November 23, 2024
ফিচার ৩মুক্তমত

‘‘যদি আমাকে ‘নারীবাদী’ বলে বাতিলের খাতায় পাঠিয়ে দেয়”?

প্রিয়া দেব ।। মাঝে মাঝে সোশ্যাল সাইটে আমি অনেক সাজানো গুছানো পুতুলের মতো মেয়েদের দেখি, যাদের ফেসবুকীয় জীবন কাটে নানা মিমস শেয়ার দিয়ে, নানারকম কাঠগোলাপের ছবিওয়ালা প্রেম ভালোবাসাময় উক্তি আর ভবিষ্যতের স্বামী কি রকম কেয়ারিং হবে সেসব সম্পর্কিত গার্লস গ্রুপের পোস্ট শেয়ার দিয়ে। তাদের দেখলে চোখ জুড়িয়ে যাবে,আপনার মনে হবে পদ্মাসেতুর পিলারে লঞ্চের ধাক্কা লাগা ছাড়া দেশে আর কোনো সমস্যা নাই।

তো এরকম মেয়েদের হঠাৎ করে মনে হয়, দেশে তো প্রায়ই নারী নির্যাতনের বিরাট বিরাট ঘটনা ঘটে, তাই একটা পোস্ট করি। তখন তারা অবলা নারীর মতো “এভাবে আর কতো সহ্য করবো” টাইপ শিরোনাম দিয়ে দুয়েকটা পোস্ট করেন, সেসব পোস্টে তাদের পুরুষতান্ত্রিক বড় ভাই কিংবা অনুরাগী পুরুষেরা এসে কমেন্ট করেন “নারীবাদী হয়ে যাচ্ছো”। সাথে সাথে পোস্টদাতা নারীটি তাড়াতাড়ি কমেন্ট করে নিশ্চয়তা দেন যে উনি নারীবাদী না, উনি শুধু অন্যায়ের প্রতিবাদ করছেন। কমেন্টকারি পুরুষটি ওতে খুব একটা খুশি হন না, তারা নারীবাদী না হওয়ার পরামর্শ দিয়ে একটা সমঝোতামূলক জায়গায় গিয়ে মন্তব্য করেন “তোমরা নারীদের আমরা কতো সুখেই না রাখতে চাই, তোমাদের কারো কারো দোষে আর আমাদের মতো পুরুষদের হালকা দোষে এরকম ঘটনা ঘটে যায়, তোমাদের উচিত নিজেদের সীমাটা বোঝা”। তখন সেই নারীটিও সহমত জানায়ে সরে আসেন এবং দুদিন পর পোস্ট ডিলিট করেন।

আমি এসব দেখে আগে বিরক্ত হতাম। তারপর একদিন ভাবতে লাগলাম এই নারীবাদী ট্যাগে সমস্যাটা কী? আমাদের সাজানো গুছানো আধুনিকা কাঠগোলাপ কানে দেওয়া নারীরা এই ট্যাগকে এতো ভয় পান কেন? আস্তে আস্তে আমি এই কারণ বুঝতে সক্ষম হলাম। আমাদের এই নারীরা অস্তিত্ব সংকটে ভোগেন, তারা মনে করেন তার আশেপাশের পুরুষেরা তাকে নারীবাদী বলে দিলে তারা বাতিলের খাতায় চলে যাবেন। আশেপাশের প্রগতিশীল লেবাসধারী পুরুষটি, কাব্যচর্চা করা কবিটি, ইনবক্সে রোজ স্তুতিগান গাওয়া পুরুষটি হয়তো তাকে আর দাম দেবে না।এই অস্তিত্ব সংকটটা মারাত্মক। এই যে আমাকে পুরুষের দাম পাইতেই হবে, পুরুষের বেঁধে দেওয়া ভদ্র নারীর ক্রাইটেরিয়া অনুযায়ী সমাজে টিকে থাকতে হবে, পুরুষতান্ত্রিক স্পেসিফিক ভায়োলেন্সে পুরুষকে কিছু বইলা প্রতিবাদ করা যাবে না- এইসব সত্যিই বড় অদ্ভুত।

আজকে মানব সভ্যতা এই এতো দূরে এসে দাঁড়ানোর পরও আমাদের নারীরা নিজেদেরকে মানুষ ভাবতে পারেন না, নিজেদেরকে তারা পুরুষের সেট করে দেওয়া নারীর সংজ্ঞায়ন থেকে বার করতে পারেন নি। এইখানে ভয়টা কীসের? আমি প্রত্যন্ত এলাকার সুবিধাবঞ্চিত নারীদের কথা বলবো না, সেসব নারীদের জীবন সংগ্রাম যথেষ্ট কঠিন, পুরুষতন্ত্রের ছোবলে জর্জরিত শিক্ষার ছোঁয়া না পাওয়া নারীরা যদি আজকে পুরুষের বেধে দেওয়া সভ্য নারীর সংজ্ঞায় চলতে বাধ্য হন, আমি তাদের দোষ দেব না। রোজ মানসিক শারীরিক  নির্যাতন সহ্য করে তারা বেঁচে থাকেন, স্বামীর ঘর ছাড়তে গেলে সমাজ তাকে বেশ্যা উপাধি দেয়, এতো কিছুর পরেও সেইসব নারীরা অসম লড়াইয়ে এগিয়ে যাচ্ছেন। আমি আমার চাইতে হাজারগুন সাহসী তাদের মনে করি, যে জীবন তারা পান সেই জীবনে বেঁচে থাকাটাই বিরাট ব্যাপার। কিন্তু যেসব সুযোগ সুবিধা ভোগ করা, পড়াশুনা করে শিক্ষিত তকমা পাওয়া নারী নিজেকে প্রভু ভাবা পুরুষদের মনঃক্ষুণ্ণ হওয়ার ভয়ে নিজের অধিকারের দাবীটি তুলতে ভয় পান, তাদের দেখে আমার অদ্ভুত লাগে।

আমি চাকুরীজীবী অনেক মেয়ে দেখেছি,যারা নিজের পায়ে দাঁড়িয়ে আছেন কিন্তু তারাও এই একই নিয়মে সমাজে ভালো মেয়ের সংজ্ঞা সেট করে দেওয়া পুরুষদের ভয় পান। এই ভয়ের কারণটা কী? প্রভু সাজা পুরুষদের কাছে বাতিলের খাতায় পড়ে যাওয়া? এই ভয়টা থেকে আমাদের নারীদের বের হতে হবে। যদি সাজানো গুছানো সভ্য সমাজ একজন মেয়ের অধিকারের প্রশ্নে ভালো কিংবা খারাপ মেয়ের সংজ্ঞা সেট করতে বসে তবে সেই সমাজকে বাতিল করতে মেয়েদের শিখতে হবে, নিজের অবস্থান বুঝতে হবে। আর কতোকাল তারা এরকম মেয়েমানুষ তকমা নিয়ে বাঁচবেন সেটা তাদের ঠিক করতে হবে, মেয়ে মানুষ থেকে মানুষ হয়ে উঠবার লড়াইয়ে যদি অমেরুদণ্ডী প্রভুদের বাতিলের খাতায় নাম লেখাতে হয়, তবে তাই লেখাবেন।

জীবনে সব ছাড়িয়ে আজকে নারীকে তার ন্যায্য অধিকার বুঝে নিতে হবে, এতোদিন তার উপর হওয়া নির্যাতনগুলোর প্রতিবাদ করবার মতো আওয়াজ শিখে উঠতে হবে কিন্তু তারো আগে মেয়ে হয়েও সে যে আস্ত একটা মানুষের সম্মান পাবার যোগ্যতা রাখে তা তাকে বুঝতে হবে। যখন নিজেকে সবকিছুর উর্ধ্বে মানুষ ভেবে উঠতে পারবে আমাদের নারীরা, তখনই তারা মানুষ হিসেবে তার প্রতি হওয়া অন্যায়গুলো অনুধাবন করতে সক্ষম হবে। এজন্য সমাজে মানুষ না হতে চেয়ে প্রভু হয়ে চাওয়া পুরুষদের ভয় পাওয়া বন্ধ করতে হবে, তাদের বাতিলের খাতায় নাম চলে যাবে এমন অন্ধ ভয় থেকে বের হতে হবে। এবার বাতিলের খাতা খোলার দায়িত্ব বরং নারীরা নিক, সমাজের যে সকল মানুষ নারীদের নিজস্ব সংজ্ঞায় বেধে রাখতে চায় তাদের বরং নারীরা বাতিলের খাতায় ফেলে দিক।

[ফেমিনিস্ট ফ্যাক্টরে প্রকাশিত মুক্তমত লেখকের নিজস্ব বক্তব্য]

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *