November 25, 2024
নারীবাদ আলোচনাফিচার ৩

মেল গেইজ: পুরুষের চাহনি যখন নারীকে মাপে

কারিন আশরাফ ।। 

সিনেমায় যখন দেখতাম ক্যামেরা জুম হয়ে ওঠানামা করছে লাস্যময়ী নায়িকার শরীরের ওপর থেকে নিচে, বিব্রত মনে প্রশ্ন জাগতো এর প্রাসঙ্গিকতা ঠিক কোথায় তা নিয়ে। কিছুটা বড় হয়ে বুঝতে পারলাম, খুব ইচ্ছাকৃতভাবেই এভাবে মিডিয়ায় নারীকে উপস্থাপন করা হয়। এই বিষয়টা শুধু সিনেমা নয়, খবর পড়তে আসা টিপটপ সংবাদপাঠিকা, বিলবোর্ডে আহ্বানসূচক ভঙ্গিমায় পোজ দিয়ে দাঁড়ানো মডেল থেকে শুরু করে সাধারণ কিশোরীর সাজগোজের মধ্যেও হানা দিয়েছে।

মেল গেইজ, বা পুরুষের চাহনি হলো পৃথিবী আর নারীকে বিপরীতকামী পুরুষের দৃষ্টিভঙ্গি থেকে উপস্থাপন করা, যেখানে নারীর মূল কাজই হয় পুরুষের কাছে আকর্ষণীয় হওয়া। বেশিরভাগ সাহিত্য ও সিনেমায় আমরা দেখি, নারীরা যেন ‘অন্য’। সেখানে পুরুষই মূল চরিত্র। নারীর রোল থাকে পুরুষকে ঘিরে। এখানে নারীর যৌনতাকে বাদ দিলে তার ব্যক্তিত্বের কিছুই অবশিষ্ট থাকে না। বাস্তবে কি তাই হয়?

নারীরা তাদের নিজস্ব চিন্তা, অনুভূতি ও ব্যক্তিত্ব নিয়ে স্বতন্ত্র ও পূর্ণাঙ্গ মানুষ। পুরুষতন্ত্র নারীর অস্তিত্বকে স্বতন্ত্র হিসেবে স্বীকৃতি দেয় না। বরং নারীকে ফেলে দেয় ‘অন্যান্য’ এর ক্যাটাগরিতে। মেল গেইজ নারীদের নিষ্ক্রিয় বস্তুতে পরিণত করে, যে শুধু পুরুষের দেখার জন্য, যৌনকামনা চরিতার্থের জন্য ব্যবহৃত। এই একই কারণে ম্যাগাজিন কভারে একজন নায়িকাকে বাধ্য হতে হয় অতিরিক্ত দেহ প্রদর্শন করতে, অথচ একজন নায়ক তা না করেই হতে পারেন গ্ল্যামারাস।

ইংরেজ ফেমিনিস্ট ও ফিল্ম সমালোচক লরা মালভি ১৯৭৩ সালে তার প্রবন্ধ “ভিজ্যুয়াল প্লেজার অ্যান্ড ন্যারেটিভ সিনেমা”তে মেল গেইজ বিষয়টি বিশদ ব্যাখ্যা করেন। প্রাথমিকভাবে মেল গেইজের ধারণাটি ব্যবহৃত হয়েছিল ফিল্ম থিওরিতে যা পরবর্তীতে সমাজবিজ্ঞানের অন্যান্য বিশ্লেষণেও ব্যবহার করা হয়। মেল গেইজ দিয়ে আমরা দেখি, পুরুষতন্ত্রে ন্যারেটিভ বা গল্পটা সবসময় থাকে পুরুষের নিয়ন্ত্রণে। পুরুষেরাই এখানে বক্তা ও শ্রোতা, উৎপাদক ও ভোক্তা। এতে নারীর অবদানকে সংকুচিত করা হয় একটা ইরোটিক বস্তুতে। নারীর মর্যাদা এখানে নির্ভর করে সে পুরুষের দৃষ্টিতে কতটা আবেদনময়ী, তার ওপরে।

শতশত উদাহরণ টানা সম্ভব যেখানে নারীর ওপর অপ্রয়োজনীয় ও অপ্রাসঙ্গিকভাবে যৌনতা আরোপ করা হয়েছে। সিনেমায় হয়তো একজন নারী ডিটেকটিভ বা নারী শিক্ষক থাকবেন, যিনি পরে আছেন টাইট কাপড়, হাইহিল আর টকটকে লাল লিপস্টিক। বাস্তবে এই পেশার নারীরা বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই এরকম গেটআপে চলেন না। কিন্তু সিনেমায় তাকে এভাবে প্রদর্শন করা হয়, যাতে এই যৌন আবেদনকে ব্যবহার করে পাওয়া যায় ব্যবসায়িক সাফল্য। অনেক সময়ই এসব চরিত্রের সিনেমার মূল গল্পে তেমন কোনো ভূমিকা থাকে না। তারা হয়ে থাকেন শোপিসের মতো, সুন্দর কিন্তু অপ্রয়োজনীয় জড় পদার্থ।

নারীরা মানবজাতির অর্ধেক। অতিরিক্ত যৌনতা আরোপণ আর নিতান্ত ভোগের সামগ্রীর মতো করে উপস্থাপন করার কারণে নারীকে ক্রমশ অমানবিককরণ (Dehumanization) করা হয়। এতে নারী হয়ে ওঠে প্রতিস্থাপনযোগ্য, যাকে যেকোনো সময় বাতিল করে দেয়া যায়। কোনো কিছু পুরানো হয়ে গেলে, অকেজো হয়ে গেলে যেমন আমরা ফেলে দিই, নারীকেও তেমনভাবে দেখে সমাজ। সিনেমা-নাটকে আমরা দেখেছি সফল পুরুষের আকর্ষণীয় স্ত্রী থাকে, তাই আমাদের ছাত্রদেরও শিক্ষা দেওয়া হয়, “বুয়েটে ভর্তি হতে পারলেই মেয়ে পাবি।’’ ক্রমাগত নারীদের নিষ্ক্রিয় হিসেবে দেখানো হয়, ফলে এমন একটি ধারণা তৈরি হয় যেন সুন্দরী নারীরা ট্রফি বা প্রাইজ: তারা আবেগ-অনুভূতিসম্পন্ন সম্পূর্ণ মানুষ নয় যার নিজের ইচ্ছা-অনিচ্ছা আছে।

নারীরা কখনোই শুধু পুরুষের কামনার বস্তু নয়। তাদের যে নির্বোধ এবং অনমনীয় সৌন্দর্যমানের ভিত্তিতে বিচার করা হয় তা কেবল পুরুষতান্ত্রিক মেল গেইজের উদ্দেশ্যই হাসিল করে। সমাজের রন্ধ্রে রন্ধ্রে পুরুষতান্ত্রিকতা ঢুকে যাওয়ায় নারীরাও মেল গেইজকে আত্মস্থ করে ফেলে। নিজেকে ম্যাগাজিন কভারের মডেলটির সাথে তুলনা করতে শুরু করে, আর ভুগতে থাকে মনোকষ্টে। অথচ একজন নারী জন্ম থেকেই জিরো ফিগার হয় না, তার শরীর লোমহীন হয় না, তার মুখ দাগবিহীন হয় না। মিডিয়ায় ক্রমাগত আমরা দেখি অপ্রাকৃতিক সৌন্দর্যের উপস্থাপন। তার তুলনায় যেসব পুরুষকে আমরা দেখি, তারা বেশিরভাগই দেখতে আমাদের চারপাশের পুরুষের মত। ফলে বেশিরভাগ পুরুষ যদিও নিজেদের প্রতিচ্ছবি মিডিয়ায় দেখে, আমরা তা দেখি না। ফলে তৈরি হয় হীনম্মন্যতা, বডি ইমেজ ইস্যু, ইটিং ডিসঅর্ডার, বিষন্নতা ও আরো অনেক অনেক সমস্যা।

মেল গেইজ পুরুষতন্ত্রেরই একটি কাঠামো, যা নারীর পরিচয়কে সংকীর্ণ করে। নারীকে এক অর্থহীন, সীমাহীন ঘোড়ার রেসে নামতে বাধ্য করে। এর প্রভাব থেকে মুক্ত হওয়ার জন্য প্রথম পদক্ষেপ হচ্ছে এর অস্তিত্বকে স্বীকার করা। লক্ষ্য করুন দৈনন্দিন জীবনের কোন কাজগুলো নিজের অজান্তেই আপনি করে ফেলছেন, যা আসলে মেল গেইজের দাসত্ব করে। যতদিন পর্যন্ত পুরুষের হাতে কলম ও ক্যামেরার একচ্ছত্র নিয়ন্ত্রণ থাকবে, ততদিন পুরুষতান্ত্রিক স্টোরিটেলিং-এ নারী থাকবে নিষ্ক্রিয় ও পুরুষকেন্দ্রিক। এর প্রতিরোধে যা দরকার, তা হলো নারীর নিজের শরীর, যৌনতা ও গল্পের উপর নিয়ন্ত্রণ আনা। তাহলেই নারী নিজেকে মেল গেইজের বাইরে গিয়ে প্রকাশ করতে পারবে স্বতঃস্ফূর্তভাবে।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *