্তু সমস্যা হলো, মেয়ে যেহেতু কিছুটা পড়াশোনা করেছে, তাই স্বাভাবিকভাবেই সে একজন শিক্ষিত ছেলে চায়। অন্যদিকে শিক্ষিত ছেলেরা চায় ভালো অবস্থাপন্ন পরিবার, সুন্দরী মেয়ে। সব মিলিয়ে ভীষণ খারাপ অবস্থা। প্রচুর লোকজন এসে দেখে যায়, কিন্তু বিয়ে হয় না। ঠিক এমন সময় পাশের এলাকার একটি ছেলের সঙ্গে ফেসবুকের মাধ্যমে আলাপ হয় ওর, ধীরে ধীরে প্রেম। ছেলেটি শ্রমিক ভিসায় দেশের বাইরে গেছে, পরিবারের অবস্থা ওদের তুলনায় মোটামুটি ভালো। প্রেমের ব্যাপারটা দুজনই নিজ নিজ পরিবার’কে জানায়। নীলার মা খুব খুশি হয়, বলা যায় নিশ্চিন্ত হয়। ছেলের বাড়িতে নীলার নিয়মিত যাতায়াতও শুরু হয়।

এভাবে চলতে চলতে একদিন নীলার বাবা বললেন, “ছেলে কবে দেশে ফিরবে তার তো ঠিক নাই। ফোনেই বিয়ের ব্যবস্থা করা হোক!” কথাটা শুনে ছেলের মায়ের চেহারা একদমই পাল্টে গেলো। বললো, “আমার ছেলেকে বিদেশ পাঠানোর সময় অনেক টাকা ঋণ করতে হয়েছে, যেগুলা এখনো শোধ হয়নি। তিন লক্ষ টাকা দিতে হবে তোমার বাবাকে। নাহলে বিয়ে হবে না”। ছেলেও ইনিয়ে বিনিয়ে মায়ের কথায় সায় দিলো।

এই ঘটনা শোনার পর যতোটা না অবাক হয়েছি তারচেয়েও বেশি হতবাক হয়েছি এটা জেনে যে, নীলা সম্পর্কটা ভেঙে না দিয়ে ছেলেটিকে অনুরোধ করছে, তারা যেন যৌতুকের পরিমাণটা কমায়। কারণ তিন লক্ষ টাকা দেয়ার ক্ষমতা তাদের নেই।

ঘটনা ২: তৃণাদের  আর্থিক অবস্থা মোটামুটি ভালো বলা চলে। তিন বোন ওরা। ভাই নেই বলে বাবা-মা তৃণার নামেই তাদের বাড়ি এবং বেশ কিছু জায়গা-জমি লিখে দিয়েছে। কাজেই কিছু ছেলে তৃণা’কে বিয়ে করে অটোমেটিকালি বেশ কিছু সম্পত্তির মালিক হতে চায়। এদিকে তৃণার পরিবারের পছন্দ সরকারি চাকরিজীবী ছেলে, আর্থিক অবস্থা কোনোরকম হলেও চলবে।

মাসখানেক আগে পাশের জেলা থেকে একটি প্রস্তাব এলো, ছেলে সেনাবাহিনীতে চাকরি করে। তৃণা’কে দেখে পছন্দও করেছে তারা। এবার তৃণার বাড়ি থেকে তিন-চারজন গেল ছেলের সম্বন্ধে খোঁজ-খবর নিতে। দেখে-শুনে সমস্ত কিছুই একরকম পছন্দ হলো, সব ঠিকঠাক। শেষ মূহুর্তে ছেলের বাবা বলে বসলো, “ছেলের চাকরির সময় বারো লক্ষ টাকা লেগেছিল, তখন অনেকটা ঋণ করতে হয়েছে। আপনাদের আট লক্ষ টাকা দিতে হবে। এটা কিন্তু যৌতুক না, ঋণ শোধ হলে আপনাদের জামাইয়েরই তো হবে!”

তৃণার দুলাভাই বললো, “কথাটা সরাসরি বলে ভালোই করেছেন। এই বিয়ে ক্যানসেল”। ছেলের বাবার মাথা ঘুরে গেল। মেয়ের নামে অনেক সম্পত্তি শুনে ইনিয়ে বিনিয়ে মাফ চাইতে লাগলো। বলতে লাগলো, “কিছুই লাগবে না। শুধু মেয়েটাকে চাই আমরা”।

রবীন্দ্রনাথের ‘অপরিচিতা’ গল্পের কথা মনে পড়ছে। কল্যাণীর বাবার মতো তৃণার বাবারও যৌতুক দেয়ার ক্ষমতা আছে, কিন্তু কেন দেবে?

শহরের ব্যাপারটা আমি ঠিক জানি না, তবে গ্রামের দিকে আজকাল এই জিনিসের প্রচলন খুব বেড়ে গেছে। ছেলের বাবারা জায়গা-জমি বিক্রি করে, ধার-দেনা করে মোটা অংকের টাকা ঘুষ দিয়ে ছেলেকে একটা ছোটখাটো সরকারি চাকরিতে ঢুকিয়ে দেয়, তারপর আশা করে, ছেলের বিয়েতে মোটা অংকের যৌতুক নিয়ে সেই ঋণ শোধ করবে। এটা ঠিক কী রকম ব্যবসা আমি বুঝিনা। নিজেরা লক্ষ লক্ষ টাকা ঋণ করে বসে থাকে অন্যের আশায়! কি শান্তি!

আরও অবাক লাগে যখন দেখি মেয়ের বাবারা সত্যি সত্যিই অন্যের ঋণ শোধ করবার জন্য টাকা নিয়ে বসে আছেন। অন্যের ছেলের চাকরির টাকা দিচ্ছেন, বিদেশ যাওয়ার টাকা দিচ্ছেন।

মধ্যবিত্তরা অবশ্য আজকাল এরকম সরাসরি যৌতুক চায় না। তারা বলে, ‘‘আমরা কিছু চাইনা। আপনারা খুশি হয়ে মেয়ে আর জামাইকে যা দিবেন, তাই”। এর মানে আসলে হচ্ছে, বেহিসাবি দিতে থাকবেন। বিয়েতে লক্ষ লক্ষ টাকার গয়না, সাজ-পোশাক,  (জামাইকে বাইক দেয়াটা তো ডাল-ভাত হয়ে গেছে কিছু কিছু অঞ্চলে)! এখানেই শেষ না। যতোদিন মেয়ের বাবা-মা, ভাই-বোন বেঁচে থাকবে, ততোদিন জামাইকে দিতে হবে।

আর মেয়েরাও বিয়ের পর কেমন যেন বদলে যায়! বছরে, ছ’মাসে বাবার বাড়ি গেলে সমস্ত কিছু শুষে নিতে চায়। কারণ বেশি বেশি নিতে পারলেই শ্বশুরবাড়িতে একটুখানি দাম পাওয়া যায়। বোকা মেয়েগুলো বাবার বাড়ি থেকে কে কতোটা আনতে পারলো, তার প্রতিযোগিতায় নামে। এক বৃদ্ধ ভিক্ষুককে চিনি, যিনি ভিক্ষা করে টাকা জমান প্রতি ঈদে জামাইকে লুঙ্গি-শার্ট দেয়ার জন্য। কি এক অত্যাচার!

শুনেছি, দিনাজপুর-ঠাকুরগাঁও এলাকায় মেয়ে বাচ্চা জন্ম দেয়া মানেই তার বিয়ের জন্য কমপক্ষে তিন থেকে চার লক্ষ টাকা রাখতে হয় বাবা-মাকে। প্রতিবেশী এক ভাবীকে দেখতাম প্রায়ই ভাব নিয়ে বলতেন, আজ থেকে বারো বছর আগে তিনি তিন লক্ষ টাকা যৌতুক এনেছেন। (অথচ তিনি নিয়মিত স্বামীর হাতে মার খেতেন)। একদিন বাধ্য হয়ে বললাম, এই কথাটা এতো গর্ব করে বলছেন কেন? এর দ্বারা কী বোঝাচ্ছেন, আপনার বাবার অনেক টাকা নাকি আপনার দাম কম?

আইন অনুযায়ী, বিবাহের কোনো এক পক্ষ যৌতুক প্রদান বা গ্রহণ করলে অনধিক ৫ বছরের কারাদণ্ড বা অনধিক ৫০,০০০ টাকা অর্থদণ্ড অথবা উভয় দণ্ডে দণ্ডিত হবেন। অথচ কে শোনে আইনের কথা!

তাই মেয়ের বাবা-মাকে বলতে চাই, যৌতুক দেয়া এবং ঘুষ দেয়া দুটোই অপরাধ। সরকারি চাকরিজীবী ছেলে না খুঁজে মেয়েটিকেই সরকারি চাকরিজীবী হতে সাহায্য করুন। বিয়ের পেছনে টাকা না ঢেলে পড়াশোনার পেছনে ঢালুন। যৌতুকের টাকা দিয়ে মেয়েকে ব্যবসা ধরিয়ে দিন। দেখবেন, একবার নিজের পায়ে দাঁড়িয়ে গেলে এমনিতেই ছেলে এবং ছেলের বাবাদের লাইন লেগে যাবে। আর সব থেকে বড় কথা হচ্ছে, একটা বিয়ে টেকার চেয়ে একটা চাকরি টেকার সম্ভাবনা সবসময় বেশি থাকে।

সত্যি বলতে, কোনোরকম আইন দিয়েই যৌতুকপ্রথা বন্ধ করা যাবে না। এটা সম্ভব করতে পারে শুধুমাত্র মেয়েরা। প্রতিটি মেয়ে যদি বলে ওঠে, “এক টাকাও যৌতুক দিয়ে বিয়ে করবো না”,  প্রতিটি মেয়ের বাবা যদি যৌতুকের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়ায়, তাহলেই সম্ভব।

প্রতিটি মেয়েকে হতে হবে রবীন্দ্রনাথের কল্যাণী , প্রতিটি মেয়ের বাবাকে হতে হবে শম্ভুনাথ সেন।

 

[ফেমিনিস্ট ফ্যাক্টরে প্রকাশিত মুক্তমত লেখকের নিজস্ব বক্তব্য]