অত সহজে হাল ছেড়ে দিলে, আজ আমি নারীবাদী হতে পারতাম না
মার্কিন লেখক, সাংবাদিক ও নারীবাদী অ্যাক্টিভিস্ট নাওমি রেবেকা উলফ। ১৯৯০ সালে বেশ কয়েকটি বৈপ্লবিক পরিবর্তনের মধ্যে অন্যতম ছিলো নাওমি উলফের লেখা “দ্য বিউটি মিথ: হাও ইমেজেস অফ বিউটি আর ইউজড এগেইন্সট উইমেন” বইটির প্রকাশিত হওয়া। বইটি তাৎক্ষণিকভাবে জনপ্রিয় হওয়ার অন্যতম কারণ ছিল এই বইটির উপপাদ্য বিষয়। বইটিতে খুব স্পষ্ট করে কীভাবে পুরুষের আধিপত্য বজায় রাখতে নারীর সৌন্দর্যের মানদণ্ড বিচার করা হয় তা তুলে ধরা হয়েছে। শুধুমাত্র নারী নয়, বরং বিভিন্ন প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর এ ধরনের বিভিন্ন সমস্যা নিয়ে সোচ্চার হবার কারণে উলফ এখন বিশ্বের অন্যতম সুপরিচিত নারীবাদী।
নাওমি উলফের প্রকাশিত বই “আউটরেজেস: সেক্স, সেন্সরশিপ, অ্যান্ড দ্য ক্রিমিনালাইজেশন অব লাভ”-এ দুটি শব্দের ভুল ব্যাখ্যা দেওয়ায় বিবিসি’র একটি সম্প্রচারে এটি তীব্র সমালোচনার মুখে পড়ে। তারপর বইটি যুক্তরাজ্যের পাঠকদেরও তীব্র সমালোচনা কুড়িয়েছে। এমনকি উলফের পূর্ববর্তী সমস্ত কাজের উপরই গুরুতর অভিযোগ দায়ের করা হয়।
এইসব অভিযোগের ভিড়ে উলফ বইটি কেন লিখেছিলেন সেই কারণগুলি হারিয়ে গিয়েছিল। এই বইটির মূল উদ্দেশ্য বইয়ের প্রধান চরিত্র জন অ্যাডিংটনের মাধ্যমে ইতিহাসে সমকামী পুরুষদের প্রান্তিকতা তুলে ধরা। বইটিতে হাজার ত্রুটি বিচ্যুতি থাকলেও এ বইটি ইংল্যান্ডের ভিক্টোরিয়ান আমলের সমকামী মানুষদের জীবনের ইতিহাস বিস্তারিতভাবে উপস্থাপন করে।
অনলাইন ম্যাগাজিন ফেয়ার অবজারভারের পক্ষে ২০২০ সালে নাওমি উলফের এই সাক্ষাৎকারটি নেন অঙ্কিতা মুখোপাধ্যায়। এখানে নাওমি উলফ কথা বলেছিলেন তার বই “আউটরেজেস” সম্পর্কে। বইটি লেখার মূল কারণ, জন অ্যাডিংটনের জীবন ও এই সবকিছুর সাথে তার বই “দ্য বিউটি মিথ” এর প্রাসঙ্গিকতাও রয়েছে এই সাক্ষাৎকারে। ফেমিনিস্ট ফ্যাক্টরের পাঠকদের জন্য সাক্ষাৎকারটি অনুবাদ করেছেন ফাতেমা তুজ জোহরা ।।
অঙ্কিতা মুখোপাধ্যায়: আপনার লেখা সর্বশেষ বই “আউটরেজেস: সেক্স, সেন্সরশিপ, অ্যান্ড দ্য ক্রিমিনালাইজেশন অব লাভ” যুক্তরাজ্যে ব্যপক সমালোচনার শিকার হয়েছে। চিন্তার বাইরে বেশি অভিযোগের মূল কারণ হিসেবে আপনি কী মনে করেন? আপনার বইয়ের প্রুফরিডার আইনজীবী হেলেনা কেনেডি বলেছেন ‘‘ব্রিটিশ উপনিবেশবাদের উত্তরাধিকারীদের সমকামীদের প্রতি জমিয়ে রাখা ক্ষোভে’’এর প্রতিফলন এই সমালোচনা। আপনি কি মনে করেন, বইটির এতো তীব্র সমালোচনার সাথে এর কোনো সংযোগ রয়েছে?
নাওমি উলফ: এই ঘটনার পর সমালোচনার ঘটনাটি আমি খুঁটিয়ে দেখার সুযোগ পেয়েছি। এই ঘটনাটি ভাইরাল আক্রমণে পরিণত হবার ঠিক আগ মুহুর্তে আমি ব্রিটিশ দর্শকদের সাথে ব্রিটেন যদি কখনো অভ্যুত্থানের মুখোমুখি হয় তবে তার দুর্বলতা- এ নিয়ে কথা বলছিলাম। মার্কিন আইন সম্পর্কিত তথ্য খোঁজার জন্য আমার সিভিক ডাটা কোম্পানি ডেইলি ক্লাউটের একটি ডাটাবেজ রয়েছে। যুক্তরাজ্যের আইনের জন্যেও আমি এরকম একটি ডাটাবেইজ তৈরির কথা বলেছিলাম। ডেইলি ক্লাউটে যে কেউ যে কোনো আইন সম্পর্কিত তথ্য খুঁজে পেতে পারেন। এই প্রকল্পটি বেশ কার্যকর ছিল।
সমালোচনার তীব্র ঘটনাটি ঘটার ঠিক আগ মুহুর্তে ব্রিটিশ জনগণের প্রতি আমার যুক্তি ছিল, কোনো অভ্যুত্থানের সময় আপনি যখন দুর্বল, তখন ব্রেক্সিটের মত কোনো আইনি সিদ্ধান্ত নিতে পারেন কি না তা খতিয়ে দেখতে পারেন- আমার বইটি কিন্তু ঠিক এই কাজটিই করে। যাই হোক, তথ্য অধিগত করার অধিকার থাকলে ক্ষমতায় থাকা প্রত্যেকের জীবনই জটিল হয়ে যায়। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের যেসব বিধানকর্তা আইন সম্পর্কে মিথ্যে বলতে চেয়েছেন, ডেইলি ক্লাউট কিন্তু তাদের জীবন জটিল করে তুলেছে। কাজেই ক্ষমতায় থাকা বিধানকর্তাদের জন্য “এই স্বাস্থ্য পরিষেবা ক্যান্সার চিকিৎসার জন্য যথেষ্ট” এটা বলা কঠিন হয়ে পড়ে।
ডেইলি ক্লাউটের বদৌলতে টেনেসির মত দূরবর্তী জায়গা থেকেও লোকজন টুইট করে বলতে পারে যে “এই স্বাস্থ্যসেবার বিল ক্যান্সার চিকিৎসার খরচ বহনের জন্য যথেষ্ট নয়।” এখন যে এই দেশে নিজের মত করে আইন ডান-বাম করতে চায়, তার জন্য তো এটা অনেক বড় সমস্যা। আর আমি এর কারণ খুব সহজেই বুঝতে পারছি।
আপনি বৃটিশ উপনিবেশের আইন সম্পর্কে প্রশ্ন করেছেন। আপনার সাথে আমি সম্পূর্ণ একমত। কিন্তু ঘটনা “এ” এর কারণে “বি” ঘটেছে আমি এটা বলতে নারাজ। বরং আমি বলবো একজন কবির কথায় দ্বিমত পোষণ করার কারণে তার খ্যাতির উপর নিরলস আক্রমণ চালানোর প্রয়াসে এরকম তীব্র ভাইরাল সমালোচনা হয়েছে। যাই হোক, এই ঘটনার পর আমাকে দাবার কোট থেকে নামানোর জন্য এই বইয়ের বিরুদ্ধেও কিন্তু অনেক গবেষণা হয়েছে। কাজেই, বইটির ঐ দুইটি রেফারেন্স সংশোধন করতে রাজি হওয়ার পরেও মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে বইটি প্রকাশ করতে অসুবিধার সম্মুখীন হচ্ছি!
“আউটরেজেস” লেখার মূল উদ্দেশ্য ছিল, আমি চাইনি লোকজন এই ভ্রান্ত ধারণা নিয়েই বসে থাকুক যে বৃটিশ সরকার সে সময় কোনো বড় ধরনের ভুল করে নি। উপনিবেশ আইনের পরবর্তী সময়ে অনেক ভালো আইন প্রণয়ন হয়েছে কিন্তু আগের অনেক কিছুই কিন্তু জনসাধারণের জানার বাইরে, তাদের জন্য কিছুই লেখা হয়নি। এখন আপনি যদি চান যে লোকজন এই বিশ্বাস নিয়েই বসে থাকুক যে বৃটিশ সরকার কোনো ভুল করে না, তাহলে “আউটরেজেস” বইটি আপনার জন্য নয়।
রক্ষণশীলদের একটা ট্রাম কার্ড হলো তারা নিজেদের অতীত আইন ব্যবস্থাকে সারা বিশ্বের সাথে সম্পর্কহীন অতুলনীয় এক আইনি ব্যবস্থার পুরাণ আখ্যা বলে চালিয়ে যান। যেমন, দেখবেন আমেরিকাতে অনেকেই (নোয়াম) চমস্কির কথা শুনতে চান না। কারণ তিনি জনপ্রিয় সব নেতাদের দুর্বল কর দেয়ার পিছনে আমেরিকান সরকারের ভূমিকা নিয়ে কথা বলেন।
“আউটরেজেস” গল্পে বিশ্বের বিভিন্ন স্থানে বৃটিশ সরকারের সমকামীদের প্রতি ক্ষোভ ছড়িয়ে দেয়ার বিষয়টি তুলে ধরা হয়েছে। এমনকি যেসব সংস্কৃতিতে সমকামীদের প্রতি আক্রোশ ছিলোনা তাদের ভিতরেও ব্যাপারটা ধীরে ধীরে ছড়িয়ে দেয়া হয়েছে। বৃটিশদের প্রাক্তন উপনিবেশগুলিতে এখনো সেই প্রভাব রয়ে গেছে। সমাজ নিয়ন্ত্রণের উদ্দেশ্যে তৈরিকৃত সে সময়ের আইনগুলো আবার আগের অবস্থায় ফিরিয়ে নিয়ে যেতে ভারতে এখনো সুপ্রিম কোর্টের রায়ের প্রয়োজন হয়। ১৯ শতকে ছড়ানো সেই ঘৃণার গল্পের উপর ভিত্তি করে মিশর এবং মিশরের মত অন্যান্য বেশ কিছু দেশে এখনো পুরুষরা পুলিশ ও রাজ্যের আইনকর্তাদের দ্বারা নির্যাতিত ও গ্রেফতার হন।
শুধুমাত্র উপনিবেশিক আইনের মধ্যেই এসব ব্যাপার সীমাবদ্ধ নয়। বর্তমানে বৃটেনে ক্ষমতার লড়াইয়ে আমি সমকামী এবং ট্রান্সজেন্ডারদের বিরুদ্ধে এই ক্ষোভকে অস্ত্র হিসেবে ব্যবহার হতে দেখছি। এটি আবার একটু আলাদা গল্প। আপনি “আউটরেজেস” বইটি পড়লে দেখবেন রাজ্য এবং মিডিয়া দুটোই এলজিবিটিকিউ ইস্যুতে ভীষণ উত্তেজিত। আমার যুক্তি হলো বৃটিশ সরকার তার এজেন্ডা বাস্তবায়নের জন্য গে, লেসবিয়ান এবং ট্রান্সজেন্দারদের প্রতি যে ক্ষোভ বা ভয় সাধারণ মানুষের রয়েছে, তা খুব নিষ্ঠুরভাবে ব্যবহার করছে।
মুখোপাধ্যায়: আমাদের আলোচনা ইতিহাস এবং সেই সময়ের আইনের বিভিন্ন ভুলের আলোচনার ভিতর হারিয়ে গেছে। আমি আসলে “আউটরেজেস” বইটি নিয়ে আরেকটু জানতে চাই। বইটি মূল বিষয় কী এবং লেখার জন্য আপনি সমকামিতাকেই কেন বেছে নিলেন? আর এই গল্পটি লেখার জন্য আপনি অজানা কোনো কবিকে না বেছে নিয়ে জন অ্যাডন সাইমন্ডকেই কেন বেছে নিলেন?
উলফ: সাইমন্ডস সম্পর্কে আমি লেখার সিদ্ধান্ত নেই কারণ অক্সফোর্ডে আমার থিসিসের উপদেষ্টা এই ক্ষেত্রে একজন বিশেষজ্ঞ। ভিক্টোরিয়ান যৌনতা নিয়ে আমার আগ্রহ তিনি জানতেন। সাইমন্ডসের লেখা বিশাল বিশাল চিঠি তিনি আমাকে পড়তে দেন এবং সত্যি বলতে চিঠিগুলো পড়ে আমি বিমোহিত হয়েছি। শুরুটা হয়েছিল এক কিশোরের চিঠি দিয়ে, যে সত্যিকারের ভালোবাসা সন্ধান করে গেছে। কিন্তু তাঁর জন্ম এমনই এক সময়ে হয়েছে যখন বৃটেনে বাক স্বাধীনতা নেই এবং সমলিঙ্গের ঘনিষ্ঠতা মানেই অপরাধ।
তিনি এক যুবকের প্রতি তার কিশোর মনের সেই প্রেম ত্যাগ করেন কারণ তাঁর বাবা তাকে বুঝিয়ে দিয়েছিলেন যে এই সম্পর্কের কোনো ভবিষ্যৎ নেই। তিনি ভালোবাসার মানুষটির জন্য দীর্ঘ লম্বা এক প্রেমের কবিতা লিখেছিলেন। কিন্তু সেই সাথে একটি ক্ষমা প্রার্থনার চিঠিও তিনি লিখেছেন কারণ সেই সময়, ১৮৬২ সালে, সমলিঙ্গের সাথে যৌন সম্পর্ক স্থাপন করার জন্য যাবজ্জীবন কারাদণ্ড দেয়া হতো।
সাইমন্ডস বৃটিশ কবি, সমালোচক ও সাংস্কৃতিক প্রাবন্ধিক হতে চেয়েছিলেন। কিন্তু যে প্রতিষ্ঠানেই তিনি যান না কেন, তাঁকে কটাক্ষ করা হয়েছে। অক্সফোর্ডে এক সহকর্মী তাঁর কিছু ব্যক্তিগত চিঠি দেখে ফেলায় তাঁকে আরেক সহকর্মীর কাছে রীতিমতন চরিত্র ও নৈতিক স্বার্থ সমর্থন করে পরীক্ষা দিতে হয়েছিল। এ ঘটনার পর কোনোমতে তিনি ফেলোশিপ বাঁচাতে সক্ষম হন। পরবর্তীতে অক্সফোর্ডে কবিতার শিক্ষক হতে চেয়েছিলেন। এটি ছিল বেশ সম্মানের একটি কাজ। কিন্তু তাঁর পরিচয় নিয়ে জনমনে যে বিরূপ চিন্তা ছিল, তাতে অধ্যাপক হবার কোনো সুযোগ নেই, সেটি তিনি জানতেন।
জীবদ্দশায় তাঁকে বেশ কিছু কেলেঙ্কারির সম্মুখীন হতে হয়েছে। তাঁর বাবার নির্দেশে একজন নারীকে তিনি বিয়ে করতে বাধ্য হয়েছিলেন। সেই নারীটিকে তিনি সম্মান করতেন, তাঁদের বন্ধনও দৃঢ় ছিল। কিন্তু একটি চিঠিতে তিনি লিখেছেন বিয়ে এবং মধুচন্দ্রিমার কোনো সময়ই তাঁর মধ্যে কোনো কামনা কাজ করেনি। নিজের প্রথম জীবনের সমস্ত ঘটনা বিশেষ করে সমলিঙ্গের প্রতি প্রাকৃতিকভাবেই যৌন আকর্ষণের ব্যাপারটি তিনি অত্যন্ত সততার সাথে নথিভুক্ত করেছেন।
তাঁর যুক্তি ছিলো সমকামী প্রেমও সুন্দর এবং কোনো প্রেমই অপরাধ নয়। তার চার কন্যা সন্তান তাঁকে অসম্ভব ভালোবাসতেন। সমকামী হওয়া সত্ত্বেও তিনি বাবা এবং স্বামী হিসেবে দারুণ ছিলেন। এবং সে সময়ের সমকামী প্রায় সব পুরুষই এমনটাই ছিলেন।
তিনি দ্বৈত জীবন যাপন করছিলেন। কারণ পুরুষদের সাথে তাঁর প্রেমের সম্পর্ক চলছিল। বয়স বাড়লে সমকামী পুরুষদের সম্প্রদায়ের সাথে থাকার জন্য তিনি ভেনিসে চলে যান। সারাজীবন তিনি শুধু ভালোবাসার সত্যতা নিয়ে লিখতে চেয়েছেন। তবে এটি দিন দিন বিপজ্জনক হয়ে উঠছিল কারণ বৃটিশ সরকার অশ্লীলতা ও বাকস্বাধীনতার উপর অনেক বেশি আইন প্রণয়ন করছিল। যেমন ১৮৫৭ সালে প্রণয়ন করা হয় অশ্লীল প্রকাশনা আইন। বৃটিশদের অশ্লীলতার সংজ্ঞা তাদের সব উপনিবেশে ছড়িয়ে দেয়া হয়।
অশ্লীল প্রকাশনা আইনে অশ্লীল বলে বিবেচিত হতে পারে এমন যে কোনো কিছু প্রকাশ করাই বিপজ্জনক ছিল। এছাড়াও ফ্রান্সে সাইমন্ডসের বন্ধুরা যৌন আবেদনের জন্য গ্রেফতার হচ্ছিল। এতে করে বৃটেনে সাইমন্ডসের কর্মজীবনও ধ্বংস হচ্ছিল। সাইমন্ডস প্রেমের সত্যতা সম্পর্কে বলার চেষ্টা করেছিলেন কিন্তু এসব কিছুই বৃটেনে ছিল অবৈধ। তখন তিনি এমনভাবে লেখা শুরু করলেন যেন আইন থেকে পালাতে পারেন। তিনি রূপক অর্থে অতীতের বিভিন্ন ঐতিহাসিক সমকামী পুরুষদের জীবনী লিখতে শুরু করলেন। তাঁর ভালোবাসার কবিতাগুলোতে তিনি প্রেমিকদের সর্বনাম পরিবর্তন করে প্রকাশ করতেন। এই পুরো সময়ের সব লেখা তিনি স্মৃতিচারণের জন্য একটি বাক্সে সংরক্ষণ করে রাখেন।
এই প্রেমময় কবিতাগুলোতে তিনি সমকামী পুরুষদের বিয়ের কথা কল্পনা করেছিলেন বাস্তবে ঘটারও প্রায় ১৫০ বছর আগে। তার জীবনের শেষে দিকে আমেরিকান কবি ওয়াল্ট হুইটম্যানের সাথে তার খুব সুন্দর এবং যৌন উত্তেজনাপূর্ণ একটি সম্পর্ক ছিল যা তাঁকে সমলিঙ্গের সাথে প্রেমের কথা স্বীকারে বেশ সাহস যোগায়।
জীবনের শেষ দিকে তিনি সমকামীদের অধিকারের জন্য ইংরেজিতে একটি ইশতেহার লিখেছিলেন। আমার পড়া অনুযায়ী এটিই এরকম প্রথম কোনো ইশতেহার। ইশতেহারে সমকামী পুরুষদের আইনি অধিকারের বিষয়ে বলা হয়। তাঁর মৃত্যুর পর এটি প্রকাশিত হয় এবং গোপনে হাতে হাতে ঘুরতে থাকে। এখান থেকে আধুনিক চিন্তার সূত্রপাত হয় যে কীভাবে একজন সমলিঙ্গের প্রতি যৌন আকর্ষণকে নৈতিক ব্যর্থতা হিসেবে না চিন্তা করে প্রাকৃতিক বৈচিত্র্য হিসেবে ভাবা যেতে পারে।
মৃত্যুর পর তিনি ঠিকই জিতে গিয়েছিলেন। কিন্তু তাঁর জীবদ্দশায় তিনি জানতেন না যে তিনি জিতবেন। তবে সাইমন্ডস কখনো ভালোবাসার উপর বিশ্বাস হারান নি। ভবিষ্যৎ প্রজন্ম তার গোপন স্মৃতিগুলো কীভাবে ডিকোডের মাধ্যমে বের করবে সেই নির্দেশনা রেখে গিয়েছিলেন। কারণ তিনি চাইতেন জীবদ্দশায় যে ভালোবাসার কথা তিনি বলতে পারেন নি তা যেন প্রকাশ পায়। এ কারণেই তিনি জন অ্যাডিংটন সাইমন্ডস। তার গল্প এলজিবিটিকিউ আন্দোলনে অনেক গুরুত্বপূর্ণ বিষয় তুলে ধরে।
আমার বইতে আমি উল্লেখ করেছি কীভাবে সাইমন্ডসের ওই সময় সমকামী প্রেম ও যৌনতার জন্য মানুষকে গ্রেফতার ও মৃত্যুদণ্ড দেয়া হতো। সংবাদপত্রগুলি এসব রিপোর্ট প্রকাশ করতো। এমনকি অপরাধীদের বিদেশে যাবজ্জীবন কারাদণ্ড ও কঠোর পরিশ্রমের জন্য পাচার করা হতো।
মুখোপাধ্যায়: ভিক্টোরিয়ান ইংল্যান্ডে সমকামী যৌনতা একটা রাজনৈতিক সমস্যা ছিল এবং এর পরেও এটি সমস্যা হিসেবেই চিহ্নিত হয়েছে
উলফ: বৃটিশ ইতিহাসবিদরা আমার যুক্তির প্রতিবাদে বলেন যে ১৮৩৫ সালের পর থেকে সমকামী সম্পর্কের বিরুদ্ধে আইন শিথিল হয়েছে। কিন্তু উপনিবেশবাদের সময়কালের সেইসব আইন সম্পর্কে তারা কোনো কথা বলেন না। একজন ইতিহাসবিদের সাথে আমার তর্ক হয়েছিল, উনি আমাকে বলেছিলেন যে ১৯ শতকে বৃটেনে সমকামী পুরুষদের খারাপ অবস্থার কোনো প্রমাণ নেই। আমি তখন তাকে উপনিবেশের সময়কাল বাদ দেওয়ার কারণ জিজ্ঞাসা করেছিলাম। সমকামী পুরুষদের শাস্তিস্বরূপ উপনিবেশগুলিতে স্থানান্তরিত করা হয়েছিল এবং বৃটেনের সমকামী সম্পর্কিত আক্রোশের ধারণাও উপনিবেশগুলোতে ছড়ানো হচ্ছিল।
আমি একজন প্রাক্তন রাজনৈতিক পরামর্শদাতা এবং গুয়ান্তানামোতেও ঘুরে এসেছি। আমি বৃটিশ ইতিহাসবিদদের মতে বৃটেনে সমকামী পুরুষদের সাথে তেমন খারাপ কিছুই হয়নি, এই ঐকমত্যের কারণের ব্যাপারে আগ্রহী। আপনি যদি তথ্য উপাত্ত ঘেটে দেখেন তাহলে দেখবেন যে শুধু ইংল্যান্ড এবং ওয়েলসেই নয়, স্কটল্যান্ডেও বহু বছর ধরে সমকামী প্রেম ও যৌনতার জন্য মৃত্যুদণ্ড শাস্তি ছিল। তারা এমনকি আয়ারল্যান্ড, নিউ সাউথ ওয়েলস এবং উপনিবেশগুলোকেও গণনায় ধরছে না। অথচ যৌনতার জন্য পুরুষদের পাচার করা হয়েছিল। রাজনৈতিক সমস্যা দূর করতে চাইলে আপনি তাদের বন্দী করে রাখবেন বা অন্য দেশে পাঠিয়ে দেবেন সেটা বোঝা গেছে। কিন্তু আমার প্রশ্ন হলো এই তথ্যগুলি কেন নথুভুক্ত করা হয়নি বা ইতিহাসবিদরা কেন বলছেন যে পরিস্থিতি খারাপ ছিল না?
মুখোপাধ্যায়: আপনি কি মনে করেন “আউটরেজেস” এর বিরুদ্ধে আরো কিছু প্রতিশোধ নেয়া বাকি আছে? কারণ এখানে আমি আরেকটি বিষয় দেখতে পাচ্ছি যা হল এলজিবিটিকিউ এবং সম্প্রদায়ের বিরুদ্ধে বৈষম্য। আপনার কী মনে হয়, মানুষ এই ব্যাপারগুলিতে অস্বস্তি বোধ করে?
উলফ: এলজিবিটিকিউ এর ইতিহাস খুবই গুরুত্বপূর্ণ। কিন্তু এটি স্পষ্টভাবেই দমিয়ে রাখা হয়েছে। ২৫ বছর ধরে আমি সাহিত্য নিয়ে পড়াশুনা করছি। সাহিত্য গবেষণায়, ১৯ শতকে বৃটেনে সমকামী পুরুষদের মধ্যে সবচেয়ে বাজেভাবে নিপীড়নের শিকার হয়েছিলেন অস্কার ওয়াইল্ড। আমার গবেষণার এক পর্যায়ে এটা আবিষ্কার করে আমি নিজেই হতবাক হয়ে গিয়েছি।
আমার গবেষণায় আমি এইচ. জি. কক্স, চার্লস আপচার্চ এবং গ্রাহাম রব নামে তিনজন জ্ঞানী ব্যক্তির সন্ধান পেয়েছি যারা নিশ্চিত করেছেন যে সে সময় বৃটেনে ৫৫ জন পুরুষকে সমকামিতার অপরাধে ফাঁসি দেয়া হয়েছিল। অস্কার ওয়াইল্ডেরর বিচারের কয়েক বছর আগেও দশকের পর দশক ধরে সমকামীপুরুষদের হয় ফাঁসি নাহয় যাবজ্জীবন কারাদণ্ড দেওয়া হয়েছে। উনবিংশ শতাব্দীতে লোকজনের কাছে সমকামিতার জন্য শাস্তির খবর ছিল বিনোদন।
ভিক্টোরিয়ান সময়ে রাজ্য থেকে সমকামী পুরুষদের নারীর পোশাক পরিয়ে সমাজে বাকিদের হুমকি দেয়ার জন্য উপস্থাপন করা হত। ট্রান্সজেন্ডাররা সমাজের জন্য কীভাবে হুমকির কারণ হয়? মেয়েলি সাজের ব্যাপার নিয়ে আমার বইতে পুরো একটি অধ্যায় রয়েছে। এখানে অতিরিক্ত নারীবাদিতার কী আছে? মানুষের তো প্রশ্ন করা উচিত একজন পুরুষের পৌরষত্ব কীভাবে তার পোশাক নির্ধারণ করে? পুরুষ কীভাবে নিজেকে উপস্থাপন করবে তা রাষ্ট্র কেন ঠিক করে দেবে? আর সবচেয়ে বড় কথা এইসব চিন্তাভাবনাগুলি উপনিবেশগুলোতেও ছড়িয়ে দেওয়া হয়েছে।
“আউটরেজেস” এর মূল প্রতিপাদ্য হল, আমাদের অন্তরঙ্গ জীবন, আমাদের বাকস্বাধীনতা, আমাদের পোশাকি উপস্থাপন এসব কিছুই রাষ্ট্র বৃহত্তর জনগণকে নিয়ন্ত্রণে রাখার জন্য এবং দমিয়ে রাখার জন্য নিয়ন্ত্রণ করে। নইলে জনগণ যে কোনো মুহুর্তে তাদের অধিকারের দাবি করে বসবে। এই নিয়ন্ত্রণের সবচেয়ে উৎকৃষ্ট দৃষ্টান্ত হলো উপনিবেশিক ইতিহাস। খুব অল্প সংখ্যক মানুষই কিন্তু পুরো জনগণকে নিয়ন্ত্রণ করে। এই আইনগুলো লোকজনকে নিয়ন্ত্রণ করতে বেশ কার্যকর ছিল।
মুখোপাধ্যায়: ইতিহাসের একটি বিষয় যেটা মানুষ এড়িয়ে গেছে সেটা হলো নারীদের রাষ্ট্রীয়ভাবে পরাধীনতা। ভিক্টোরিয়ান ইংল্যান্ডের আইন কীভাবে নারীজীবনে অনুপ্রবেশ করেছিল?
উলফ: এখানে আসলে খুব বিস্ময়কর একটা ঘটনা আছে। বৃটিশ উপনিবেশ আইনে যৌনকর্মীদের এবং যেসব নারীদের যৌনকর্মী হিসেবে দোষ দেওয়া হতো তাদের নিয়ন্ত্রণের চেষ্টাও করা হয়েছে। প্রথমে উপনিবেশিক আইনের মাধ্যমে চেষ্টা করার পর সংক্রামক রোগ আইন প্রণয়ন করা হয়। নারী জীবনে কীভাবে এই আইন অনুপ্রবেশ করে এবং উপনিবেশ অঞ্চলে নারী প্রজাদের কীভাবে বিভিন্ন সময় এর জন্য পরীক্ষা দিতে হয়েছে সে সম্পর্কে বেশ কিছু দলিল রয়েছে।
মুখোপাধ্যায়: এই প্রসঙ্গের সাথে আমার পরবর্তী প্রশ্নটি জড়িত। সম্প্রতি একজন স্ত্রীরোগ বিশেষজ্ঞ টুইটার ব্যবহার বাদ দেয়ার আহবান জানিয়েছেন কারণ টুইটার তার প্রকাশকের ব্যবহার করা “যোনি” শব্দটি সেন্সর করেছিল। শব্দটি এখনো সমাজে লজ্জাজনক। এই ধরনের অস্বস্তিকর বিষয়ে কথা বললে মানুষ এতো প্রতিক্রিয়া দেখায় কেন?
উলফ: নারীর যৌনতার চিত্রায়ণ তো পুরোটাই দালালির জন্য। পাচার করা কিছু নারীর দেহ পর্ণোগ্রাফিতে দেখানো বা চুরি করে একজন মায়ের শিশুকে স্তনপান করানোর ছবি মিলিয়ন মিলিয়ন মানুষকে দেখানো যৌনতা নয়। কিন্তু নারী যখন নিজের দেহের অধিকার দাবি করে বসে, তখন সবাই অস্বস্তিতে পড়ে। যোনির কারণে মানুষ অস্বস্তিতে পড়ে না। যোনি মালিকেরা যখন তাদের সাথে কী কী হয়েছে, তা নিয়ে কথা বলা শুরু করে, তখন লোকে অস্বস্তিতে পড়ে। এই ডাক্তারের বই “যোনি”কে আমাজন সেন্সর করেছিল। যদিও বইটি বেশ হৈ চৈ ফেলে দিয়েছে।
নারীরা নিজেদের সাথে ঘটে যাওয়া ঘটনাগুলো নিয়ে যখন বলা শুরু করে তখন মানুষ এটাকে অস্বাভাবিকভাবে নেয় কেন? রাষ্ট্র নারীর শরীর এবং জীবনের উপর অনধিকার চর্চা সবসময়ই চালিয়ে এসেছে। যৌন নির্যাতন এবং পারিবারিক নির্যাতন এই অনধিকার চর্চার একটি বড় অংশ। বিচার বিভাগে এ বিষয়ে কোনো ব্যবস্থাও নেই। এর সবচেয়ে বড় উদাহরণ হলো ভারত। ভারতে নারীবাদী জাগরণ, নারীদের সংঘবদ্ধ হওয়া, কথা বলার, আইন প্রণয়নের চেষ্টা করা এবং নেটওয়ার্ক তৈরি করার মতো সংবাদ শুনে আমি ভীষণ অনুপ্রাণিত হই। যৌন নিপীড়নের বিরুদ্ধে নারীদের এই জাগরণ আমেরিকাতে নারীবাদী জাগরণের চেয়েও অনেক বেশি কার্যকর আমি বলবো।
একই সাথে আপনি নারী ও পুরুষের শারীরিক শক্তির বিষয়টা দেখুন। পুরুষের শক্তির প্রকাশ ঘটেই কীভাবে সে কতো শক্তি প্রয়োগ করে একটা যোনির মালিক হতে পারে তার উপর নির্ভর করে। এতে করে নারীর আকাঙ্ক্ষাও কিন্তু নিয়ন্ত্রিত হয়। পুরুষতন্ত্র বারবারই দেখিয়ে দেয় যে যৌন নিপীড়ন নারীকে পরাধীন করে রাখার সবচেয়ে বড় অস্ত্র এবং এটা না থামালে নারীর পরাধীনতা দূর হবে না। কাজেই নারী যখন যোনিকে যোনি বলা শুরু করলো এবং নিজের সাথে হওয়া সমস্ত অন্যায় নিয়ে মুখ খোলা শুরু করলো তখন এটা একটা দারুণ বিপ্লবে রূপান্তরিত হলো।
১৯ বছর বয়সে আমার শিক্ষক আমাকে যে হয়রানি করেছিলেন সেটা নিয়ে আমি ৪০ বছর বয়সেও কথা বলতে ভয় পেয়েছি। আমার বিয়ে হয়েছে, দুটো সন্তান আছে, সামাজিক অনেক বাধা আছে, সেসব ভেবেছি। আমি আরো বেশি ভয় পেয়েছিলাম কারণ ছোট থেকেই আমাদের শেখানো হয়েছে আমাদের সাথে শারীরিক কোনো হয়রানি ঘটলে সে সম্পর্কে কথা না বলা। যদি সেসব নিয়ে কথা বলি তাহলে আমাদেরই উল্টো বেশ্যা উপাধি দেয়া হবে। কাজেই যখন নারীরা “যোনি” শব্দটি উচ্চারণ করতে পারে, আদালতে দাঁড়িয়ে স্পষ্টভাবে বলতে পারে যে এই পুরুষটি আমাকে স্পর্শ করেছে, আমাকে ধর্ষণ করেছে তখন তাদেরকে আর চুপ করানো যায় না। যোনির মালিক কে সেটা জরুরি না, তিনি কতোটা স্পষ্ট সেটাই ইতিহাস মনে রাখবে।
মুখোপাধ্যায়: ২০ বছর আগে আপনি “দ্য বিউটি মিথ” লিখেছিলেন। আপনার কি মনে হয় নারীর শরীর, শারীরিক সৌন্দর্যভিত্তিক ইস্যুগুলো বেড়ে ওঠার পেছনে মূল কারণ সোশ্যাল মিডিয়া?
উলফ: এটা একটা ভালো প্রশ্ন, আমাকে অনেকেই এই প্রশ্নটি জিজ্ঞাসা করেন। “দ্য বিউটি মিথ” লেখার পর থেকে এই পর্যন্ত অনেক কিছুই পরিবর্তন হয়েছে আবার অনেক কিছুই পরিবর্তন হয়নি। আমার মনে হয় এই প্রজন্মের নারীরা বিভিন্ন বিষয়ে কথা ও সামাজিক অনেক ইস্যুতে সমালোচনা করার ক্ষেত্রে নিজেদের অনেকটা ক্ষমতাসীন করতে পেরেছেন। আমি যখন বিউটি মিথ লিখেছি তখন আসলে নারীর সৌন্দর্যের মাপকাঠি বা সামাজিক রীতিনীতি নিয়ে এতো সমালোচনা করার সাহস কারো ছিল না।
শেষবার ভারত সফরে শত শত সংঘবদ্ধ প্রতিভাবান নারীবাদীদের সাথে আমার দেখা হয়েছে। শুধু শহরাঞ্চলের নয়, গ্রামাঞ্চলের পূর্ণবয়স্ক নারীরাও স্কুল-কলেজে যাচ্ছেন। এটা আমাকে ভীষণ অনুপ্রেরণা দেয়। নারীরা এখন বিশ্বব্যপী সমালোচনা করতে পারছে। অবশ্য এখনো অনেক কিছুই আছে যা উন্নত হয়নি।
যেমন, অ্যানোরেক্সিয়া এবং বুলিমিয়ার পরিসংখ্যান পরিবর্তন হয়নি। আমার মনে হয় তরুণীরা ইন্সটাগ্রামে নিজেদের সুন্দর দেখানো নিয়ে অনেক বেশি চিন্তিত, যেটা পরবর্তীতে মানসিক উদ্বেগের কারণ হতে পারে। নিজেকে সুন্দর দেখাতে হবে, এই ভয়টা তরুণ এবং পুরুষদের মধ্যেও রয়ছে। প্লাস্টিক সার্জারির ক্রমবর্ধমান সহজলভ্যতা বেড়ে যাওয়ার এটা একটা কারণ।
মুখোপাধ্যায়: লক্ষ্য করছি গত কয়েক বছরে আপনার লেখার কাজের সমালোচনা বেড়েছে। এর কারণ হিসেবে আপনি কী মনে করেন? আর লেখার অনুপ্রেরণা কীভাবে পান?
উলফ: অত সহজে হাল ছেড়ে দিলে, আজ আমি নারীবাদী হতে পারতাম না! যখন আমি পাশ্চাত্য সমাজের মধ্যবিত্ত নারীদের ডায়েট নিয়ে লিখেছিলাম তখন আমি মিডিয়ার চোখের মণি ছিলাম। যে বিষয়গুলো নিয়ে আমি লিখছিলাম সেগুলো জরুরি ছিল এবং আমি আগ্রহ নিয়েই লিখছিলাম, কিন্তু সেসব বিষয় কোন গুরুতর শক্তির বিরুদ্ধাচরণে শক্তিশালী ছিল না। যখন থেকে গণতন্ত্রপন্থী চর্চা শুরু করলাম তখন থেকে সমালোচনা ঘনীভূত হতে শুরু করল। আমার ধারণা এর কারণ আমি শিল্প সমালোচনা না করে সাধারণ জনমনে আইন এবং আইনের পরিবর্তনীয় বিষয়গুলো নিয়ে কথা বলেছি। এবং এই পুরো বিষয়টা বিরোধিতার এক ভিন্ন পর্ব উন্মোচন করেছে।
কিন্তু আমি কেন লেখা ছাড়িনি? ৫৬ বছর বয়সেও আমি আক্রমণের শিকার হই। “দ্য বিউটি মিথ”কে তো প্রচন্ডভাবে আক্রমণ করা হয়েছিল। আমার মনে আছে আমার মাকে ফোন করে আমি বলছিলাম যে কেন আমি এই বইয়ের পিছনে দৌঁড়াচ্ছি যেখানে লোকজন আমার উপর উল্টো রেগে আছে। এমনকি নারীবাদীরা পর্যন্ত আমার উপর ক্ষিপ্ত। জাতীয় টেলিভিশনে পর্যন্ত আমাকে আক্রমণ করা হয়েছে। আমার মা আমাকে বললেন, থেমে যেও না। আমিও জানতাম, আমার থেমে না যাওয়াটাই সবচেয়ে জরুরি। আর এখন দেখুন, উচ্চ বিদ্যালয় এবং কলেজের পাঠ্যসূচীতে “দ্য বিউটি মিথ” রয়েছে।
২০১২ সালে লোকজন আমাকে ‘‘ভ্যাজাইনা’ বইটি নিয়ে আক্রমণ করলো। আর এখন আধা ডজন বই এই বইটি থেকে অনুপ্রাণিত হয়েছে এবং নারীরা তাদের জীবনের যৌন হয়রানির ঘটনা নিয়ে অনেক স্বচ্ছন্দ্যে কথা বলছেন। এখানে আমার কিছুটা ভূমিকা ছিল। এখন কিন্তু বইটিকে আর সমালোচনার চোখে দেখা হয় না।
আমার সমালোচকরা “আউটরেজেস” নিয়ে এখন সমালোচনা করছে। তারপরেও আমি জানি যে এটা ঠিক। এখানে ভুল ব্যাখ্যা দুটি সংশোধন করা হয়েছে। এই বইটি গুরুত্বপূর্ণ। এলজিবিটিকিউ এর ইতিহাসের একজন হারিয়ে যাওয়া অগ্রদূতের গল্প বলা দরকার ছিল। আমি তার কণ্ঠ মানুষের কাছে তুলে ধরতে যাচ্ছি না। গঠনমূলক সমালোচনা গ্রহণ করা এবং সে অনুযায়ী কাজ করা আমার দায়িত্ব। কিন্তু মানুষের মননের উন্নয়ন করা আমার পক্ষে সম্ভব না। মানুষকে তার ইচ্ছার চেয়ে দ্রুত বিকশিত করা আমার পক্ষে সম্ভব নয়।
আমি জানি, “ভ্যাজাইনা”, “আউটরেজেস” এই বইগুলো গুরুত্বপূর্ণ। ইতিহাসে সাইমন্ডসও অনেক গুরুত্বপূর্ণ। এই বই নিয়ে আমি অনেক সমর্থন এবং প্রশংসাও পেয়েছি, গুগলে কিন্তু সব দেখতে পাবেন না। ইতালিতে নারীদের জন্য একটা জাদুঘরে একটি জায়গা আমার জন্য উৎসর্গ করেছেন। এমনকি এই হামলার পরেও আমি ট্রিনিটি কলেজ থেকে নারীবাদী দর্শনে অবদান রাখার জন্য আমন্ত্রণ পেয়েছি, তারা আমাকে সম্মানিত করেছেন। টুইটারে হয়তো আমাকে কেউ সেভাবে দেখেন না, তবে বাস্তবে অনেকেই আমার প্রশংসা করেছেন।
মুখোপাধ্যায়: বর্তমান রাজনৈতিক পরিস্থিতির সাথে কি এই সমালোচনার উত্থানের কোনো সম্পর্ক আছে?
উলফ: সরাসরি সম্পর্ক যদি আপনি দেখেন, তাহলে অবশ্য আমি মানা করবো না। রাশিয়া, আমেরিকা, বৃটেন, ব্রাজিল বা সৌদি আরবের মত দেশগুলোর রাজনৈতিক নিয়ন্ত্রণ খুব স্পষ্টভাবেই দেখা যায়। এই তালিকায় ইজরায়েলকেও আমি রাখতে চাই। প্রাক্তন রাজনৈতিক পরামর্শদাতা হিসেবে এই দেশগুলো গণতন্ত্রের বাইরে নেতৃত্ব দিচ্ছে এবং তাদের নিয়ন্ত্রণে অন্য দেশগুলোতেও গণতন্ত্রের বাইরে বিভিন্ন পরামর্শ দিয়ে কাজ করছে।
কাজেই, দিনে দিনে জাতি এবং রাষ্ট্রের গুরুত্ব কমছে। আর প্রাধান্য পাচ্ছে গুটিকয়েক নেতার নেতৃত্ব। শক্তিশালী গণতন্ত্রের জন্য শক্তিশালী জাতি-রাষ্ট্রের প্রয়োজন। যারা গণতান্ত্রিকভাবে চলতে চায় না তারা জাত-রাষ্ট্রের শক্তিও পছন্দ করে না। এরা মানুষকে বিভক্ত করে দিতে চায়। আমার আগের বই “দ্য এন্ড অফ আমেরিকা”তে ভবিষ্যদ্বানী করেছিলাম এভাবেই অ-গণতান্ত্রিক উত্থান হবে।
আমি জানি না এই সমালোচনার সাথে এই রাজনৈতিক বিষয়ের কোনো সম্পর্ক আছে কি না। তবে গণতন্ত্রপন্থী এবং পরিবেশবাদী কর্মীদের অনেককেই ফোন করা হচ্ছে। প্রচুর ধোঁয়াশাপূর্ণ প্রচারণা চালানো হচ্ছে, মানুষকে টুইটারে নিয়ন্ত্রণ করা হচ্ছে, সাংবাদিকদের হুমকি দেয়া হচ্ছে। কারা করছে, কেন করছে আমি সেটা নিয়ে কথা বলতে চাই না। তবে হয়রানি করা হচ্ছে। হয়তো আমি স্বাভাবিকের চেয়ে বেশি বিরক্তিকর বলেই আরো বেশি হয়রানি করা হচ্ছে।
[ফাতেমা তুজ জোহরা: কন্টেন্ট রাইটার ও ডিজিটাল মার্কেটিয়ার]