আবা বিদ্রোহ : কেন জ্বলে উঠেছিলেন নাইজেরিয়ার নারীরা?
কারিন আশরাফ ।।
“তোমার বিধবা মাকেও কি গুনেছ?”
কথাটা মাদাম নোয়ানইয়েরুয়ার, যিনি নাইজেরিয়ার প্রতিবাদ ও নারীত্বের প্রতীক। দক্ষিণ-পূর্ব নাইজেরিয়ায় ১৯২৯ সালের নভেম্বর থেকে ডিসেম্বরব্যাপী ঘটে যাওয়া ঐতিহাসিক আবা নারী বিদ্রোহ ঠিক এই কথাটির মধ্য দিয়েই শুরু হয়। এই আন্দোলন ব্রিটিশ উপনিবেশবাদ আর পুরুষতান্ত্রিকতার বিরুদ্ধে নারীদের ভীষণ প্রতিবাদের অনন্য উদাহরণ।
ব্রিটিশ উপনিবেশবাদের শিখরে নাইজেরিয়ার বিভিন্ন প্রদেশে ‘ওয়ারেন্ট চিফ’ নামক পদ সৃষ্টি করা হয়েছিল। এই পদে স্থানীয় কোনো লোককে দায়িত্ব দেয়া হত ব্রিটিশ শাসনের অধীনে প্রদেশগুলোতে বিভিন্ন কাজ পরিচালনার জন্য। ইগবোল্যান্ড তথা দক্ষিণ-পূর্ব নাইজেরিয়ার রাজনৈতিক প্রথাগুলোর ব্যাপারে ব্রিটিশরা কিছুই জানত না। ব্রিটিশ অনুপ্রবেশের আগে একটা বড় গ্রুপের মাধ্যমে বিভিন্ন রাজনৈতিক সিদ্ধান্ত নেওয়া হত। তাদের নির্বাচিত করত জনগণ। নারীদেরও রাজনীতিতে অংশগ্রহণ ছিল। তারা স্বতঃস্ফূর্তভাবে গ্রামের সালিশে অংশ নিত, আর বয়স্ক নারীদের অন্তর্ভুক্ত করা হত গ্রামের প্রতিনিধিদের মধ্যে। ইগবো মার্কেট বা হাটগুলোতে মহিলাদের নিজস্ব নেটওয়ার্ক ছিল। তারা এখানে পাম তেল বিক্রি করত আর ছোটখাটো ব্যবসা করত। ইগবো নারীরা ঐতিহ্যগতভাবেই কর দেওয়া থেকে মুক্ত।
কিন্তু ব্রিটিশদের নতুন এই স্থানীয় সরকারব্যবস্থা সাধারণ মানুষের কাছ থেকে ক্ষমতা কেড়ে নেয়। ব্রিটিশ গভর্নরের নিযুক্ত ওয়ারেন্ট চিফ আর জনগণের প্রতিনিধি থাকে না। বরং দিনকে দিন হয়ে ওঠে অত্যাচারী। বিশেষত নারীরা বেশি অতিষ্ঠ হয়ে উঠছিল। কারণ এই চিফেরা যখন তখন যেকোনো নারীকে জোর করে বিয়ে করত, নারীদের গবাদিপশু আটকে রাখত আর তাদের আয় থেকে অংশ দাবি করত।
ইগবোদের অর্থনীতি মূলত ছিল পামতেল রপ্তানির উপর নির্ভরশীল। বেশিরভাগ মানুষই পামতেল ও শস্য বেচে জীবিকা নির্বাহ করত। ১৯২৯ সালে অর্থনৈতিক মন্দা (Economic Depression) এর কারণে এসব পণ্যের দাম কমে গিয়েছিল। ফলে সাধারণ মানুষের জীবনেও এর একটা প্রভাব ছিল। কিন্তু ব্রিটিশ প্রশাসন এরপরেও দাম অনুসারে করের হার সামঞ্জস্যপূর্ণ করেনি।
ওয়েরি প্রদেশের ইবো গ্রামের একটা জায়গা ওলোকো, যার ওয়ারেন্ট চিফ ছিল ওকুগো। তার ওপরে নির্দেশ ছিল গ্রামের পরিবারগুলোর লোকসংখ্যা গুনে সেই অনুসারে কর আদায় করা। তখন একটা গুজব রটে যায় যে, নারীদেরও কর দিতে হবে। গুজবটি গ্রামবাসীর মধ্যে ক্রোধের সঞ্চার ঘটায়। এই রটনার কিছুদিন পরে ওকুগো তার এক সহকারীকে কিছু লোক গুনতে পাঠায়। এ সময় সহকারীটি নোয়ানইয়েরুয়াকে জিজ্ঞেস করে তার পরিবারের ছাগল, ভেড়া আর লোকের সংখ্যা। প্রচণ্ড অপমানিত হয়ে নোয়ানইয়েরুয়া ছুঁড়ে দেন এই বাক্যটি, “তোমার বিধবা মাকেও কি গুনেছ?” ঝগড়া লেগে যায় তাদের মধ্যে, সহকারী তার গলা চেপে ধরে, শেষমেষ সহকারীর গায়ে নোয়ানইয়েরুয়া পাম তেল ঢেলে দেন!
এই ঘটনার কারণে ওলোকোর নারীরা নিশ্চিত হয় যে, সরকার নারীদের কাছ থেকেও কর নেবে। এতদিন শুধু পুরুষের উপরে ট্যাক্স থাকলেও সেখানে পরিবারের নারীকেও সাহায্য করতে হত, কারণ তাদের আয়ের তুলনায় করের হার ছিল অনেক বেশি। এটা যে শুধু বড় ধরনের একটা ‘কালচারাল শক’ ছিল তা নয়, বরং এতে অনেক নারীর ব্যবসা আর আয় বন্ধ হয়ে যাওয়ার আশঙ্কা তৈরি হয়েছিল।
ঘটনা দ্রুতই ছড়িয়ে যেতে থাকে। গ্রামের সব মহিলাদের কাছে পাঠানো হয় একটি করে পাম পাতা। এই পাতা ছিল আন্দোলনে অংশ নেয়ার জন্য আহ্বানবিশেষ, যে পাতা পাবে সে আরেকজনকে পাতা দেবে আর খবরটা জানাবে।
ইগবো নারীদের প্রতিবাদের একটা পন্থা ছিল, যা হয়তো আমাদের কাছে অদ্ভুত ঠেকবে। কোনো পুরুষের করা অসম্মানের প্রতিবাদে তারা জড়ো হত সেই লোকের বাড়ির বাইরে, গান করত, নাচত আর চিৎকার করে জানান দিত লোকটির কুকর্মের কথা। এই পদ্ধতিটির নাম ছিল ‘পুরুষের উপরে বসা’, যার ভাবার্থ হলো পুরুষের বিরুদ্ধে যুদ্ধের ডাক দেওয়া। নোয়ানইয়েরুয়ার সাথে হওয়া দুর্ব্যবহারের প্রতিবাদে আশেপাশের প্রদেশগুলো থেকেও নারীরা এসে একত্র হল ওয়ারেন্ট চিফ ওকুগোর বাড়িতে। এই সমাবেশে তারা নির্যাতনের শিকার হয়েছিল, এতটাই যে যার ফলে একজন নারীর গর্ভপাত হয়ে গিয়েছিল। এই ঘটনায় ১০ হাজার নারী ডিস্ট্রিক্ট অফিসারের কাছে অভিযোগ করে ও টানা দুইদিন অফিসের সামনে বিক্ষোভ করে। ফলস্বরূপ, ওয়ারেন্ট চিফ ওকুগো দুই বছরের জন্য জেলে যায় এবং ওলোকোর নারীরা কর থেকে দায়মুক্ত হওয়ার একটি লিখিত নিশ্চয়তা পায় ।
এরপরে বিক্ষোভ কিছুটা শান্ত হয়ে এলেও কর দেওয়ার বিষয়ে ওলোকোর নারীরা থাকে সন্দিহান। তাদের বিক্ষোভের খবরটা ছড়িয়ে যেতে থাকে অন্যান্য প্রদেশেও। একজন নারীর কর প্রত্যাখ্যান পরিণত হয় দুই প্রদেশের হাজারো নারীর আন্দোলনে। তারাও একই দাবি জানাতে থাকে, যেন কর না নেয়া হয় আর অত্যাচারী ওয়ারেন্ট চিফদের বহিস্কার করা হয়।
ইগবোল্যান্ডে চলমান থাকে বিদ্রোহ। বিভিন্ন গ্রামে নো-ট্যাক্স গ্যারান্টি আর ওয়ারেন্ট চিফের পদত্যাগের দাবিতে চলতে থাকে বিক্ষোভ। এসব বিক্ষোভে নারীরা উপস্থিত হত ট্র্যাডিশনাল যুদ্ধের পোশাকে: তারা শুধু শরীরের নিম্নাংশ ঢাকতেন, মাথায় ফার্ন পরতেন আর মুখে রঙ মাখাতেন। তাদের উদ্দেশ্য ছিল অস্বস্তির সৃষ্টি করা, তাদের দাবিগুলোর প্রতি যাতে গুরুত্ব দেওয়া হয়। তারা ডিস্ট্রিক্ট অফিসের সামনে দিনের পর দিন বসে থাকতেন, ঐতিহ্যবাহী যুদ্ধসংগীত করতেন আর অফিসারদের সবখানে অনুসরণ করতেন। বিক্ষুব্ধ নারীরা বেশকিছু ব্রিটিশ ডিস্ট্রিক্ট অফিস এবং আদালতও পুড়িয়ে দেয়।
ব্রিটিশ প্রশাসন এহেন আচরণের কারণ বুঝতে না পেরে আশ্রয় নেয় সহিংসতার। ডিসেম্বরের মাঝামাঝি সময়ে তারা সশস্ত্র বাহিনী পাঠায়, যারা সরাসরি বিক্ষোভকারীদের ওপর গুলি চালায়। পঞ্চাশজনের মৃত্যু হয়, আহত হয় আরো পঞ্চাশজন। ব্রিটিশদের নির্মম প্রতিরোধের কারণে আন্দোলন স্তিমিত হয়ে আসে ঠিকই, কিন্তু এই ‘নারীযুদ্ধ’ কম কিছু অর্জন করেনি। বেশকিছু গ্রামের ওয়ারেন্ট চিফ পদত্যাগ করতে বাধ্য হয়। বেশিরভাগ গ্রামই লিখিত গ্যারান্টি আদায় করে নেয়। ব্রিটিশ প্রশাসন বাধ্য হয় ওয়ারেন্ট চিফ পদ্ধতির বিকল্প চিন্তা করতে। ১৯৩৩ সালে নতুন একধরনের স্থানীয় সরকার ব্যবস্থার প্রচলন হয়, যেখানে একটি বেঞ্চ গঠন করা হত এবং গ্রামবাসী কয়েকজন বিচারককে নির্বাচিত করত। এভাবে সাধারণ জনগণ তাদের হারানো স্বশাসন ও ক্ষমতার কিছুটা ফিরে পায়।
ব্রিটিশ মিডিয়ায় ঘটনাপ্রবাহকে কেন্দ্র করে বিভিন্ন মিথ্যা ন্যারেটিভ সৃষ্টি করা হয়। কৃষ্ণাঙ্গ নারীদের আন্দোলনকে তারা পাগলের প্রলাপ হিসেবে তুলে ধরে। যদিও কোন ইউরোপিয়ান এই বিক্ষোভগুলোতে আহত বা নিহত হয়নি, ব্রিটিশরা মিথ্যা খবর প্রচার করেছিল যে ইউরোপীয়দের ওপর হামলা করা হয়েছে। এছাড়া আরেকটি জনপ্রিয় প্রোপাগান্ডা ছিল যে আফ্রিকান নারীরা ইউরোপীয় নারীদের ঘৃণা করে ও তাদের সুযোগ পেলেই আঘাত করে।ইতিহাসের ঔপনিবেশিক ব্যাখ্যায় অনেক সময় এই আন্দোলনকে দাঙ্গা বলে অভিহিত করা হয়েছিল। কিন্তু এটি কোন দাঙ্গা ছিল না। বরং এটি ছিল ব্রিটিশ উপনিবেশবাদের বিরুদ্ধে নিজেদের অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক অধিকার পাওয়ার লড়াই। একপাক্ষিক সহিংসতাকে দাঙ্গা বলা যায় না। আফ্রিকানরা তাই ইতিহাসকে নতুন করে বর্ণনা করেছে, এই আন্দোলনকে দাঙ্গা নয়, বরং একটি বিপ্লব বলে অভিহিত করেছে। আবা নারী বিদ্রোহের মাধ্যমেই প্রথম নাইজেরীয় নারীরা ব্রিটিশদের বাধ্য করে তাদের মতামত ও অস্তিত্বকে গুরুত্ব দিতে। এই বিদ্রোহ পরবর্তীতে আরো অনেক আন্দোলনকে অনুপ্রেরণা দিয়েছে।
১৯২৯ সালের নভেম্বরে সুদূর নাইজেরিয়ায় ঘটে যাওয়া একটি আন্দোলন কিন্তু ২০২১ এর নভেম্বরের বাংলাদেশেও প্রাসঙ্গিক। এই বিদ্রোহ থেকে আমরা শিখি নারীদের নিজস্ব আয়, নেটওয়ার্ক আর নেতৃত্ব কতটা শক্তিশালী হতে পারে। ইগবো নারীরা তাদের উপর ঘটে যাওয়া অন্যায়কে শক্ত হাতে প্রতিরোধ করেছে, একে অপরের উপর বিশ্বাস রেখে আন্দোলন চালিয়ে গেছে। তাদের এই আদর্শ পুরো পৃথিবীর জন্য একটি অসাধারণ দৃষ্টান্ত।