November 22, 2024
ফিচার ৩মুক্তমত

বিয়ে এবং বিচ্ছেদ

নাবিলা সোনার ।। গত দু’মাস আগে আমার শহরের পাঁচ-ছ জন বাঙ্গালী ভাই-আপুদের সাথে অন্য প্রদেশের শহর ভ্রমণে বের হয়েছিলাম। সারাদিন ঘোরাঘুরি শেষে সন্ধ্যায় একটা ছবির মত সুন্দর লেকের পাড়ে বসে সবাই মিলে সৌন্দর্য দেখছিলাম। কেউ গিটার বাজিয়ে গান গাইছিল, কেউ হাসি-তামাশার মেতে উঠছিল। সব মিলিয়ে চমৎকার একটি সন্ধ্যা। এর মধ্যে কানে এলো আমার পাশের কয়েকজন বিবাহ বিচ্ছেদ নিয়ে কথা বলছে। তো আমিও সেখানে আগ্রহ নিয়েই অংশ নিলাম জানার জন্য যে কে কী ভাবছে। তো এক ভাই মতামত দিলেন যে আগের চেয়ে অনেক বেশি সংখ্যক নারী এখন যেহেতু শিক্ষিত এবং স্বাবলম্বী হচ্ছে এই কারণেই বিচ্ছেদের সংখ্যা এখন অনেক বেশি। বিদেশে উচ্চশিক্ষার জন্যে আসা ভাইটির মুখে শুনে এই কথাটা আমার একটু কানেই লাগলো কারণ তিনি বিচ্ছেদের মূল কারণের দিকে গুরুত্ব না দিয়ে নারীদের শিক্ষিত এবং স্বাবলম্বী হওয়াটাকে একমাত্র কারণ বলে দায়ী করছেন।

চলুন আগে দেখি একটি দম্পতি বা বিবাহিত কোনো ছেলে বা মেয়ে কখন বিচ্ছেদ নিতে চায়। এক. যখন কোনো একজন অতি মাত্রার শারীরিক কিংবা মানসিক নির্যাতনের শিকার হয় অপরপক্ষের দ্বারা। দুই. দুইজনের মাঝে সম্পর্কের সামঞ্জস্যতার অভাব। তিন. হতে পারে তৃতীয় পক্ষের আবির্ভাব বা পরকীয়া। এখন যুক্তিমত আসে যে যেকোনো একটা কারণই একবার বা বারংবার ঘটতে থাকলে একজন স্বাবলম্বী, আত্মমর্যাদাসম্পন্ন নারী সেটি দিনের পর দিন সহ্য করতে চাইবে না। সে যেকোনোভাবেই হোক না কেন সেই বিষাক্ত সম্পর্ক থেকে বেরিয়ে আসতে চাইবে। এটিকে হয়ত সবাই বলতে পারে যে স্বাবলম্বী, এই জন্যেই বিচ্ছেদ নেওয়ার সাহস পেয়েছে। না হলে হয়ত পেত না। হ্যাঁ এটা আলবৎ সত্যি যে সে নিজের পায়ে নিজে দাঁড়াতে জানে দেখে সম্পর্ক থেকে বেরিয়ে আসতে পারছে। না পারলে হয়তো আসতো না। কিন্তু মূল কারণ যে সম্পর্কের তিক্ততা সেটা কোনোভাবেই ভুলে গেলে বা পাশ কাটিয়ে গেলে চলবে না।

যেকোনো মানুষের সাথে একসাথে থাকা বা জীবনের একটা অংশ করে নেওয়া খুব বেশি সহজ না। আমাদেরকে ছোট থেকে শেখানো হয় একসাথে থাকতে গেলে ছাড় দিয়ে থাকতে হবে। এখানে হয়ত যারা একটু কর্তৃত্বপূর্ণ, তারা তাদের ইচ্ছা অনিচ্ছা তাদের সঙ্গীদের উপর চাপিয়ে দিতে চায়। যে একটু নরম স্বভাবের সে হয়তো সব মেনে নিয়ে, ছাড় দিয়েই সংসারটা করতে চায়।

সবচেয়ে বড় যে কারণ চোখে পড়ে তা হলো, আমাদের সমাজে বিয়েটাকে এতটাই গুরুত্ব সহকারে দেখা হয় যে এটা না করলে তাকে এক রকম সমাজ বহির্ভূত মানুষ হিসেবে গন্য করা হয় এবং সেরকম করেই তার সাথে আচরণ করা হয়। একটা বয়স পরে প্রায় প্রত্যেকটা ছেলেমেয়ের পরিবার পরিজন সবাই চায় তারা বিয়ে করে সংসার শুরু করুক। কেউ এইদিকে লক্ষ্য করার প্রয়োজন বোধ করে না ছেলেটি বা মেয়েটি মানসিকভাবে বিয়ে করার জন্য তৈরি কিনা, সে দায়িত্ববোধসম্পন্ন কিনা, সে তার সঙ্গীকে এবং তার ইচ্ছা আকাঙ্ক্ষাগুলোকে যথেষ্ট সম্মান দিতে পারবে কিনা।

একটি উদাহরণ যদি দিই। সেদিন আমার এক আত্মীয়ের কাছে শুনলাম তার পরিচিত একজন যিনি পেশায় একজন স্কুল শিক্ষিকা, তিনি তার এস.এস.সি. পরীক্ষার্থী মেয়ের জন্য একজন ভালো (!) ছেলে খুঁজছেন। সেই ছেলেকে তারা নিজেদের টাকা দিয়ে পড়াশোনা করাতে ইচ্ছুক এবং যদি যৌতুকও চায় তাতেও তাদের কোনো আপত্তি নেই। তো এতই মরিয়া যদি অবস্থা হয় মেয়েদের বাবা-মায়েদের যে তাদের চাহিদামত একটা ছেলে পেলেই হল, মেয়েটির কম বয়স কোনো ব্যাপার না, ছেলেটি স্বভাবে কেমন হবে সেটা বাপার না, ছেলেটি এবং মেয়েটির মধ্যে সম্পর্ক কেমন হবে, তারা একসাথে কতটুকু মিল দিয়ে থাকতে পারবে সেটা তো কোনোভাবেই ব্যাপার না, তাহলে সেই সম্পর্কে এক সময় তিক্ততা আসাই কি স্বাভাবিক নয়?

একসাথে থাকা যে সহজ নয় সে বিষয়ে আমার ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতা আলোচনা করতে পারি। আমি আমার সঙ্গীর সাথে উথাল-পাথাল প্রেমের পর যখন থাকতে শুরু করি একসাথে, তখনই সেই প্রেম কখন উধাও হতে শুরু করলো। কারণ একেবারেই ছোটখাটো কিছু সমস্যা। যদিও আমাদের দুজনের মধ্যে সমন্বয় খুব চমৎকার ছিল। সম্পর্ক যাতে শ্বাসরুদ্ধকর না হয়ে যায় সেজন্য আলাদা শোবার ঘর, আলাদা কাজের জায়গা, আলাদা করে খাবারের জোগারযন্ত্র, ঘরের কাজেও কোনো বাধ্যবাধকতা নেই। এত কিছুতে নিজস্বতা থাকার পরেও মনে হত কোথাও হয়তো গরমিল হচ্ছে। যেটা পরে দেখলাম যে সময়ের সাথে সাথে ঠিকও হয়ে গিয়েছে। নতুন দম্পতিদের মধ্যে এই সময়টা দরকার দুজনের জীবন গতির সাথে খাপ খেয়ে নেওয়ার জন্য। আমি হয়তো বা ভাগ্যবতী যে এই সময়ে আমার পরিপার্শ্ব থেকে কোনো চাপ ছিল না। আমার সঙ্গীর পরিবার বা আমার পরিবারের কেউ কখনো আমাদের মধ্যে নাক গলাতে আসেন নাই বা তাদের কোনো উচ্চাশা আমাদের উপর আরোপ করেন নাই। আর এ কারণেই একসাথে চলার পথটা অনেক মসৃণ হয়ে গিয়েছে, আরো দুজন দুজনার কাছে আসতে পারছি, অপরজনকে আরো ভালোমত বুঝতে পারছি এবং সে সাথে আমাদের নিজস্বতাকেও ধরে রাখতে ও উপভোগ করতে পারছি।

এখন এই ক্ষেত্রে বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটের চিত্র দেখা যাক। মিল হোক বা না মিল হোক, একই ঘর ভাগাভাগি করে থাকতে হবে, কোনোভবেই আলাদা ঘরে থাকা যাবেনা, খাবারে কোনো নিজস্বতা থাকা যাবেনা, এখানে দেখা যায় অধিকাংশ ক্ষেত্রে ছেলের পরিবারের চাহিদার গুরুত্ব থাকে বেশি। বিয়ের পরে বউটিকে ছেলের পরিবারের মর্জি অনুযায়ী চলতে হবে। আর বিয়ের সময় ছেলেটিকে বা মেয়েটিকে এবং তাদের পরিবারকে যে দাঁড়িপাল্লায় দাঁড় করানো হয় তা এক রকম বীভৎস। এত কিছুর পরেও সবার আকাংক্ষা থাকে যে কোনো মূল্যেই হোক সম্পর্ক বয়ে নিয়ে যেতে হবে। সম্পর্কে সমস্যা দেখা দিলে সন্তান নিতে হবে। তারপর আবার সেই সন্তানের মুখ চেয়ে বিয়ে টিকিয়ে রাখতে হবে।

যেকোনো সম্পর্কই যখন ছাড় দিয়ে শুরু হয়, সেটা কখনো ভালোর পথে যায় না। বিয়ের মত গুরুত্বপূর্ণ একটি সম্পর্কে যাওয়ার আগে আগে নিজেদেরকে ভালোভাবে বোঝা উচিৎ যে এই মানুষটার সাথে জীবন ভাগাভাগি করা যেতে পারে কিনা বা আপনি মানসিকভাবে কতটা প্রস্তুত। নিজেকে প্রশ্ন করা উচিৎ কেন বিয়ে করতে চাচ্ছেন, একাকীত্ব ঘোচাতে, না কি   পরিবার বা সমাজের চাপে, না কি আপনার পছন্দের সঙ্গীর সাথে সেই রকম বোঝাপড়া আছে দেখেই একসাথে বাকি জীবন কাটাতে চাইছেন। আর বিয়ের পর সম্পর্কে সামঞ্জস্য রাখার সবচেয়ে বড় সূত্র হল, নিজের ইচ্ছা-অনিচ্ছাকে সবচেয়ে বেশি গুরুত্ব দেওয়া যেমন নিজের চাহিদা মত খাবার খাওয়া, বা পোশাক পরা বা পড়াশোনা ও কেরিয়ারে গুরুত্ব দেওয়া। কারণ সবারই তো জানা, একমাত্র নিজে ভালো থাকলেই আশেপাশের মানুষজনদের ভালো রাখা যায়। নিজের আশা আকাঙ্ক্ষা বিলিয়ে দেওয়া দুঃখী মানুষটার পক্ষে আরেকজনকে ভালো রাখা বেশ কঠিন।

[ফেমিনিস্ট ফ্যাক্টরে প্রকাশিত মুক্তমত লেখকের নিজস্ব বক্তব্য]

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *