November 2, 2024
কলামফিচার ৩

মহামারি, অর্থ সংকট, হতাশা এলেই কেন পুরুষ নারীকে নির্যাতন করে?

হাফিজুর রহমান ।। কয়েক দিন আগে সীমিত পরিসরের লকডাউনে গ্রামে গিয়েছিলাম। রিক্সা থেকে নেমে বাড়ি যাওয়ার পথে প্রতিবেশী এক বাড়িতে কিছুটা শোরগোলের আওয়াজ পাই। বিভিন্ন মারফত জানতে পারি, স্বামী-স্ত্রীর মধ্যে ঝগড়া বিবাদ চলছিল এবং বিবাদের এক পর্যায়ে স্বামী তার স্ত্রীর গায়ে হাত তোলেন। যাদের মধ্যে ঝগড়া লেগেছিল তারা আমার পরিচিত। পরের দিন, ওই নারীর সাথে আমার দেখা হলে কী হয়েছিল জানতে চাইলে তিনি বলেন, অনেক দিনের টানা লকডাউনে উনার স্বামীর কামাই রোজগার বন্ধ। যার ফলে সংসারের অভাব অনটন বেড়েছে, তাই সাংসারিক বিভিন্ন বিষয় নিয়ে উনার স্বামীর একটু রাগ উঠেছিল।

মহামারী কিংবা প্রাকৃতিক দূর্যোগও কখনো কখনো নারী নিপীড়নের গতানুগতিক চর্চার পুনঃউৎপাদনে ভূমিকা রাখতে পারে।

যদিও বিবেচনা করা হয় প্রতিটি মানুষের নিরাপদ আশ্রয়স্থল তার ঘর, কিন্তু এই ঘরও নারীকে পরিপূর্ণ নিরাপত্তা দিতে পারে না। কারণ গৃহ নামক চার দেয়ালের মাঝেও নারী নির্যাতনের শিকার হয়। তবে শুধু ঘরেই না, ঘরের বাইরে জনপরিসরে এবং কর্মক্ষেত্রেও নারী নির্যাতনের ঘটনা ঘটে। নারী নির্যাতন একটি ভয়াবহ সামাজিক ভাইরাস। যা প্রজন্ম থেকে প্রজন্মে ঘটে চলেছে এবং মহামারিতে এর বৃদ্ধি ঘটতে দেখা যায়।

সাম্প্রতিক মহামারী করোনায় বিশ্বব্যাপী লকডাউন পরিস্থিতিতে এর মাত্রা উল্লেখযোগ্য হারে বৃদ্ধি পেয়েছে। রয়টার্সের তথ্যমতে, ২০২০ সালে লকডাউনের প্রথম সপ্তাহেই ভারতে নারী নির্যাতন প্রায় দ্বিগুণ হয়েছিল, দক্ষিণ আফ্রিকায় লকডাউনের প্রথম সপ্তাহে অন্তত ৯০ হাজার লিঙ্গভিত্তিক সহিংসতার অভিযোগ এসেছিল। অস্ট্রেলীয় সরকারের কাছে অনলাইনে নারীদের সাহায্য প্রার্থনার হার বেড়ে ৭৫ শতাংশে দাঁড়িয়েছিল এবং লকডাউনের এক সপ্তাহে ফ্রান্সে ঘরোয়া নির্যাতন বেড়েছিল প্রায় ৩২ শতাংশ। বাংলাদেশেও এর ব্যতিক্রম ঘটেনি। বেসরকারি সংস্থা “মানুষের জন্য ফাউন্ডেশন” এর জরিপ অনুযায়ী, ২০২০ সালের এপ্রিল মাসের সরকারি ছুটি বা লকডাউনে দেশের ২৭ টি জেলায় ৪২৪৯ জন নারী এবং ৪৫৬ শিশু পারিবারিক সহিংসতার শিকার হয়েছিল। সংখ্যাটি বেশ উদ্বেগের।

চলমান লকডাউনেও এর হার বেড়েই চলছে। এর মধ্যে পারিবারিক সহিংসতার বিষটি ব্যাপক আকার ধারণ করতে দেখা যায়। পারিবারিক সহিংসতার ক্ষেত্রে অর্থনৈতিক সংকটের বিষয়টি সহিংসতার মাত্রা বাড়িয়েছে। বিভিন্ন গবেষণায় দেখা গেছে, নির্যাতিত নারীরা অধিকাংশই দরিদ্র পরিবারের। করোনা ভাইরাস মহামারীতে বাংলাদেশের নিম্নবিত্ত ও মধ্যবিত্ত পরিবারের অনেকেই কর্মসংস্থান হারিয়েছে বা আয়ের উৎস বন্ধ হয়েছে, ফলে ঐ সমস্ত পরিবারগুলোতে দেখা দিয়েছে অর্থনৈতিক সংকট। আর এই সংকট জন্ম দিয়েছে হতাশা এবং মানসিক অবসাদের। এখন প্রশ্ন হলো, মহামারি, অর্থনৈতিক সংকট কিংবা হতাশা জন্ম নিলেই কেন নারীকে নির্যাতন করতে হবে? কেন নারীকে আঘাত করতে হবে ?

এই বিষয়টা বুঝতে হলে আমাদেরকে একটি রাষ্ট্রের পারিবারিক ও সামাজিক কাঠামো বুঝতে হবে। বাংলাদেশের পুরুষতান্ত্রিক সমাজব্যবস্থার নেতিবাচক দৃষ্টিভঙ্গি নারীর জীবনে বার বার আঘাত নিয়ে আসে। পুরুষতন্ত্র নারীর ওপর কর্তৃত্ব ও ক্ষমতা প্রদর্শন করে এক ধরনের সুপ্রিমেসিকে জাহির করতে চায়। বাংলাদেশের অধিকাংশ পুরুষের মগজে পুরুষতন্ত্র লালিত হয় এবং প্রজন্ম থেকে প্রজন্মে এটি ধারাবাহিকভাবে টিকে থাকে। বিভিন্ন সামাজিক প্রতিষ্ঠানই পুরুষতন্ত্রের মতাদর্শকে টিকিয়ে রাখে এবং দীর্ঘজীবী করে। তবে পুরুষতান্ত্রিক মতাদর্শ কেবল পুরুষই ধারণ করে বিষয়টি এমন নয়, নারীও এর ধারক। যেহেতু সামাজিক প্রথা ও প্রতিষ্ঠানসমূহকে চ্যালেঞ্জ করা সহজ নয়, ফলে নারীও পুরুষতন্ত্রে অভ্যস্ত হয়ে পড়ে।

আমাদের সমাজে স্টেরিওটাইপ করার সংস্কৃতি এ বিষয়গুলোকে আরও উসকে দেয়। বাংলাদেশের সমাজে স্টেরিওটাইপের মাধ্যমে জেন্ডার বৈষম্যের বিষয়টি ব্যাপক আকারে লক্ষণীয়। স্টেরিওটাইপ শব্দটি ঋণাত্মক অর্থেই ব্যবহৃত হয়। কোনো কিছুকে নির্দিষ্ট বৈশিষ্ট্যের ভিত্তিতে ঢালাওভাবে কোনো ছাঁচে ফেলাই হচ্ছে স্টেরিওটাইপ। যেমন, নারীকে কোমল বলার মাধ্যমে, শৈশব থেকেই নারী নিজেকে অবলা ও দুর্বল ভাবতে শুরু করে। একইসাথে নারী এটাও ভাবতে শেখে যে, স্বামী সন্তানই তার একমাত্র অবলম্বন। এভাবেই নারীত্ব নির্মাণের প্রক্রিয়ায় নারীর অপরাপর গুণাবলী ঢাকা পড়ে যায়। নারীর চিন্তাজগৎ হয়ে ওঠে পরাধীন। নারীত্বের এই সাংস্কৃতিক উৎপাদনকে বিবেচনায় রেখেই, নারীবাদী আন্দোলনের পুরোধা সিমোন দ্য বোভেয়ার লিখেছেন, ”কেউ নারী হয়ে জন্মায় না, ক্রমশ নারী হয়ে ওঠে।

এদিকে, আমাদের পারিবারিক শিক্ষাও বড্ড একচোখা। নারীকে নারীত্বের গুলাবলী আয়ত্ব করতে শেখানো হয়, সেই সাথে শেখানো হয় সহনশীলতা। কিন্তু একজন পুরুষকে শিশুকাল থেকে খুব কম মা বাবাই দায়িত্বশীল হতে শেখান। সন্তানের সামনেও অনেক পুরুষ স্ত্রীর গায়ে হাত তোলে। এসব দেখে পরিবারের ছেলে শিশুটি এটাকেই স্বাভাবিক বলে মনে করে, যা নারীর প্রতি সহিংসতাকে বিরাজমান রাখে।

অপরদিকে নির্যাতন কী, কোন বিষয়গুলোকে নির্যাতন বলা হবে এ বিষয় সম্পর্কে সমাজে সুস্পষ্ট ধারণার অভাব রয়েছে। এ কারণেই, একদিকে যেমন ধর্ষণের পর্যায়ে না গেলে ইভটিজিংকে কেউ আমলে নেয় না, অনুরূপভাবে স্বামী তার স্ত্রীকে দুই-একটা টা চড় মারলেও তা অতি সাধারণ ঘটনা হিসেবে বৈধতা পেয়ে যায়। দূর্ভাগ্যজনকভাবে, আমাদের দেশে কেবল ধর্ষণ ও মৃত্যুর খবরেই কেবল নারী নিপীড়নের স্বর জোড়ালো হয়। এক্ষেত্রে ইভটিজিং ও পারিবারিক নির্যাতন নিয়ে ভুক্তভোগী নারী ও তার পরিবারের আওয়াজ না তোলার পেছনে সামাজিক মূল্যবোধ ও সম্মানের ভয় অনেকাংশেই দায়ী।

এছাড়াও, নারী নির্যাতনের বেশিরভাগ খবরই পরিবারের ডাইনিং টেবিল পর্যন্ত সীমাবদ্ধ থাকে। সন্তানের ভবিষ্যত, নিজের ও পরিবারের সম্মানের কথা চিন্তা করে নির্যাতিত নারীরা আইনের আশ্রয় নেয় না। এভাবে পুলিশে রিপোর্ট না করার বিষয়টি একটি সংস্কৃতিতে পরিণত হয়েছে। একইসাথে আইন, শাসন ব্যবস্থার দুর্বলতা ও আইনের প্রতি অনাস্থাও বিষয়টিকে প্রভাবিত করে। ফলে, পৌনঃপুনিক নির্যাতন নারীর জীবনে সুদূরপ্রসারী প্রভাব ফেলে। নারীর মনস্তত্ত্বকে সারাজীবনের জন্য পঙ্গু করে দেয়। নারী শারীরিক, মানসিক উভয় দিক থেকেই ক্ষতির সম্মুখীন হয়। মোটকথা, নারীর জীবনকে বিষিয়ে তোলে এই নির্যাতন নামক ভাইরাসটি।

সমসাময়িক করোনা ভাইরাস পরিস্থিতিতে নারী নির্যাতনের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়াতে, ন্যাশনাল হেল্প লাইন ১০৯ ও ৯৯৯ কে আরও কার্যকর করা এখন সময়ের দাবি। একইসাথে অপরাধীদের দ্রুত বিচারের আওতায় এনে উপযুক্ত শাস্তির ব্যবস্থা করতে হবে। নারী নির্যাতনের বিরুদ্ধে গণসচেতনতা তৈরিতে গণযোগাযোগ মাধ্যমগুলো বিশেষ ভূমিকা পালন করতে পারে। তবে নারী নির্যাতনকে স্থায়ীভাবে নির্মূল করতে পারিবারিক সচেতনতা সবচেয়ে জরুরি। যেহেতু নিপীড়নকারী অধিকাংশ ক্ষেত্রেই পুরুষ তাই ছেলে শিশুর মানসিক বিকাশের প্রতি যথাযথ গুরুত্ব দিতে হবে। পারিবারিক শিক্ষার পাশাপাশি প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষাব্যবস্থার মাধ্যমে মাধ্যমিক পর্যায় থেকেই ছেলে ও মেয়ে শিশুকে নারী নিপীড়ন ও জেন্ডার সম্পর্ক নিয়ে পাঠদানের ব্যবস্থা করতে হবে। নারীর প্রতি ইতিবাচক দৃষ্টিভঙ্গিই পারে সমাজ থেকে নারী নির্যাতন নির্মূল করতে।

[ফেমিনিস্ট ফ্যাক্টরে প্রকাশিত কলাম লেখকের নিজস্ব বক্তব্য]